মানবতা বনাম বর্বরতা বাংলাদেশ এখন কী করবে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একদিকে বর্বরতা, অন্যদিকে মানবতা। বাংলাদেশ কাকে রুখবে, কার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে? বন্যার প্লাবনের মতো তিন লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রাণ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে ঢুকেছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো এত বড় ভার বহন করার উপযোগী নয়। কিন্তু এই বর্বরতা রোখার সুযোগ তার নেই। যা আছে তা হলো, এই দুস্থ মানবতাকে রক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ তা-ই করেছে। হাসিনা সরকার একদিকে ভয়াবহ বন্যার প্রকোপ থেকে নিজ দেশের মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে প্রতিবেশী মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহত্যাতুল্য বর্বরতা থেকে বাঁচানোর জন্য মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছে।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাবেক বার্মায় রোহিঙ্গাবিদ্বেষ আজকের নয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে। মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর সেই বিদ্বেষ কমেনি, বরং বেড়েছে। সামরিক শাসনের একটা বড় অভিশাপ এই যে এই শাসন তাদের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে জনগণের মধ্যে নানা ধরনের বিরোধ ও বিবাদ বাধিয়ে রাখতে চায়।

মিয়ানমারে পাঁচ দশক ধরে চলেছিল সামরিক শাসন। তারা প্রথমে তাদের এথনিক ক্লিনজিং বা সংখ্যালঘু বিতাড়নের নীতির অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা বিতাড়নের জন্য তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে এবং এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় প্রকাশ্য নির্যাতন। এখন তা পরিণত হয়েছে সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বর্বর হত্যাকাণ্ডে।

অবশ্য এ হত্যাকাণ্ডের জন্য একটা অজুহাতও তারা তৈরি করেছে। বৈষম্যপীড়িত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বহুদিন ধরেই একটা অসন্তোষ জমাট বাঁধছিল। তার মানে তাদের একাংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জন্ম নেয় এবং গঠিত হয় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের একটি সংস্থা। একটি স্বাধীন মুসলিম আরাকান রাষ্ট্র গঠনের দাবিও মাঝেমধ্যে শোনা গেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি, গত ২৫ আগস্ট এই স্যালভেশন আর্মির সন্ত্রাসীরা পুলিশের কয়েকটি সীমান্ত ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। এতে বহু লোক হতাহত হয়েছে। তারা রোহিঙ্গা-হত্যা চালায়নি। সন্ত্রাস দমনের অভিযান চালিয়েছে।

সেনা কর্মকর্তাদের এ দাবিতে সমর্থন জানিয়েছেন শান্তি ও অহিংসার জন্য নোবেল পুরস্কার জয়ী অং সান সু চিও। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি এখন প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের অঘোষিত সরকারপ্রধান। অবশ্য এ জন্য তাঁকে সামরিক জান্তার সঙ্গে আপস করতে হয়েছে এবং এই জান্তার মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে দীর্ঘকাল নীরবতা পালন করতে হয়েছে। যখন মুখ খুলেছেন তখন বিশ্ববাসীর ধিক্কার থেকে তাঁর সেনা সমর্থিত সরকারকে বাঁচানোর জন্য এই বর্বরতাকে ধামাচাপা দেওয়ার নীতি তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ৮৫ বছর বয়সী মানবতার সৈনিক বিশপ ডেসমন্ড টুটু এই সত্যটি ধরতে পেরেছেন। মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় ভয়াবহ বিভীষিকা সৃষ্টির খবরে (যে বিভীষিকায় গত দুই সপ্তাহে তিন লাখ নর-নারীকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে) তিনি এতই মর্মাহত হয়েছেন যে অবসরজীবন থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে অং সানের কাছে খোলা চিঠি লিখতে হয়েছে। তাতে তিনি লিখেছেন, “তুমি এত দিন ধরে আমার কাছে একজন ‘dearly beloved sister’ (একজন প্রিয়তম বোন), এখন তুমি এ কী করছ? এটা যদি দেশের সর্বোচ্চ পদে বসার জন্য তোমার রাজনৈতিক দাম দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে তা বড় ভয়ানক। ”

শুধু বিশপ টুটু নন, বিশ্বের বহু মনীষী এবং লাখ লাখ নর-নারী একদা শান্তি, অহিংসা ও মানবতার প্রতীক অং সানের নিন্দা জানাতে প্রকাশ্যে সরব হয়েছে। তাঁকে দেওয়া নোবেল পুরস্কার যাতে প্রত্যাহার করা হয় তার দাবিতে গত শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত গণ-আবেদনে স্বাক্ষর দিয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার নর-নারী। নোবেল পুরস্কার কমিটি বলেছে, পুরস্কারটি একবার দেওয়া হলে তা ফেরত নেওয়ার কোনো বিধি নেই। তা না হলে হয়তো বিষয়টি তারা বিবেচনা করত।

মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ থেকে মিয়ানমারকে বিরত করার জন্য এটা একটা বিরাট চাপ। কিন্তু এই চাপে বাংলাদেশে আগত তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বর্তমান সংকটের কোনো সমাধান হবে না। তাদের জন্য চাই আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার আশু ব্যবস্থা। কোনো কোনো শরণার্থী শিবিরে এরই মধ্যে কলেরাজাতীয় রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। অত্যাচারিত শিশু ও ধর্ষিতা নারীদের জরুরি চিকিৎসাও প্রয়োজন।

জাতিসংঘের মহাসচিব এই বর্বরতার নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার সাধ্যমতো এই শরণার্থীদের আশ্রয়দান এবং পুনর্বাসনের দায়িত্ব বহন করছে। কিন্তু এত বড় মানবিক দুর্যোগ বাংলাদেশের পক্ষে একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় শুধু জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো নয়, সৌদি আরব, তুরস্ক, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর এগিয়ে আসা দরকার। দেখা দরকার

মিয়ানমারের এই নিপীড়িত ‘মুসলিম মিল্লাতের’ জন্য তাদের হামদর্দি ভাব কতটা, নাকি সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের প্রপাগান্ডা?

মিয়ানমার সরকার যে বলছে, তারা এথনিক ক্লিনজিং করছে না, টেররিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। এটা গালগল্প। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ‘ইসলামী টেররিস্টদের’ তত্পরতা চলছে। কিন্তু তাদের দমনের নামে দেশগুলোর মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হয়নি। মিয়ানমারেও ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মিকে’ দমনের নামে গোটা রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে দেশ থেকে বহিষ্কারের অভিযান চালানো যায় না। শিশু-নারী-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা যায় না। এটা বর্বরতা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। গত ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারে এটা নতুনভাবে শুরু হয়েছে। কিন্তু এই অপরাধ তারা চালিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। জাতিসংঘকে এই বর্বরতা বন্ধ করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

মিয়ানমারের রাখাইন একটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকা। এখানে ‘বাণিজ্যে বসতি’ করার লক্ষ্যে ভারত ও চীনের মধ্যে একটা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। আছে মিয়ানমারের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। ফলে মিয়ানমার সরকারের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে দুটি দেশই তেমন সরব নয়। তারা মিয়ানমার সরকারকে চটাতে চায় না। অন্যদিকে মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক অভিসন্ধিও ধীরে ধীরে প্রকাশ্য রূপ ধারণ করছে। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, রোহিঙ্গাদের এক শ্রেণির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সমর্থক সৃষ্টি এবং আরাকান স্যালভেশন আর্মি গড়ে তোলার পেছনে পেট্রো-ডলারের একটা বড় ভূমিকা আছে।

বাংলাদেশের জামায়াতের একটি বড় ঘাঁটি রয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী এলাকায় একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাহলে বাংলাদেশে সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটানো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এ জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশে যাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢুকতে পারে সে জন্য উৎসাহ জুগিয়ে তারা এ সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধানে আগ্রহী নয়। বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যন্ত জামায়াতের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তৈরি হয়েছে। কক্সবাজারের কোনো নির্বাচনেই জামায়াতের প্রার্থীকে হটানো সম্ভব হয় না। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

এ সমস্যার আরো একটি দিক আছে, যা এখনো প্রকাশ্য রূপ লাভ করেনি। আমেরিকায় দক্ষিণ এশীয় নীতিতে চীনের প্রভাব বিস্তার রোখার জন্য বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় তার সামরিক প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের নামে যেমন যুদ্ধের সম্প্রসারণ ও স্থায়ী ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়েছে, তেমনি রোহিঙ্গা-সমস্যা সমাধানের নামে জাতিসংঘকে এড়িয়ে আমেরিকা সামরিক সাহায্যদানের আবরণে এগিয়ে আসতে পারে। হাসিনা সরকারের দৃঢ়তায় এ পর্যন্ত আমেরিকা বাংলাদেশে তার প্রকাশ্য সামরিক প্রভাব ও প্রাধান্যের বিস্তার ঘটাতে পারেনি। এখন মিয়ানমারে আর্তমানবতাকে রক্ষা ও শান্তি স্থাপনের নামে আমেরিকা নাক গলাতে পারলে সেই নাকের ডগা প্রসারিত হবে বাংলাদেশ পর্যন্ত। তাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

তাই বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যাকে খুব ছোট করে দেখার উপায় নেই। এ সমস্যা সমাধানে চীন ও ভারত এবং জাতিসংঘকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং জামায়াত নামক রাজনৈতিক দুষ্টগ্রহটির গোপন ও যুক্ত তত্পরতা বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমার সরকারের ওপর বিশ্ব জনমতের এমন চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা এ মানবতাবিরোধী অপরাধ করা থেকে বিরত হয়। লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে সম্মত হয়।

এ ছাড়া এ সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। বাংলাদেশ সরকারকে তাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দ্বারা বিশ্বের ছোট-বড় সব রাষ্ট্রের সহায়তায় এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য এগোতে হবে। অন্যথায় ছোট আগুনের ফুলকি থেকে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর