ঢাকা ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রা কেউ স্কুলে যায় না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:৩২:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ জুলাই ২০১৭
  • ৬২০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ‘আমরা তো বাইদ্যা। পড়াশোনা করমু ক্যান? ইশকুলে যামু ক্যান?’—স্কুলে যাও কি না, এ প্রশ্নের জবাবে বেদে সম্প্রদায়ের বছর আটেকের শিশু রিয়ার এমনই ঝটপট উত্তর। যুবায়ের বয়সে আরেকটু বড়। প্রশ্ন না করলেও পাশ থেকে সে বলে ওঠে, ‘আমরা বচ্ছরের ছয় মাস বাড়িতে থাহি। আর ছয় মাস এহেনে-সেহেনে বহর গারি। আমাগো পড়ালেহা করনের সুযোগ নাই। আর বাইদ্যারা লেহাপড়া করেও না।’

দিন ফুরানোর আগে শেষবারের মতো উজ্জ্বলভাবে আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। লাল-কমলার আভা ছড়ানো সেই আলোয় বসে সম্প্রতি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার হেলিপ্যাড এলাকায় বেদে সম্প্রদায়ের একদল শিশুর সঙ্গে কথা হয়। সেখানেই ওই শিশুরা এসব কথা বলে।

ওই সব শিশুর মধ্যে কয়েকজন রিয়া, মমতাজ, পলি, যুবায়ের, খলিল। বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ওদের কখনো স্কুলে যাওয়া হয়নি। স্কুল যেন ওদের কাছে অপরিচিত জায়গা। শৈশবের চাঞ্চল্যে ভরপুর এসব শিশুর তেমন কোনো স্বপ্ন নেই। ওদের চোখে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন নেই।কাজ থেকে ফিরে রান্না চড়িয়েছেন মা। এ কারণে খেলা ছেড়ে ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে বেদে সম্প্রদায়ের শিশু খলিলকে। ছবি: মুসলিমা জাহান
শিশুদের এই দলের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল মমতাজ। পাতা দিয়ে তৈরি দুটি ফুল নিয়ে মাঠজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সে। একটু থেমে আবার অন্য শিশুর সঙ্গে মেতে উঠছে খুনসুটিতে। তার নাকে নাকফুল, হাতে কচি কলাপাতা রঙের চুড়ি, গলায় পুঁতির মালা। ছয় বছরের মমতাজের মা সকাল বেলাতেই কাজের খোঁজে বেরিয়ে যান। এ কারণে ছোট্ট মমতাজের দিন কাটে ছোট ভাইকে দেখভাল করে। মা এলেই ছুটি। তখন শুধু খেলা আর দুষ্টুমি।

আরেক শিশু খলিলের মা গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিঙা টেনে উপার্জন করেন। কাজ থেকে ফিরে রান্না চড়িয়েছেন মা। এ কারণে ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। ভাই কোলে, এ কারণে সঙ্গীদের সঙ্গে খেলতে না পারায় কিছুটা মন খারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

রিয়া, পলি, যুবায়ের ও বাদলের গল্পও একই রকম। মাস তিনেকের জন্য গত জুনের মাঝামাঝি বিক্রমপুর থেকে গিয়ে গৌরনদীতে আস্তানা গেড়েছে এই বেদে সম্প্রদায়ের বহরটি। মাঠে পলিথিন আর বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি করা নয়টি তাঁবুতে থাকছেন তাঁরা। নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে তাঁরা সংখ্যায় ৪৫ জন। শিশুরা সবাই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। কেউ নিজের নামটিও লিখতে জানে না।

দেশের প্রায় সব বেদেবহরের চিত্র একই রকম। বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যরা সাধারণত লোকজ চিকিৎসা ও ওষুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে সাপের খেলা দেখান। পরিবারের মূল উপার্জনকারী হিসেবে এসব কাজ নারীরাই করেন। আর পুরুষেরা ওষুধ-তাবিজ বিক্রি ও হারানো সোনা-রুপা খুঁজে দেওয়ার কাজ করেন। মাছ শিকার তাঁদের অন্যতম পেশা।বোঝার বয়স থেকেই তারা জেনেছে, বেদেরা পড়ালেখা করে না।
বেদে সম্প্রদায়ের অভিভাবকেরা সন্তানদের লেখাপড়ার শেখানোর গুরুত্বটা এখন বুঝতে পারেন। জানেন, জীবনের চাকা মসৃণভাবে ঘোরাতে এর বিকল্প নেই।

খলিলের মা ছানোয়ারা বেগম বলেন, ‘পড়ালেহা করাইতে পারলে ওগো আমাগো মতো বাইদ্যার কাম করতে হইতো না। কিন্তু প্যাড (পেট) বাঁচাইতে যাইয়া এইডা হয় না।’

বিষয়টি আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন বহরের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী রাহেলা বেগম। তিনি বলেন, ‘বাইদ্যার কামে আমাগো দ্যাশের নানান জায়গায় ঘুইর‍্যা বেড়াইতে হয়। ছয় মাস বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। পোলাপান ইশকুলে দিমু ক্যামনে।’ এই ছয় মাসের আয়ে পুরো বছর চালাতে হয় বলে জানান তিনি।

সন্তানদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করার কষ্ট অভিভাবকদের অন্তর পোড়ায়। তাঁদের কেউ ভাগ্যকেও দোষারোপ করেন, কেউ কেউ দায়ী করেন নিজেদের দারিদ্র্যকে। তবে এসব কষ্ট বেদে সম্প্রদায়ের শিশুদের হয়তো স্পর্শ করে না। কারণ, বোঝার বয়স থেকেই তারা জেনেছে, বেদেরা পড়ালেখা করে না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

রা কেউ স্কুলে যায় না

আপডেট টাইম : ০৭:৩২:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ‘আমরা তো বাইদ্যা। পড়াশোনা করমু ক্যান? ইশকুলে যামু ক্যান?’—স্কুলে যাও কি না, এ প্রশ্নের জবাবে বেদে সম্প্রদায়ের বছর আটেকের শিশু রিয়ার এমনই ঝটপট উত্তর। যুবায়ের বয়সে আরেকটু বড়। প্রশ্ন না করলেও পাশ থেকে সে বলে ওঠে, ‘আমরা বচ্ছরের ছয় মাস বাড়িতে থাহি। আর ছয় মাস এহেনে-সেহেনে বহর গারি। আমাগো পড়ালেহা করনের সুযোগ নাই। আর বাইদ্যারা লেহাপড়া করেও না।’

দিন ফুরানোর আগে শেষবারের মতো উজ্জ্বলভাবে আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। লাল-কমলার আভা ছড়ানো সেই আলোয় বসে সম্প্রতি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার হেলিপ্যাড এলাকায় বেদে সম্প্রদায়ের একদল শিশুর সঙ্গে কথা হয়। সেখানেই ওই শিশুরা এসব কথা বলে।

ওই সব শিশুর মধ্যে কয়েকজন রিয়া, মমতাজ, পলি, যুবায়ের, খলিল। বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ওদের কখনো স্কুলে যাওয়া হয়নি। স্কুল যেন ওদের কাছে অপরিচিত জায়গা। শৈশবের চাঞ্চল্যে ভরপুর এসব শিশুর তেমন কোনো স্বপ্ন নেই। ওদের চোখে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন নেই।কাজ থেকে ফিরে রান্না চড়িয়েছেন মা। এ কারণে খেলা ছেড়ে ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে বেদে সম্প্রদায়ের শিশু খলিলকে। ছবি: মুসলিমা জাহান
শিশুদের এই দলের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল মমতাজ। পাতা দিয়ে তৈরি দুটি ফুল নিয়ে মাঠজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সে। একটু থেমে আবার অন্য শিশুর সঙ্গে মেতে উঠছে খুনসুটিতে। তার নাকে নাকফুল, হাতে কচি কলাপাতা রঙের চুড়ি, গলায় পুঁতির মালা। ছয় বছরের মমতাজের মা সকাল বেলাতেই কাজের খোঁজে বেরিয়ে যান। এ কারণে ছোট্ট মমতাজের দিন কাটে ছোট ভাইকে দেখভাল করে। মা এলেই ছুটি। তখন শুধু খেলা আর দুষ্টুমি।

আরেক শিশু খলিলের মা গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিঙা টেনে উপার্জন করেন। কাজ থেকে ফিরে রান্না চড়িয়েছেন মা। এ কারণে ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। ভাই কোলে, এ কারণে সঙ্গীদের সঙ্গে খেলতে না পারায় কিছুটা মন খারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

রিয়া, পলি, যুবায়ের ও বাদলের গল্পও একই রকম। মাস তিনেকের জন্য গত জুনের মাঝামাঝি বিক্রমপুর থেকে গিয়ে গৌরনদীতে আস্তানা গেড়েছে এই বেদে সম্প্রদায়ের বহরটি। মাঠে পলিথিন আর বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি করা নয়টি তাঁবুতে থাকছেন তাঁরা। নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে তাঁরা সংখ্যায় ৪৫ জন। শিশুরা সবাই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। কেউ নিজের নামটিও লিখতে জানে না।

দেশের প্রায় সব বেদেবহরের চিত্র একই রকম। বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যরা সাধারণত লোকজ চিকিৎসা ও ওষুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে সাপের খেলা দেখান। পরিবারের মূল উপার্জনকারী হিসেবে এসব কাজ নারীরাই করেন। আর পুরুষেরা ওষুধ-তাবিজ বিক্রি ও হারানো সোনা-রুপা খুঁজে দেওয়ার কাজ করেন। মাছ শিকার তাঁদের অন্যতম পেশা।বোঝার বয়স থেকেই তারা জেনেছে, বেদেরা পড়ালেখা করে না।
বেদে সম্প্রদায়ের অভিভাবকেরা সন্তানদের লেখাপড়ার শেখানোর গুরুত্বটা এখন বুঝতে পারেন। জানেন, জীবনের চাকা মসৃণভাবে ঘোরাতে এর বিকল্প নেই।

খলিলের মা ছানোয়ারা বেগম বলেন, ‘পড়ালেহা করাইতে পারলে ওগো আমাগো মতো বাইদ্যার কাম করতে হইতো না। কিন্তু প্যাড (পেট) বাঁচাইতে যাইয়া এইডা হয় না।’

বিষয়টি আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন বহরের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী রাহেলা বেগম। তিনি বলেন, ‘বাইদ্যার কামে আমাগো দ্যাশের নানান জায়গায় ঘুইর‍্যা বেড়াইতে হয়। ছয় মাস বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। পোলাপান ইশকুলে দিমু ক্যামনে।’ এই ছয় মাসের আয়ে পুরো বছর চালাতে হয় বলে জানান তিনি।

সন্তানদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করার কষ্ট অভিভাবকদের অন্তর পোড়ায়। তাঁদের কেউ ভাগ্যকেও দোষারোপ করেন, কেউ কেউ দায়ী করেন নিজেদের দারিদ্র্যকে। তবে এসব কষ্ট বেদে সম্প্রদায়ের শিশুদের হয়তো স্পর্শ করে না। কারণ, বোঝার বয়স থেকেই তারা জেনেছে, বেদেরা পড়ালেখা করে না।