জাকির হোসাইনঃ মহানন্দ বিশ্বাস এখন দুপুরে আধপেটা খেয়ে কাটান, রাতে খান পেটভরে। দুপুরে হোটেলে এক থালা ভাত খেতে দাম দিতে হয় ১২ টাকা। আগের চেয়ে প্রতি থালা ভাতের দাম ২ টাকা বেড়েছে, ভাতের পরিমাণও কমেছে। ফলে এখন ভরপেট খেতে গেলে এক বেলায় ভাতের পেছনেই ব্যয় হয় কমপক্ষে ৩৬ টাকা। বিপরীতে রাতে মেসের খাবারের বিল ৫০ টাকা। এ টাকায় মেলে এক পদ তরকারি, এক বাটি ডাল। আর ভাত খাওয়া যায় ইচ্ছেমতো।
মহানন্দ বললেন, রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর সেকশন এলাকায় জুতা সেলাইয়ের কাজ করে দিনে ৪০০ টাকার বেশি আয় হয় না। ফলে দুপুরে ৬০-৭০ টাকা খরচ করে পেটভরে খাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আবার যশোরের শেখহাটিতে থাকা স্ত্রী-সন্তানের জন্য বাড়তি খরচ পাঠাতে হয়। কিন্তু আয় বাড়েনি।
চালের দামে গত কয়েক বছর মহানন্দ বিশ্বাসের মতো মানুষেরা যে স্বস্তিতে ছিলেন, তা চরম অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে গত কয়েক মাসে। বিশ্বের মধ্যে মোটা চালের দাম এখন বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। বেড়েছে সব ধরনের মাঝারি ও সরু চালের দামও। ফলে স্বস্তিতে নেই সীমিত আয়ের মানুষেরা। চার-পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে কেবল চাল কেনার পেছনেই খরচ বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। প্রধান খাদ্যের দাম বাড়ায় রিকশাভাড়া বেড়েছে, কর্মজীবী মানুষকে বাইরে খেতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চাল এখনো খাদ্যতালিকার প্রধান খাদ্য। এর দাম বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষেরা দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ ঠিক রাখতে গিয়ে অন্যান্য খরচ কমিয়ে ফেলেন। অথবা অনেক সময় দেনাও করতে হয়। ফলে চালের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে একটা প্রভাব পড়ে, সেটা কষ্টের। তিনি বলেন, বোরো ধান আসার পরও চালের নাম না কমা একটা আশঙ্কার বিষয়। খাদ্য মজুতও সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এটা যে বড় ধরনের একটি সংকট, সেই উপলব্ধি মাথায় নিয়ে মাঠে নামা জরুরি, যাতে এটা মহাসংকটে পরিণত না হয়।
চালের দামের প্রসঙ্গ উঠতেই চিড়িয়াখানা যাওয়ার সড়কের পাশের চায়ের দোকানি নার্গিস বেগম বললেন, তিনি এক বস্তা চাল কিনেছেন ৪৯ টাকা কেজি দরে। এর আগেরবার একই চাল তিনি ৪২ টাকা দরে কিনেছিলেন।
রাজধানীর খুচরা বাজারে এখন মোটা চাল মানভেদে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫০-৫৪ টাকা ও সরু চাল ৫৬-৫৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় রশিদ, এরফান, মোজাম্মেলসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল। সেগুলো দীর্ঘদিন ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। কয়েক মাসে সেটা বাড়তে বাড়তে এখন ৫৬ টাকায় উঠেছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছর আগে যে মোটা চাল পাওয়া যেত ৩০ টাকা কেজিতে, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। ফলে গত বছরের এ সময়টার তুলনায় এখন মোটা চালের দর ৪২ শতাংশ বেশি।
সরকারের একটি দপ্তরের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার একটি চিত্র দিলেন। তিনি জানালেন, এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাঁর মোট বার্ষিক বেতন বেড়েছে ২ হাজার ৪৬৫ টাকা। এ সময়ের মধ্যে বাসাভাড়া বেড়েছে এক হাজার টাকা, গ্যাসের দাম বেড়েছে ৩০০ টাকা। বাড়িওয়ালা পানির বিল বাড়িয়েছেন ১০০ টাকা। এক-দুই মাস ধরে চালের পেছনে তাঁর অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। চালের দাম বাড়ার কারণে বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসার রিকশা ভাড়া বেড়েছে ৫ টাকা। অর্থাৎ তাঁর একারই যাতায়াত খরচ কেবল এই পথে মাসে বেড়েছে কমপক্ষে ২০০ টাকা। পরিবারের অন্য সদস্যদের যাতায়াত খরচও একইভাবে বেড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে খোঁজ নিয়ে নিয়ে জানা গেছে, নতুন মৌসুমের চালের সরবরাহ বাড়লেও সেখানে দাম কমেনি। কৃষি মার্কেটের আলিফ রাইস এজেন্সির মালিক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দোকানে হাইব্রিড মোটা চাল ৪২ টাকা, মোটা পাইজাম ৪৭ টাকা ও বিআর আটাশ ৪৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, সবাই আশা করেছিল নতুন চাল আসার পর দাম কমবে, কিন্তু বেড়েছে। যেমন পুরোনো মিনিকেট ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল, এখন নতুন মিনিকেট ৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৫ সালে মোটা চালের গড় দাম ছিল মানভেদে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। গেল বছর তা ৩৫ থেকে ৩৭ টাকায় ওঠে। সর্বশেষ মে মাসে গড় দাম ৪৩-৪৫ টাকায় উঠেছে। এখন তা আরও বেশি।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় গ্রিন ইউনিভার্সিটির পাশে মো. রাসেলের খাবার দোকান। নিম্ন আয়ের মানুষেরা সেখানে কম খরচে খেতে পারেন। গত সোমবার খাবারের পদ হিসেবে ছিল ভাত, সবজি ও ডিম। ভাতের প্রতি থালার দাম ১০ টাকা, ডিম ২০ টাকা ও সবজি ২০ টাকা।
জানতে চাইলে রাসেল বলেন, তিনি ৪২ টাকা কেজি দরে যে চাল কিনতেন, সেটি এখন ৫৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এতে ভাতের খরচ বেড়েছে, কিন্তু দাম বাড়াননি। তাহলে বাড়তি খরচ কীভাবে পোষানো হচ্ছে, জানতে চাইলে রাসেল বলেন, তিনি ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন।
শাহবাগে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাত বিক্রি করেন নূরজাহান। জানালেন, রিকশাওয়ালারাই তাঁর প্রধান ক্রেতা। এঁদের ভাতের চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে ভাতের জন্য এখন প্রতিজনকে প্রতি বেলার জন্য অতিরিক্ত ছয় টাকা দিতে হয়। ভাতের দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা এখন ডিমের তরকারির পরিবর্তে শুধু ডিম ভাজি দিয়ে খান।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রিকশাচালকেরা ঢাকায় এসে গ্যারেজে অবস্থান করেন। সেখানে তিন বেলা খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করেন গ্যারেজ পরিচালক। নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসা রিকশাচালক নুরুজ্জামান জানান, আগে একজনের এক দিনের খাওয়ার খরচ ছিল ১০০ টাকা। চালের দাম বাড়ায় এখন সেটা ১১০ টাকা করা হয়েছে।
ভারত থেকে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালে দেশের বাজারে চালের দাম কমে যায়। সে সময় কৃষকের চালের ন্যায্যমূল্যের কথা চিন্তা করে সরকার আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করে। সম্প্রতি দেশীয় বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলেও শুল্ক আগের মতোই থাকছে। অবশ্য বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ভিয়েতনামের এ ব্যাপারে কথাবার্তা এগিয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম বেড়েছে এটা ঠিক। তবে তা কমে আসবে। চাল আমদানি করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে। তবে কবে নাগাদ বাজার স্থিতিশীল হবে, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।
তবে হোসেন জিল্লুর রহমান সরকারি খাদ্য মজুত বাড়ানো, বেসরকারি খাতে মজুতের হালনাগাদ উপাত্ত তৈরি করা, ওএমএস চালু করা ও আগামী আমন মৌসুমে উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন।
২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের মানুষ মাথাপিছু প্রতিদিন ৪১৬ গ্রাম চাল খায়। গ্রামে দৈনিক মাথাপিছু চাল খাওয়ার হার ৪৪১ দশমিক ৬ গ্রাম। অন্যদিকে শহরে এ হার ৩৪৪ দশমিক ২ গ্রাম। মানুষের মাথাপিছু দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের ৬২ শতাংশ আসে চাল থেকে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, দেশে এখন চরম দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।