কথায় নয়, এবার কাজেই প্রমাণ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের নির্দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো। অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী কিংবা প্রভাবশালী হলেও ছাড় পাচ্ছেন না। গেল দুই দিনে (সোম ও মঙ্গলবার) রাজধানী ঢাকা ও মাগুরায় পুলিশ-র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহত হয়েছেন। এরা হলেন হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়া এবং মাগুরা পৌর ছাত্রলীগের সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য মেহেদী হাসান আজিবর ওরফে আজিবর শেখ। আরজুর বিরুদ্ধে সোমবার এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ এবং আজিবর শেখের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধসহ এক পথচারীকে খুনের অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে বাড্ডার আলোচিত আওয়ামী লীগের দুই নেতাসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনায় রোববার রাতে স্থানীয় প্রভাবশালী বাড্ডা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ফারুক মিলন ও আওয়ামী লীগ কর্মী নূর মোহাম্মদকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর বাইরে চাঁদপুরে চাঁদা না পেয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করার ঘটনায়ও স্থানীয় যুবলীগ কর্মী মনির, লিটনসহ অন্তত আটজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। দেশের আরও অনেক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী বা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙানো বেশ কয়েকজন অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে খুনোখুনি ও সন্ত্রাসের ব্যাপারে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অপরাধী কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় বা তাদের পক্ষে তদবির না করতে মন্ত্রীদেরও হুশিয়ার করেন। বৈঠকে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে খুনাখুনি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সচিবালয়ে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের কথাটি ফুটে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অপরাধী যে-ই হোক, তাকে ছাড় দেয়া হবে না। মাগুরায় মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধের ঘটনায় জড়িত অজিবর শেখ নিহত হওয়া প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাগুরায় ঘটনাটি অত্যন্ত নৃশংস। ওই ব্যক্তি (অভিযুক্ত) এর আগেও অনেক গোলাগুলি করেছে। তাকে অনেক দিন ধরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজছিল। পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে ধরতে গেলে সে আত্মরক্ষার জন্য পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিহত হয়। বর্তমানে অপরাধ দমনে যা হচ্ছে, সবই আইন মেনে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
হাজারীবাগে ছাত্রলীগ নেতা আরজু নিহত : রাজধানীর হাজারীবাগে মোবাইল চুরির অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে কিশোর রাজাকে হত্যায় জড়িত প্রধান আসামি ছাত্রলীগ নেতা মোঃ আরজু মিয়া র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে হাজারীবাগ বেড়িবাঁধের বাড়ুইবাড়ী এলাকায় মান্নান প্রিন্সিপালের বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। আরজু হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। হাজারীবাগ থানার ওসি মাইনুল ইসলাম বলেন, কিশোর রাজা হত্যার ঘটনায় তার বোন রেশমা বেগমের দায়ের করা মামলায় আরজু ছিলেন প্রধান আসামি। আরজু হাজারীবাগ গণকটুলী এলাকার একটি বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন।
র্যাব-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ রানা বলেন, সোমবার রাতে আরজুকে আটক করার পর ভোর রাতে তাকে নিয়ে বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযানে বের হয় র্যাবের একটি দল। র্যাব সদস্যরা হাজারীবাগের বেড়িবাঁধের কাছে বাড়ুইবাড়ী এলাকায় গেলে আগে থেকে লুকিয়ে থাকা আরজুর সহযোগীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। র্যাবও তখন পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। গোলাগুলির সময় আরজু পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরে সহযোগীরা পালিয়ে গেলে আরজুকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রোববার রাতে আরজুর গণকটুলী লেনের বাসা থেকে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ চুরি হয়। পাশেই গণকটুলী লেনে ৪২ নম্বর বাসায় বাবা বাবুল মিয়ার সঙ্গে থাকতেন রাজা। ওই ফোন-ল্যাপটপ চুরির অভিযোগে আরজু সোমবার সকালে বাসা থেকে কিশোর রাজাকে সন্দেহবশে ধরে নিয়ে যান। এরপর আরজু তার বাসার প্রধান গেট বন্ধ করে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে কিশোর রাজাকে নির্মমভাবে পেটাতে থাকেন। একপর্যায়ে রাজা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে অচেতন অবস্থায় রাজাকে তার বাসায় রেখে যান আরজু। পরে রাজাকে তার স্বজনরা ঢামেক হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রাজার বোন রেশমা বেগম সোমবার রাতে আরজুকে প্রধান আসামি করে ১৩ জনের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারভুক্ত তিন আসামি সাগর, মনির ও সুজনকে ওই রাতেই পুলিশ গ্রেফতার করে। অপর দিকে মূলহোতা ও প্রধান আসামি ছাত্রলীগ নেতা আরজুকে আটক করেছিল র্যাব-২ এর একটি দল। সোমবারের এ ঘটনার পর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে নানা মহলে।
রাজা হত্যায় মনিরুজ্জামান ও সুমন রিমান্ডে : আদালত প্রতিবেদক জানান, কিশোর রাজা হত্যায় গ্রেফতার হওয়া সাগর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। অন্য দুই আসামি মনির ও সুজনকে তিন দিন করে রিমান্ড দেয়া হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যার পর হাজারীবাগের গণকটুলী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানা পুলিশের এসআই অলিভ মাহমুদ মঙ্গলবার তিন আসামিকে আদালতে হাজির করেন। এদের মধ্যে সাগর স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
মাগুরায় ছাত্রলীগ নেতা নিহত : মাগুরা সংবাদদাতা মুসাফির নজরুল জানান, ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের সহিংসতায় মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ এবং একজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তিন নম্বর আসামি মেহেদী হাসান আজিবর ওরফে আজিবর শেখ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। আজিবর বিলুপ্ত মাগুরা পৌর ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। সোমবার রাত ১টার দিকে শহরের দোয়ারপাড় এতিমখানা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে দুইটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। মাগুরার পুলিশ সুপার (এসপি) এ কে এম এহসান উল্লাহ এ খবর নিশ্চিত করেছেন।
এসপি এহসান উল্লাহ জানান, আজিবরসহ একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ দোয়ারপাড় এতিমখানা এলাকায় অবস্থান করছে- এমন খবরের ভিত্তিতে মাগুরা পুলিশের একাধিক টিম তাকে আটক করতে সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। পরে ঘটনাস্থলে আজিবর শেখের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়। অন্য সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুইটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। আগের দিন সন্ধ্যায় (সোমবার) মাগুরা শহরের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল শালিখা উপজেলার সীমাখালী এলাকা থেকে পুলিশের হাতে আজিবর গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু পুলিশ বারবার বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করে আসছিল।
২৩ জুলাই মাগুরায় সরকার সমর্থকদের দুই পক্ষের সংঘর্ষকালে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুসহ মা নাজমা গুলিবিদ্ধ এবং মমিন ভূইয়া নামে একজন নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় বাদী নিহত মমিনের ছেলে রুবেল তার এজাহারে উল্লেখ্য করেছেন, আজিবরের আগ্নেয়াস্ত্রের ছোড়া গুলিতে মমিনের মৃত্যু হয়েছে। এ মামলার প্রধান আসামি জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সেন সুমনকে ২ আগস্ট গ্রেফাতার করা হয়। বর্তমানে তিনি মাগুরা ডিবি পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। এ পর্যন্ত মামলার ৯ আসামি গ্রেফতার হয়েছেন। দুই নম্বর আসামি মোহাম্মদ আলীসহ ছয়জনকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি।