‘ধর্ষক’রা ছাড়া পেলে উল্লাস নৃত্য করবে, কেউ বিচার চাইবে না

গত বছর জঙ্গি আতঙ্কে সমগ্র ঢাকা ছিল জঙ্গিদের নগরী, কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন তা ধর্ষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে । ধর্ষণ এই ঘৃণিত শব্দটির সাথে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে চার তারকা খচিত ‘ রেইনট্রি হোটেল”, পিকাসো রেস্টুরেন্ট , আপন জুয়েলার্স ও ইমেকার্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। জড়িত আছে নগরীর নাম করা স্কুল থেকে পাশ করা নষ্ট সমাজের পথভ্রষ্ট কতিপয় বিভ্রান্ত যুবকের নাম । টাকার দম্ভে যারা উচ্ছৃঙ্খলতার চরমে উঠেছিল।

রিমান্ডে থাকা সাফাত আর সাদমানের স্টেটমেন্ট পড়ছিলাম। সাফাত বলেছে বিভিন্ন হোটেলে নিত্য নতুন নারীসঙ্গ, ড্রিঙ্ক করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার তার জন্য । ২৪ বছর বয়সী একটি ছেলের স্পষ্ট উচ্চারণ। সঙ্গত কারণে অনেকের কাছেই এই স্বীকারোক্তি দাম্ভিক মনে হতে পারে কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। ছেলেটির ভিতর কোনো সামাজিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, দেশপ্রেম, দায়িত্ব এবং কর্তব্যসহ জীবনবোধের সবকটি প্যারামিটার অনুপস্থিত। সে যা শিখেছে তাই করেছে, তাই বলছে। কেবলই টাকার মানদণ্ডে বিকি-কিনি আর নারীসঙ্গ লাভ। সম্মান, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা সবকিছু বলতে সে কেবল টাকাকেই বুঝে। কারণ শিশুকাল থেকেই সে শিখেছে টাকাই সব। টাকা হলে আলু, পটল, নুন, তেলের মতো ভালোবাসাও বাজারে বিকোয়। তাই প্রেম তার কাছে কেবলই নারী শরীর । উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চাভিলাষী, দাম্ভিক সন্তান !

লেখক: খুজিস্তা নূর-ই নাহারিন (মুন্নি)
সাফাতের পিতাও একই সুরে কথা বলেছে দুদিন আগে, ” জোয়ান পোলা এমনতো করবোই, আমিও তো করি কি হইছে তাতে ”। কি অদ্ভুত মানসিকতা, কি দম্ভোক্তি ! যেন টাকা হলেই পুরো পৃথিবীটা তাদের পায়ের তলায়, যা খুশী তাই করার অধিকার রাখে । পিতার কথা শুনে তার পুত্রকে সত্যি সত্যি আমার নিষ্পাপ বলে মনে হয়। বরং মনে মনে বলি আরও অনেক বছর আগে সাবালক হওয়ার আগে থেকেই যে ছেলেটি কোনো নারীকে নষ্ট করেনি সেটাই যথেষ্ট। কারণ আমাদের দেশে টাকা এবং ক্ষমতা পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। কথায় বলে, ”টাকা হলে বাঘের দুধও মিলে” আর এখানে তো কেবল নারী শরীর । তবে অর্থের গরমে এমন অন্যায় যেন বৈধতা না পায়। এই উন্মাষিকতা শুধু তার নিজের সন্তান নয়, আরো বিত্তবানদের সন্তানদেরও ধর্ষণে উৎসাহিত করবে।

সাফাতের মা বেচারির জন্য আমার দুঃখ হয় । বলবান পুরুষেরা যদি অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক হয়, ঘরের বউয়ের অবস্থা তখন বুয়ার থেকে অধিকতর খারাপ থাকে। বুয়া স্বাধীন, যখন খুশী কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে কিন্তু ঘরের বউয়ের কোথাও যাওয়ার জায়গাটাও থাকে না । কারণ সমাজ, পরিবার এবং জীবনের প্রয়োজনে অর্থই সবচেয়ে দামী। তাই লাথি-গুতা খেয়ে হলেও ঘরের এক কোণে বাকহীন পড়ে থাকা। এটাও এক ধরনের অলিখিত চুক্তিনামা। বড় বাড়ি, বড় গাড়ি, নামী-দামী ক্লাব, পার্টি যখন যা চাও তাই পাবে বিনিময়ে কেবল নিজস্বতাকে বিক্রি অর্থাৎ মতামত বলে কোনো কিছু থাকবে না।

এমন চরিত্রহীন স্বামীর সংসার করেছেন হয়তোবা সন্তানদের সুখের কথা ভেবে। জীবনের মাঝপথে এমন ইয়াবা সেবনকারী, মাতাল, নারীলিপ্সু সন্তান তার এতদিনের সমস্ত ধৈর্য, সহনশীলতাকে ব্যর্থতায় পর্যবাসিত করেছে। তাদের এই কঠিন সময়ে তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে বরং ভেঙে পড়েছেন।

অল্প বয়সী নারীরা ফাঁদকে ভালবাসা ভেবে পা রেখে গভীর গর্তে নিপতিত হয়, তারপর কাঁদে। অপমানে কাঁদে, প্রতারণায় কাঁদে, নির্যাতনে কাঁদে। কিন্তু তখন আর করার কিছু থাকে না। অনেকে আবার সহজ উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে অর্থ এবং ক্ষমতাবান লোকদের সঙ্গ পছন্দ করে । ভাবে কোনোনমতে বশ করতে পারলে পুরো জীবনটা আরাম আয়েশে কাটবে কিন্তু তারা জানে না বিত্তবান একজন পুরুষের কাছে প্লাস্টিকের পুতুলের থেকেও সস্তা নারী শরীর। ব্যবহার করা টিস্যু পেপারের মতোই ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হতে হয় অল্প কিছুদিনের ভিতর। কারণ অপেক্ষার দুয়ারে দণ্ডায়মান আছে আরও অনেকে। কিন্তু ফাঁদে ফেলে নারীদের ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, প্রতারণা আর নয়। বরং টাকার দম্ভ পুড়ে ছাই হোক মানুষের ক্ষোভ আর ঘৃণার কাছে ।

তবে এই ঘটনায় সবচেয়ে প্রশংসার দাবী রাখে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং মিডিয়ার লোকজন। কারণ অনেকের চাওয়া সত্ত্বেও মেয়ে দুটোর সত্যিকারের পরিচয় এবং চেহারা, পরিবার এখনো পর্যন্ত অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। গোলাপি ওড়না মাথায় দিয়ে চশমা পড়া যে মেয়েটি, অন্য স্বাভাবিক পোশাকে তাকে চেনা সম্ভব নয়। অন্যান্য বার ধর্ষিতার ছবিতে তোলপাড় হয়, এবার ধর্ষকদের ছবি নিয়ে হচ্ছে।

অনেকে এমনকি ধর্ষকের পরিবার মেয়ে দুজনকে খারাপ মেয়ে বলতে চাইছে কিন্তু তারা নিজেদের ছেলেদের খারাপ কিছু তাদের চোখে পড়ছে না । একটাই কারণ ” অর্থ”। ” অর্থ অনর্থের মূল” বনানীর রেইনট্রির এই ঘটনা যেন তারই সাক্ষ্য বহন করে। পয়সার কাছে সব জায়েজ, সবাই নতজানু !

মেয়ে দুটির পরিচয় শেষ পর্যন্ত গোপন রাখা গেলে ভবিষ্যতে আরও অনেক ধর্ষণের অজানা বীভৎস কাহিনী সবার সামনে আসবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোক লজ্জা , পারিবারিক জীবন এবং সমাজের ভয়ে এসব কাহিনী অপ্রকাশিতই রয়ে যায় ।

আর বরাবরের মতোই যদি ধর্ষকরা সহজ শর্তে ছাড়া পেয়ে যায় তবে নির্যাতিত আর কোনো নারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ন্যায় বিচারের জন্য আসবে না। অন্যায় অত্যাচার, জোড়-জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে না , সর্বাংসহা নারী প্রয়োজনে আত্মহুতি দিবে কিন্তু বিচার চাইতে আসবে না আর কোনদিন । চোখ, কান বন্ধ করে আমরাও জানবো আমাদের দেশে কোনো ধর্ষণ বা নির্যাতন হয় না । কারণ টাকার কাছে মানুষ বড় অসহায় ও দুর্বল!

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর