হাওর বার্তা ডেস্কঃ অবৈধ মুদ্রা, হুন্ডি ও মাদক ব্যবসা, অসামাজিক কর্মকাণ্ডসহ অন্ধকার জগতের ডন ছিলেন সালেহ আহমেদ ওরফে কার্লোস। অন্ধকার জগতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বদলে যান। রাতারাতি বনে যান কোটিপতি। দামি দামি গাড়ি হাঁকিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে করতেন। ব্যবহার করতেন জাতীয় সংসদের মনোগ্রামসংবলিত স্টিকার। অঢেল টাকার সুবাদে কার্লোসের বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিতেন শোবিজ জগতের নামিদামি মডেল ও অভিনেত্রীরা। এদের নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতেন। উপভোগ করতেন। গতকাল তদন্তসংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনায় গত শুক্রবার কার্লোসকে পরীবাগের ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে তাকে এক দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছিল। মঙ্গলবার তিনি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি জেলহাজতে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে কার্লোস তার অন্ধকার জগতের নানা চমকপ্রদ তথ্য জানান।
সূত্র বলছে, ঢাকার পরিচিত মহলে তিনি নিজেকে সামুদ্রিক পণ্য ও কোমল পানীয়র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতেন। বিদেশিরা তাকে চেনেন ঢাকার ইয়াবা ডন হিসেবে। কিন্তু এক গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা তার সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। খুবই মর্মান্তিক ও স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তার শেষ রক্ষা হয়নি। ৩০ জুন গ্রেফতার হন কার্লোস। এর পরই বেরিয়ে আসতে শুরু করে অন্ধকার জগতের নানা কাহিনী।
কয়েক দিন আগে রেইন ট্রি হোটেলের আলোচিত ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে নড়েচড়ে ওঠে গোটা মিডিয়াপাড়া। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই ইয়াবা ডন কার্লোসের নতুন অধ্যায় বের হতে শুরু করেছে। রাজধানীর শাহবাগের পরীবাগে ৩/৩এ দিগন্ত টাওয়ারের ৭এম থেকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে ফেলে গৃহকর্মীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তাকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে কার্লোস তার বেপরোয়া জীবনযাপনের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি পুলিশের।
এই কার্লোস ‘অস্তিত্ব’ সিনেমার প্রযোজক ছিলেন। এ ছাড়া তার রঙিন জীবনের তথ্যও বের হতে শুরু করেছে। তার প্রোডাকশন হাউস ‘ড্রিম বক্স’-এর ব্যানারে অস্তিত্ব ছবিটি নির্মিত হয়। জানা যায়, বাংলা সিনেমায় টাকা লগ্নি করার পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সিনেমা বানানোর আড়ালে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও নামকরা অভিনেত্রী থেকে শুরু করে উঠতি মডেলদের নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরতেন।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কার্লোস আরও জানান, এদের মধ্যে আছেন মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া বিপাশা, তানভিয়া জামান মিথিলা এবং আরেকজন বিতর্কিত মডেল পিয়াসা। এর মধ্যে ফ্যাশন হাউস এক্সটেসির মডেল তানভিয়া জামান মিথিলার সঙ্গে তার লিভটুগেদার চলছিল বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম দাবি করে
এ বিষয়ে একটি গণমাধ্যমকে মিথিলা বলেন, ‘আমি তাকে চিনি। একটি ছবিতে অভিনয় করা প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এর বাইরে কিছুই নয়। ’
এসব মডেল-অভিনেত্রীর একান্ত সান্নিধ্য উপভোগ ছাড়াও ব্যাংককের বড় বড় ডিস্কোয় কার্লোস মধ্যমণির আসন দখল করে রাখতেন। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের পর্যটননগরী পাতায়ার রাশিয়ান ক্যাবারে ড্যান্সারদের নাচ দেখে তিনি দুই হাতে ডলারের বান্ডেল ছুড়ে দিতেন। এ ছাড়া ঢাকার গুলশান-১-এ ‘মিরেজ’ নামের একটি সিসা বারে নিয়মিত আড্ডা জমাতেন কার্লোস। নায়িকাদের অনেককে নিয়ে তিনি বিদেশ গিয়েছেন। এদের কয়েকজনের সঙ্গে লিভটুগেদারও করছিলেন।
এদিকে রাজধানীর পরীবাগের ফ্ল্যাটে চিত্রনায়িকা সাবিনা রিমাকে নিয়ে কার্লোস লিভটুগেদার করছিলেন বছরখানেক ধরে। গত শুক্রবার যৌন উত্তেজক ইনজেকশন নিয়ে কার্লোস একই সঙ্গে বাসার গৃহকর্মী ও সাবিনা রিমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। নির্যাতন শেষে গৃহকর্মীকে সাত তলার ছাদে নিয়ে নিচে ফেলে দেন। পুলিশ গুরুতর আহত গৃহকর্মীর সঙ্গে সাবিনা রিমাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। পরে সাবিনা রিমা হাসপাতাল থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান। কার্লোস সব সময় একাধিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন করেন। তার ফ্ল্যাটেও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আছে। একটি রিভলবার ও একটি পিস্তল তিনি সব সময় সঙ্গে রাখেন। এসব অস্ত্র দেখিয়ে মানুষকে ভয় দেখাতেন। কার্লোসের তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। কিন্তু এসব গাড়ির বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে প্রতিটি গাড়িতেই জাতীয় সংসদের মনোগ্রাম ব্যবহার করতেন। গাড়িগুলোর মধ্যে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ, একটি ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ও একটি নিশান পাজেরো জিপ। তিনটি গাড়িই সাদা। এর মধ্যে শনিবার মার্সিডিজ বেঞ্জ জব্দ করেছে র্যাব-৩। বাকি দুটি গাড়ির সন্ধানে অভিযান চলছে।
বিদেশে তিনি কার্লোস নামে পরিচিত। বিদেশিরা তাকে ঢাকার ইয়াবা ডন হিসেবেই চেনেন। অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সময় তিনি এক অস্ট্রেলীয় নারীকে বিয়ে করেন। সেখানে তার এক সন্তানও রয়েছে। কিন্তু মাদকাসক্ত কার্লোস স্ত্রী-সন্তানের ওপর নির্যাতন চালাতেন। পুলিশের কাছে এ-সংক্রান্ত অভিযোগ গেলে অস্ট্রেলীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। একপর্যায়ে ২০১৪ সালে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে বহিষ্কারের পর সিঙ্গাপুরে আস্তানা গাড়েন। সেখানেও এক নারীর সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়ান। পরে ওই নারী জানতে পারেন, কার্লোস মাদক ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। সিঙ্গাপুর সরকারও কার্লোসকে নিষিদ্ধ করে। এরপর দেশে এসে অভিজাত সমাজে চলাফেরা শুরু করেন।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে শাহবাগে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন কার্লোস। সে সময় জাতীয় সংসদের মনোগ্রাম ব্যবহূত একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ জিপ গাড়ি, ইয়াবা, অবৈধ মুদ্রা, মোটা অঙ্কের নগদ টাকা তার কাছ থেকে জব্দ করা হয়। কিন্তু তিনি থামেননি। তার অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলছিল। কার্লোসের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এসব কর্মকর্তার অনেককে তিনি বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যান। সেখানে কার্লোসের টাকায় তারা ফুর্তি করতেন।
এ ছাড়া ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসিদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। প্রতি মাসে তাদের বখশিশ পৌঁছে দিতেন। বিনিময়ে তারাই কার্লোসের ইয়াবা নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখতেন।