হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিশ্ব ফুটবলের আধুনিকতম ব্যাপার হলো পেশাদার ফুটবল। খেলা এখানে বাণিজ্য আর খেলোয়াড়রাই বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। এটা ফুটবল উন্নয়নের আধুনিক ব্যবস্থাপত্রও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালির ফুটবল-জীবনে, এই আধুনিকতা আর বাণিজ্যের পথে হাঁটতে গিয়ে যেন তার দফারফাই হয়ে গেল!
২০০৬ সালে এ দেশে প্রথম রব ওঠে পেশাদার ফুটবলের। ফুটবলের যখন দীনহীন অবস্থা, ঢাকা লিগও যখন অনিয়মিত, তখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন দুঃসাহসী হয়ে চালু করেছিল পেশাদার ফুটবল লিগ। যুক্তি ছিল, এ না হলে ফুটবল এগোবে না। এটা নতুন ব্যাপার, সুবাদে বাঙালির হুজুগে মাতার কথা ছিল। কিন্তু মাতেনি। কেনই-বা মাতবে? সেই ফুটবলার, ক্লাব, বাফুফে সবই তো আগের মতো রয়ে গেছে। গুণগত কোনো বদল হয়নি, কেবল নাম বদলেছে লিগের। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রেখে কি আকর্ষণ বাড়ানো যায়! তাইতো দশম আসরে এসেও নানা সমস্যার মুখে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। বিশেষ করে স্পন্সরদের কাছে তার কোনো আবেদনই তৈরি হয়নি। পেছন ফিরে সেই প্রথম আসর থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দেশের শীর্ষ লিগের কাঙ্ক্ষিত বদল সামান্য, বদলায়নি অনেক কিছু।
২০০৬-০৭ মৌসুমে পেশাদার ফুটবল লিগের চারাগাছটা রোপিত হয়েছিল মার্চে। তখন মাঠের ব্যাপারটা আজকের মতো মুখ্য ছিল না। বৃষ্টিতে এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ধানক্ষেতে রূপ নেওয়ার ছবি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। মাঠে এত খানাখন্দ হয়েছিল যে পাসিং ফুটবল খেলাই অসম্ভব ছিল। প্রিমিয়ার লিগের শুভ মহরত হয়েছিল ‘জাম্বুরা’ ফুটবলে। সেদিন কল্পনা করা যায়নি ঢাকা স্টেডিয়ামই একদিন সবুজ ঘাসের গালিচা হবে। মাঠের এখনকার চেহারাটা অকল্পনীয় রূপ বদলই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একবার পুরো মাটি ফেলে দিয়ে নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি করে মাঠের সংস্কার করেছে। এরপর ২০১১ সালে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচ উপলক্ষে বিশেষ যত্নআত্তি হয়েছিল এই মাঠের। সুবাদে প্রিমিয়ার লিগের ভালো মাঠের আক্ষেপটা ঘুচে গেছে, তার ওপর একটু একটু করে পাসিং ফুটবলের বিকাশ ঘটছে। শিক্ষিত কোচদের হাত ধরে ক্লাবগুলোও পরিকল্পিত ফুটবল খেলার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া পেশাদার হয়েছে আরেকটি জায়গায়—সময়ের ম্যাচ একদম সময়ে শুরু হয়। সংবাদ সম্মেলনে বাফুফের সময়জ্ঞানটা ঠিকঠাক না থাকলেও মাঠের খেলায় অসময়ের চর্চা থেকে সরে এসেছে তারা। আগে আরেকটি অপকর্ম হতো। প্রিমিয়ারে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য এখান-ওখান থেকে দল ধরে নিয়ে আসত। ক্লাবের ঐতিহ্য-সামর্থ্যের চেয়ে ব্যক্তির অর্থের দাপটকেই প্রধান্য দিত। ওই দাপটে বিয়ানীবাজার এফসি, শুকতারার মতো ছন্নছাড়া ক্লাবও খেলে ফেলেছে দেশের শীর্ষ লিগে। সেই অপধারা পাল্টে বাফুফে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ চালু করে প্রিমিয়ারে উত্তরণ-অবনমনের যৌক্তিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
কিন্তু নানা ছুতানাতায় খেলা পেছানোর চিরকালীন বদ অভ্যাস ঝেড়ে ফেলতে পারেনি বাফুফে। এই যেমন অনূর্ধ্ব-২৩ দল এএফসির টুর্নামেন্ট খেলতে যাবে, এর প্রস্তুতির জন্য লিগ পিছিয়ে দিয়েছে এক মাস। বিনিময়ে ফিলিস্তিন থেকে ব্যর্থতার বেদনা নিয়ে ফিরেছে দলটি। যুব দলের বেলায় যখন এই অবস্থা জাতীয় দল তো আরো গুরুত্ব পাবেই। একমাত্র অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশের প্রিমিয়ার লিগ, বাফুফের মর্জিমতোই এটা শুরু এবং মাঝপথে বন্ধও করা যায়। অথচ লিগটাই দেশের ঘরোয়া ফুটবলের প্রতীক, এখানে জন্ম হয় নতুন ফুটবলারের। এই লিগ খেলার জন্য ক্লাবগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে দল গড়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই লিগের কোনো পেশাদারি চরিত্র দাঁড়ায়নি। জন্ম থেকেই হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভেন্যু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে গেলেও ঠিক থিতু হতে পারেনি। গত মৌসুমে পাঁচটি ভেন্যুতে খেলা হলেও এবার আবার দুই ভেন্যুতে এসে ঠেকেছে। ঢাকার বাইরে খেলা হবে শুধু চট্টগ্রামে। বলা হয় ক্লাবগুলো বাইরে যেতে চায় না, কিন্তু বাফুফেও তো পারেনি ক্রীড়া পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার বাইরে আদর্শ ফুটবল ভেন্যু তৈরি করতে। তাই লিগটা হয়ে পড়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক এবং তা শুরুর নির্দিষ্ট সময় বলে কিছু নেই। দশম আসরেও সেই প্রশ্নটা উঠেছে এবং লিগ কমিটির চেয়ারম্যান সালাম মুর্শেদী এটা-সেটা বলে কাটিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা হলো, লিগ কিংবা ফুটবল মৌসুমের জন্য সময় নির্দিষ্টকরণের প্রয়োজন নেই। ফি-বছর কর্মকর্তাদের যখন সময় হবে তখনই মাঠে গড়াবে পেশাদার ফুটবল লিগ। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি যা-ই থাকুক না কেন।
ফুটবল ফেডারেশনের মতো ক্লাবগুলোও উদাসীন পেশাদারির জায়গায়। ক্লাবের ভেতর কোনো ফুটবল অবকাঠামো নেই। কিছু লোক চাঁদা দেয় দল গড়ার জন্য, সেই দল নিয়ে মৌসুম পার করা পর্যন্তই তাদের ফুটবলীয় কর্মকাণ্ড। খেলোয়াড় তৈরির দিকে কোনো মনোযোগ নেই, একটি করে যুব দল রাখার বাধ্যতামূলক নিয়মটাও মানে না তারা। ফুটবলারদের সঙ্গে এককালীন চুক্তি থেকে বেরিয়ে তারা মাসিক বেতনের প্রথা চালু করতে পারেনি। বদলায়নি খেলোয়াড়দের মানসিকতাও। তারা মুখে নিজেদের পেশাদার দাবি করে আবার দলবদলের মৌসুমে দুই-তিন ক্লাব থেকে টাকা নিয়ে বসে থাকে। প্রতি মৌসুমের শুরুতে এ রকম অনেক অভিযোগের দেন-দরবার করতে হয় বাফুফেকে। এরপর তাদের পারফরম্যান্স আর পারিশ্রমিকের গরমিলে শোরগোল ওঠে।
আসলে পেশাদারি ফুটবল জমানার পুরোটাই গরমিলের। পেশাদার হতে পারেনি কেউ-ই, গোঁজামিল দিয়ে যেমন শুরু, এখনো তেমনই চলছে। আর এই পথচলার এগারো বছরে বাংলাদেশের ফুটবলেরও তেমন কোনো শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি। ২০১০ সালে এসএ গেমসে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সোনা জয় ছাড়া সাম্প্রতিককালে কোনো সাফল্য নেই। ’৯৯ সাফ গেমস জয় ও ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা তো অপেশাদার ফুটবলেরই অর্জন।