হাওর বার্তা ডেস্কঃ মোবাইল ফোনের ন্যূনতম কলরেট বাড়িয়ে নতুন করে কলরেট নির্ধারণ করতে চায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও অপারেটররা।
এই কাঠামোয় দেশের দুটি বড় অপারেটর লাভবান হবে, সরকারেরও রাজস্ব আয় বাড়বে, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে টেলিটক। মোবাইল ফোন ব্যবহারের খরচ বাড়বে বলে বাড়তি চাপ পড়বে সাধারণ জনগণের ওপর। অবশ্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ কমিশন ও অপারেটরদের যৌথ প্রস্তাবটি ফেরত পাঠিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বলেছে।
মোবাইল ফোনের কলরেট বর্তমানে রয়েছে অননেটে সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা ও অফনেটে সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিটিআরসি সম্প্রতি যে প্রস্তাব ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠায় তাতে অননেট কলরেট মিনিটপ্রতি ন্যূনতম ৩৫ পয়সা ও অফনেট সর্বনিম্ন ৪৫ পয়সা করার কথা বলা হয়।
এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে কমিশন সূত্র বলছে, প্রস্তাবে সর্বোচ্চ কলচার্জ বিদ্যমান দুই টাকার স্থলে কমিয়ে ৬০ পয়সা করা হয়। ২০১২ সালে নির্ধারিত কলরেট বর্তমানে চালু রয়েছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ফেরত পাঠিয়েছে। তারা এটি পুনর্বিবেচনা করতে বলেছে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি।’
কলরেট পুনর্নির্ধারণে কী ধরনের সুফল পাওয়া যেতে পারে এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা অফনেট (এক অপারেটরের নেটওয়ার্ক থেকে অন্য অপারেটরের নেটওয়ার্কে কথা বলা) ও অননেটের (একই নেটওয়ার্কে) মধ্যে কলরেটের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চাই। ’ তাঁর দাবি, এ ক্ষেত্রে তাঁরা গ্রাহকদের স্বার্থও বিবেচনায় রাখছেন।
হিসাব করে দেখা গেছে, ২৫ থেকে ৩৫ পয়সা অননেট ন্যূনতম কলরেট নির্ধারণ করা হলে যে গ্রাহক এখন একই নেটওয়ার্কে কথা বলে বিল দিচ্ছেন ২৫০ টাকা, তা হবে ৩৫০ টাকা। বাড়তি ১০০ টাকার ওপর প্রায় ২০ টাকার বাড়তি চার্জ তো যোগ হবেই।
বর্তমানে প্যাকেজভেদে অননেট কলরেট গ্রামীণফোনে প্রতি ১০ সেকেন্ডে ২১ পয়সা থেকে ২৭ দশমিক ৫ পয়সা, রবির ৭ পয়সা থেকে ২২ পয়সা ও বাংলালিংকের ২২ পয়সা থেকে ২৭ পয়সা। মোবাইল ফোন অপারেটরদের অননেট কলরেট সবচেয়ে কম টেলিটকের। প্রতিষ্ঠানটির সর্বনিম্ন কলরেট মিনিটপ্রতি ৩০ পয়সা (৫ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ডে) ও সর্বোচ্চ ৬০ পয়সা।
অফনেট কলের ক্ষেত্রে প্যাকেজভেদে প্রতি ১০ সেকেন্ডে টেলিটক ১৫ পয়সা, গ্রামীণফোন ২১ পয়সা থেকে ২৭ দশমিক ৫ পয়সা, রবি ১১ পয়সা থেকে ২৩ পয়সা ও বাংলালিংক ১২ পয়সা থেকে ২৯ পয়সা করে চার্জ করছে। এর বাইরে নির্দিষ্টসংখ্যক (এফএনএফ) নম্বরে কল করার ক্ষেত্রে বিশেষ রেট রয়েছে।
সূত্র মতে, বিটিআরসির গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রস্তাবিত কলরেট অনুমোদন পেলে মোবাইল কম্পানিগুলোর আয় যথেষ্ট বাড়বে। জরিপে বেরিয়ে আসে, মোবাইল অপারেটরদের অননেট কলের সংখ্যা প্রতি মাসে ১৮৬৮ দশমিক ৯৪ কোটি মিনিট। এতে অর্থের পরিমাণ ৪৪৬ দশমিক ২৪ কোটি টাকা। এই অননেট কলরেট প্রতি মিনিট ২৫ পয়সা থেকে ৩৫ পয়সা করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে প্রতি মাসে ১৮৬ কোটি টাকা।
আর মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোনের অফনেটে প্রতি মাসে ১৯ কোটি টাকা কমলেও অননেট থেকে আয় বাড়বে প্রতি মাসে ১১২ কোটি টাকা। রবির অফনেটে ২৬ কোটি টাকা আয় কমলেও অননেটে বাড়বে ৪৫ কোটি টাকা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে টেলিটক। তাদের অননেটে আয় যখন এক কোটি টাকা বাড়বে, অফনেটে আয় কমে যাবে পাঁচ কোটি টাকা।
গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায়, নতুন রেট পাস হলে লাভ বেশি হবে বড় কম্পানিগুলোর। বিষয়টি স্বীকার করেন একটি মোবাইল অপারেটরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা। তবে তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের কলরেট সবচেয়ে কম। এই রেট আর না কমিয়ে বরং কিছুটা বাড়ানো দরকার।
একইভাবে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, ‘মোবাইল ফোনের ট্যারিফ বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। আমরা মনে করি, এ ট্যারিফ বরং বাড়ানো উচিত। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। এ ছাড়া ট্যারিফ বাড়লে তার বড় একটি অংশ পাবে সরকারই। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বিটিআরসি এ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে চাইলে আমাদেরও মতামত তাদের নেওয়া উচিত। কিন্তু সম্প্রতি এ বিষয়ে বিটিআরসি আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। ’
২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল কলরেট প্রতি মিনিট সর্বোচ্চ দুই টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বিটিআরসির তৎকালীন পরিচালক (সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস) লে. কর্নেল মো. রকিবুল হাসান স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায়। এ ছাড়া অননেট বা নিজেদের নেটওয়ার্কের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রতি মিনিট ২৫ পয়সা ও অফনেট বা এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আন্ত সংযোগ চার্জ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় প্রতি মিনিট ৪০ পয়সা। এর মধ্যে যে অপারেটরের কল তাদের ৪৫ শতাংশ, যে অপারেটরের কাছে কল যাবে তাদের ৪৫ শতাংশ এবং ইন্টারকানেকশন একচেঞ্জের ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এই ট্রারিফ প্ল্যান কার্যকর করতে বলা হয় ওই বছরের ১ মে থেকে।
সূত্র মতে, বিটিআরসি ২০১০ সালের মার্চে ‘কস্ট মডেলিং, ইন্টারকানেকশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যান্ড ট্যারিফ পলিসি’ শীর্ষক প্রকল্প চালু করে। এর আওতায় নিয়মিত অপারেটরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন তথ্য পর্যবেক্ষণ করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) প্রকল্পটিতে সহায়তা দিয়ে আসছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের কলরেট নতুন করে নির্ধারণের জন্য কয়েক বছর ধরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে আসছে বিটিআরসি। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট বিটিআরসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে মোবাইল অপারেটরদের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়।
বৈঠকে অপারেটরদের ওই বছরের ৩১ আগস্টের মধ্যে এ বিষয়ে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়। ওই সময় অফনেটের ন্যূনতম কলরেট ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয় কমিশন। প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি। এরপর সম্প্রতি ৩৫ পয়সা রেটের প্রস্তাবটি পাঠানো হয়।