হাওর বার্তা ডেস্কঃ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া এই সংকট নিরসন সম্ভব নয়। শুক্রবার জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সঙ্গে বৈঠককালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিচালিত গণহত্যার তদন্ত শেষে বাংলাদেশ ত্যাগের আগে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এই বৈঠক করেন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করছে মিয়ানমার। এটা একটা আইওয়াশ।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার বিষয় সরেজমিন তদন্ত করতে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল গত বছর তিন সদস্যবিশিষ্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করেছে। কিন্তু মিয়ানমার জাতিসংঘ মিশনকে সে দেশে যেতে অনুমতি দেয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। এই মিশন মিয়ানমার যেতে না পেরে এখন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের তদন্ত সম্পন্ন করেছে।
ইতিমধ্যে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছে। এ ছাড়া, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের দফতরের কর্মকর্তারা এক মাস ধরে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়াও, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন, বিদেশি সাহায্য কর্মীদের সঙ্গেও তারা বৈঠক করেছেন। এই মিশন আগামী বছরের মার্চে তাদের তদন্তের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেবে। আর আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দেবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা কোনো মন্তব্য করেননি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে নিষ্ঠুর তাণ্ডব ঘটেছে তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরুন। আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট নিরসন সম্ভব নয়। মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না। আমরা দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া তারা কিছু করবে বলে মনে হয় না। সূত্রটি আরও জানায়, একই ধরনের মন্তব্য পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকও ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যদের জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে পররাষ্ট্র সচিব জাতিসংঘের এই মিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার আন্তরিকতার অভাব দেখিয়েছে বলে তার সফরসঙ্গী কর্মকর্তারা বলছেন। যদিও তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছে। তবে এটাও বলছে যে, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই করার সক্ষমতা তাদের নেই। তা ছাড়া, এত বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে তারা বিশ্বাস করে না।
পাশাপাশি, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আভাস দিচ্ছে মিয়ানমার। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে বলে মনে করেন। তারা বলছেন, মিয়ানমার নানা অজুহাতে টালবাহানা করছে, সময়ক্ষেপণ করছে।
রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। অথচ একদিনেই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা সম্ভব। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না বলেই তাদের অভিমত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি মিয়ানমার সফরকালে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিয়া সোয়ে ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি’র সঙ্গে বৈঠক করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকালে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে আজগুবি গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের স্থলমাইন বসানোর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। জবাবে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, কথিত জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ (আরসা) এসব মাইন বসিয়েছে। মিয়ানমার সরকার এসব অপসারণের চেষ্টা করছে। কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে বলে অঙ্গীকার করেও এখন তা বাস্তবায়নে ধীরগতিতে অগ্রসর হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা মনে করেন।
এদিকে, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা দিয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমার বলেছে, এই তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার শুধু নামের তালিকা দিয়েছে। বাংলাদেশে কোথায় আছে তার কোনো ঠিকানা দেয়নি। ফলে মিয়ানমারের তালিকার কাউকে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করছে। এটা একটা আইওয়াশ। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে তাদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। বরং তারা বর্তমান পরিস্থিতির ওপর থেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি দূরে সরে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। এ কারণে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যেও রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন অব্যাহত আছে।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ উদ দৌলা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বার্মিজরা আমাদের সঙ্গে চিট করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এখন কেন সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তার সঙ্গে কথা এক রকম আর তাদের পত্রিকায় এলো অন্য রকম। গোটা সফরটাই শূন্য’।
সাবেক এই অভিজ্ঞ কূটনীতিক আরও বলেন, ‘কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট ব্যর্থতা। রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভারতের সমর্থন আমরা পাইনি। চায়নাতো সমর্থন দেয়ইনি। জাতিসংঘে শক্ত কথা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শক্ত ব্যবস্থা নিতে চায়না বাধা দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই সমস্যাটার শিগগিরই সমাধান না হলে আজকে যে ১০-১১ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েরা এখানে এসেছে; তারা দেখে এসেছে তাদের মা-বাবাকে হত্যা করা হয়েছে; তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে; তাদের মনে পুষে রাখা প্রতিহিংসা ৪-৫ বছর পর একেকটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড, বোমায় রূপ নেবে। ফিলিস্তিনি সমস্যা এভাবে সৃষ্টি হয়েছে; এলটিটিই এভাবেই হয়েছে। ফলে এটা শুধু বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমারের জন্য নয়; গোটা অঞ্চলের জন্য বিরাট এক বিপদসংকেত। এটা সবারই বোঝা উচিত।’
আশরাফ উদ দৌলা বলেন, ‘মিয়ানমার সমস্যা সমাধানে সহজে রাজি হবে না। কারণ তারা এটা বুঝেশুনেই করেছে। আরসার হামলা হল একটা অজুহাত। কথিত আরসা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য বিরাট কোনো হুমকি নয়। মিয়ানমার জানে, তারা এভাবে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করলে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হবে। তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েও কিছু হবে না। কারণ তারা গত ৫০ বছর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বাস করেছে। এই দেশটা অনেকটা উত্তর কোরিয়ার মতো। তারা এসবে পাত্তা দেয় না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের উসকানির বিরুদ্ধে দুর্বলচিত্ত দেখিয়েছি। তারা ২১ বার আকাশসীমা লংঘন করার সময় আমরা কেন সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করিনি। ওরা যে ভাষা বোঝে তাদের সঙ্গে সেই ভাষাতেই কথা বলতে হয়। মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজে না, সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। শক্তিশালী কূটনীতি করতে হলে তার শক্তি প্রয়োগের ব্যাকিং থাকতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে যত দিন দু’ পক্ষের মধ্যে চুক্তি না হচ্ছে, তত দিন কাউকে সেখানে ফেরত পাঠানো যাবে না। মিয়ানমার ১৯৯২ সালের চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বললেও বাংলাদেশ বলছে এবারের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। তাই জাতিসংঘের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাতে নতুন চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের হাতে দিয়েছে বাংলাদেশ।
এভাবে কালক্ষেপণ করা মিয়ানমারের পক্ষে নতুন ঘটনা নয়। ইতিপূর্বে ২০০৫ সালে দুই হাজার রোহিঙ্গাকে যাচাই শেষ করার পরও তাদের ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। গত বছরের অক্টোবরের ঘটনার পর মিয়ানমারের একজন বিশেষ দূত ঢাকা এসে জানান যে, ওই ঘটনার পর মাত্র দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাবে তখন ওই ঘটনায় বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার। অতীতের সেসব অভিজ্ঞতার কারণে মিয়ানমারকে এখন আর বিশ্বাস করতে পারছে না বাংলাদেশ।