মিরপুর থেকে প্রতিদিনই বাসে অফিসে আসেন অধরা মল্লিক। চলতি পথে একটু আধটু স্পর্শ-ধাক্কা উপেক্ষা করেই চলেন। একদিন বাসে সিটের পাশ দিয়ে বার বার তার পিঠ স্পর্শ করার চেষ্টার বিষয়টি টের পেয়ে নিজের জুতা খুলে পেটাতে শুরু করেন লোকটিকে। এ ঘটনায় কেউ কেউ তার পক্ষ নিলেও অনেকে না পিটিয়ে পুলিশে অভিযোগ করার কথা বললে অধরার দুঃখটা বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে অধরার কাছে জানতে চাইলে বিরক্তির সুরে তিনি বলেন, ‘পুলিশে অভিযোগ করতে যাই আর আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার হোক। এমন অভিযোগ নিয়ে গেলেতো বলবে দেখছেন মেয়েরা কেমন বেড়েছে, এমন বিষয় নিয়ে থানায় আসে অভিযোগ করতে। আরে বাবা চুপচাপ চেপে যান।’
এমন অনেক কারণে হয়রানির শিকার হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যান না নারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, সমাজ এখনও এমন অবস্থায় আসতে পারেনি যে নারী নিজের অভিযোগ পুলিশের কাছে করতে পারেন। তবে অবস্থা কিছুটা হলেও পরিবর্তন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, ৭২.৭ শতাংশ নারী পরিবারের মধ্যে স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এদের মধ্যে শুধু ১.১ শতাংশ নারী পুলিশের কাছে যান। স্থানীয় নেতাদের কাছে যান ২ দশমিক এক শতাংশ।
একশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয়ে নারী’ শীর্ষক নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানির বিষয়ে অপর এক গবেষণা রিপোর্ট (২০১৬) থেকে জানা যায়, শহরের ৯৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকে সহিংসতা মনে করেন। তারা মনে করেন, পুলিশের সাহায্য চাইলে সমস্যা বাড়ে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৮১ শতাংশ মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে সহায়তার জন্য যেতে চান না।
এদিকে এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত রাজধানীর তেজগাঁও থানার অভিযোগপত্রের নথি থেকে দেখা যায়, মোট ২৮টি মামলা হয়েছে এ সময়ে। এর মধ্যে একটি মামলা করেন টঙ্গীবাসী এক নারী তার বোনকে আত্মহত্যায় প্ররোচনাদানের অভিযোগে। আর গত মার্চ মাসে একই থানায় ৫৪টি মামলার মধ্যে একটি মামলা করেন কাওরান বাজারের এক নারী তার ব্যাগ হারিয়ে যাওয়ার জন্য। সূত্রাপুর আর কোতোয়ালি থানা ঘুরে এমনই চিত্র দেখা যায়।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, নারীরা আইডি কার্ড ও শিক্ষাগত সনদ হারানোর জন্য জিডি করে থাকেন। অথচ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান মতে, গত এপ্রিল মাসে ৮৫টি ধর্ষণ এবং বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ৩৫টি ঘটনাসহ মোট ৪১৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটলেও মামলা কম হয় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, নগরের ৮৪ শতাংশের বেশি নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েও প্রতিকার চাইতে সাহস পান না। এটা যেমন সামাজিক তেমন প্রশাসনিক কারণে হয়। এর সঙ্গে পুলিশের সহযোগিতার অভাব জড়িত।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের আরবান প্রোগ্রামের বস্তির কিশোরীদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, নির্যাতনের শিকার হলেও ‘কিশোরীরাই খারাপ’ এমন মন্তব্যের ভয়ে তারা বিষয়টি চেপে যায়। আরবান প্রোগ্রামের প্রধান ফারহানা আফরোজ বলেন, পরিবারের সমর্থন না থাকা, আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা, বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনীহা, কোর্ট ও পুলিশ স্টেশনের পরিবেশ নারীবান্ধব না থাকার জন্য নারীরা পুলিশের দ্বারস্থ হন না।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় এক ধরনের ধারণা থেকে পুলিশের কাছে নারীরা অভিযোগ করেন না বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কোনো ধরনের অপরাধের শিকার হলে নারীর পক্ষে পরিবারের কোনো পুরুষ অভিযোগ করেন। তবে এই ধারণা ভাঙার চেষ্টা করছি আমরা। এখন নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে।
নারীর অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি সহজ করার জন্য সরকার হেলপ লাইন চালু করেছে বলে মন্তব্য করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি বলেন, নারীর নিরাপত্তায় পুলিশের আন্তরিকতার প্রশ্ন উঠলে তার মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানায় এবং নারীবান্ধবভাবে কাজ করার সুপারিশ করে। তিনি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ও ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কথা উল্লেখ করেন।