সবার রাস্তার লাগি

বাগইন গ্রামের আকাশ তখন যেন ভেঙে পড়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি। অবশ্য বৃষ্টি নিয়ে সুমন নামের যুবকের বিশেষ ভাবান্তর নেই। তিনি আপন মনে নদীর পাড়ে মাটি কাটছেন। টুকরি ভরছেন। এরপর মাটিভরা টুকরি মাথায় নিয়ে ফেলছেন পাশের সড়কে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের বাগইন গ্রামের সুমন মিয়া। স্বেচ্ছায় নিজের শ্রম দিয়ে রাস্তা সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। এক দশক ধরে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টি রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার করেছেন সুমন। তাই এলাকায় সুমনের পরিচয় ‘বিনে পয়সার কামলা’ বলে। ভালোবেসেই মানুষ তাঁকে এভাবে ডাকে।
গত ৩১ মে সুমনের দেখা মিলল বটেরখাল নদের পাড়ে। গ্রামের খেয়াঘাট থেকে বাগইন পর্যন্ত দীর্ঘ যে রাস্তা, সেই ভাঙাচোরা সড়কই ঠিক করছেন সুমন। বাগইন গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র সড়ক এটি। সরকারি বরাদ্দের অভাবে সংস্কার হয়নি। এরই মধ্যে রাস্তাটির প্রায় ৪০০ ফুট পুননির্মাণ করেছেন। এক কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের কাজ মাস দু-একের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বলে সুমনের ধারণা।
স্বেচ্ছাশ্রমেই ৬০ রাস্তা
২২ বছর বয়সী সুমন মিয়া বাগইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। ২০০৪ সালে বিদ্যালয়
ছেড়েছেন। এর কয়েক বছর পরই স্বেচ্ছাশ্রমে গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার করার কাজ শুরু করেন। সুমন মিয়ার বয়স যখন ১১ কিংবা ১২, একদিন কোদাল-টুকরি হাতে কাকডাকা ভোরে বাড়ির বাইরে বের হন। ফেরেন সন্ধ্যার পর। এই পুরোটা সময় আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি কেটে ভাঙাচোরা সড়কে ফেলে আপনমনে রাস্তা বানানোর কাজ করেছেন। সেই থেকে শুরু। এলাকার রাস্তাঘাট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্মাণ করায় সুমনকে একাধিকবার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এমনকি এ কাজের বিনিময়ে তিনি কারও বাড়িতে কখনো চা-বিস্কুট পর্যন্তও মুখে দেননি। তিনি বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কিছু মুখে দিয়ে বের হন। এরপর একেবারে রাতে বাড়ি ফিরে ভাত খান।
স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর কাছে থেকে জানা গেল, সুমন মিয়া সুনামগঞ্জের ছাতক ও সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ রাস্তা সংস্কার করেছেন। এর মধ্যে লাকেশ্বর- মঈনপুর, গোবিন্দগঞ্জ-বসস্তপুর, বাগনপুর-সরিষপুর, বাগন-ছৈলা-শাসন, সাতপাড়া-বাংলাবাজার সড়কগুলো উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া এক দশকে তিনি শ্যামনগর, হরিনগর, বিনোদপুর, দোলারবাজার, ছৈলা, শাসন, বাগইন, খল্লা, ভরাটুকা এলাকাসহ তাঁর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৬০টি রাস্তার সংস্কার ও পুননির্মাণ করেছেন।
সুমন মিয়া ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বাসিন্দা। এ ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মিলন ধর বলেন,‘যে কাজ আমাদের জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে হওয়ার কথা, সে কাজ সুমন বিনা পারিশ্রমিকে করে দিচ্ছেন। এলাকাবাসীর দাবি সত্ত্বেও প্রকল্পের অভাবে যে রাস্তা তৈরি করতে পারছি না, হঠাৎ করে দেখি সেই রাস্তা নির্মাণে সুমন হাত দিয়েছেন।’
বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হয়েছিল
সুমনের বাবা মৌরশ আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। মা ছালেকা বেগম গৃহিণী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়। সুমনের বড় ভাই সাবুল আলী বলেন, ‘অভাবের সংসার। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতেই তাঁর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা অনেকটা খরচ হয়ে যায়। আমি দিনমজুর। সুমনকে বারবার বুঝিয়েও কোনো কাজ করাতে পারি না।’
এ কারণে বাড়ি থেকে সুমনকে বেশ কয়েকবার তাড়িয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। পরিবারের সদস্যরা দেখলেন এই কাজ ছাড়া সুমন থাকতে পারবে না।
সুমন বলেন,‘পরিবার দেখছে, এই কাজ ছাড়া আমি থাকতাম পারতাম নায়, তাই আবার বাপ-মায় ঘরে নিছইন।’
তবে সুমনের কাজে সায় আছে শুধু তাঁর বাবার। ছেলের সম্পর্কে গর্ব করে বলেন, ‘আমি দেশের জন্য অস্ত্র ধরেছি আর আমার পুয়া (ছেলে) মাটি কাইট্টা (কেটে) গাও-গেরামের রাস্তা বানাইয়া দিতাছে। মানুষজন আমারে যেমন সম্মান দেয়, আমার পুয়ারেও তেমন সম্মান দেয়। আমি তার লাগি কুনু চিন্তা করি না।’
সুমনের স্বপ্ন কেবল রাস্তা নির্মাণ
যেভাবে রাস্তা বানানোর কাজ সুমন করে যাচ্ছেন, এটাই তাঁর স্বপ্ন। পথ চলতে মানুষের যেন কষ্ট না হয় তাই তিনি রাস্তা নির্মাণ করবেন। সুমন বলেন, ‘আমার মনে চায় আর ভালা লাগে, তাই রাস্তা বানাই। মানুষের যাতায়াতে যেন সুবিধা হয়, আবার অনেক ছাত্রছাত্রী আছে বৃষ্টির দিনে কাদা-পানির লাগি স্কুলে যাইতে পারে না। তাই আগে দেখি, কোন রাস্তাটা মেরামত করা জরুরি, সেইটা ভাইবা কাজে নামি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর