হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আসন হিসাবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি। রায়পুর উপজেলা ও সদরের আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত এ আসনে দুইবার খালেদা জিয়া নির্বাচন করেছেন। প্রতিবারই তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। বিএনপির ঘাঁটি রায়পুর উপজেলা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগ। অবশ্য এমপি হিসাবে রয়েছেন জাপার মো. নোমান। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
তাই এ আসনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি- তিন দলই নানা ছক আঁকছেন। ভোটাররাও মেলাচ্ছেন নানা হিসাব।
এ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী হওয়ায় নেতাকর্মীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে। বিভক্ত হয়ে পড়ছে নানা গ্রুপে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সু-সংগঠিত করার চেষ্টার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এ ছাড়া এই আসনটিতে জামায়াতের রয়েছে ভোটব্যাংক। বিগত নির্বাচনে জামায়াতের ভোট জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবার জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও কৌশলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই এই আসনটিতে চলছে নানা সমীকরণ।
১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত লক্ষ্মীপুর-২ আসন। ’৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন ধানের শীষের প্রার্থী মোহাম্মদ উল্লাহ। ’৯৬ সালের নির্বাচনে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয় বিএনপিতে। ফলে ওই নির্বাচনে প্রার্থী হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন তিন। পরে আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুন অর রশিদের কাছে পরাজিত হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ফের প্রার্থী হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বিজয়ী হন বিপুল ভোটে। পরে আসনটি ছেড়ে দেন তিনি। উপনির্বাচনে ধানের শীষের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন সাবেক ছাত্রদল নেতা আবুল খায়ের ভূঁইয়া। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ধানের শীষের টিকিটে দ্বিতীয়দফা এমপি হন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলে ১৪ দলের প্রার্থী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. নোমান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন।
এদিকে এবারের নির্বাচনে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক এমপি হারুন অর রশিদ, লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন, বাংলাদেশ কমিউনিটি কুয়েতের সভাপতি ও কুয়েতের বঙ্গবন্ধু স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শিল্পপতি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল, স্বাচিপ নেতা এহসানুল কবীর জগলুল প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সাবেক এমপি হারুন অর রশিদের ব্যক্তি ইমেজ নৌকা প্রতীকের জয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করছেন। অপরদিকে শিল্পপতি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের সাধারণ মানুষসহ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে জনপ্রিয়তা। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য নিজ খরচে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে দলীয় কার্যালয় করে দেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া স্কুল-মাদরাসা ও মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দান-অনুদান। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। দলের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করেন তিনি। তৃণমূলের কর্মীদের সময় দেন, খোঁজ-খবর নেন। জেলায় দলীয় কার্যালয় না থাকায় তাঁর নিজস্ব বাসভবনেই দলের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা এহসানুল কবীর জগলুল একজন স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই এলাকায় পরিচিত। তিনিও দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ইতিমধ্যে নেতাকর্মীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।
ওদিকে বিএনপি থেকে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া, বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান এবিএম জিলানী ও সাবেক পিপি মনিরুল হাওলাদার।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, এ আসনে বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তবে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসুস্থতা ও বিগত কর্মকাণ্ডের কারণে ইমেজ সংকটে রয়েছেন সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভূঁইয়া। এ ছাড়া জেলা কমিটিতে আত্মীয়স্বজনদের প্রাধান্য দেয়ায় পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। এ অবস্থায় দলীয় কোন্দল প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। ওদিকে জিয়া পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে লে. কর্নেল (অব.) মজিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন রায়পুর বিএনপির একটি বড় অংশ। তিনিও দলের ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
এদিকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন না থাকলেও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করেন মো. নোমান। সভা-সেমিনারেও অংশ নেন এ নেতা। আগের চেয়ে বর্তমানে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন বেড়েছে বলে মনে করেন তারা। তাই আগামী নির্বাচন জোটগতভাবে হলে মোহাম্মদ নোমান আবারো জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।
ওদিকে এ আসনে জামায়াতের নিজস্ব একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনে না গেলে তাদের প্রার্থী হিসেবে দলের জেলা আমীর মাওলানা রুহুল আমিনের নামই আলোচিত হচ্ছে। এ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কথাও রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর এ নেতার।
জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া বলেন, এ এলাকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এলাকার মানুষ তথা বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। বর্তমানে এখানে বিএনপি অনেক শক্তিশালী। সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ বলেন, আশির দশকে ঢাকা কলেজে পড়াকালেই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ২০০১-৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের কারণে আমাকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। এরপর থেকে বিএনপির সঙ্গেই আছি। তবে আমার জন্মস্থান রায়পুর এলাকাটি অবহেলিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন না হওয়ায় এলাকাটি পিছিয়ে রয়েছে। তাই অবহেলিত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য রায়পুর থেকে মনোনয়ন চাইব।
সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, আমি ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছি। সবসময় দল ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সুখে দুঃখে পাশে ছিলাম। ভবিষ্যতে থাকব। আমি এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করেছি। তাই দল আমাকে সকল কিছু মূল্যায়ন করে মনোনয়ন দিবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ-কমিউনিটি কুয়েতের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল বলেন, রাজনীতি করতে এসেছি, নিতে নয়, দিতে এসেছি। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করছি। তাই দলের মনোনয়ন চাইব।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন জানান, তিনি বিগত জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর দলকে সু-সংগঠিত করতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বিগত ইউপি নির্বাচন, পৌর নির্বাচন এবং সর্বশেষ জেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে নেত্রী তাকে মনোনয়ন দিবেন বলে প্রত্যাশা করেন।