ঢাকা ০৯:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২৫, ২০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অভিমান নিয়েও অপেক্ষায় নোমান সবসময়ই তেজী মহিউদ্দিন চৌধুরী

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫০:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭
  • ২৫২ বার

আবদুল্লাহ আল নোমান। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত ‘মামা-ভাগিনা’ রাজনীতিবিদ। রাজনীতির মাঠে পাকা খেলোয়ার। একে অন্যের ভাল বন্ধুও বটে। তবে রাজনীতিতে দুই জনের দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান। একজন বিএনপির, আরেকজন আওয়ামী লীগের। তা সত্তে¡ও একে অপরকে কখনও ঘাটান না। নিজ দলে কেউ কেউ তা বাঁকা দৃষ্টিতে ‘আঁতাত’ হিসেবে দেখতে চান। তবে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সহাবস্থান ও স¤প্রীতির যতটুকু ‘সৌন্দর্য’ আর ‘সামাজিক বন্ধন’ অটুট আছে তা বিকাশিত করেছেন নোমান-মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ কারণে অনেক রাজনীতিবিদের ভিড়ে তারা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছেন। ফলে দু’জনই সমানে জনপ্রিয়। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী নোমান। আর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ১৭ বছর ধরে সাবেক নির্বাচিত সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। বয়সের ভার অনেক বেড়েছে। তবে তারা কেউই চাটগাঁ এমনকি জাতীয় রাজনীতিতে এখনও ‘অতীত’ হয়ে যাননি। রাজনীতি নিয়ে কোথাও কথামালা, গল্প-আড্ডা, গুঞ্জন হলে তারা উভয়েই অতীত ও বর্তমানে সর্বস্তরের চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে আলোচনায় উঠে আসেন। এরশাদ বিরোধী জোটবদ্ধ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে নিউমার্কেট চত্বরের রাজপথে তারা একত্রে কাটিয়েছেন। সুদীর্ঘ রাজনীতিতে রয়েছে ত্যাগ, শ্রম-ঘাম। রাজনীতির পাশাপাশি চট্টগ্রামের স্বার্থ রক্ষার জন্য উভয়ে দরদী। আশির দশকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের অন্যতম রূপকার নোমান। অন্যদিকে উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার থাকার পাশাপশি চট্টগ্রাম বন্দরে এএসএ (স্টিভিডোরিং সার্ভিসেস অব আমেরিকার)-এর বন্দর স্থাপনের বিরুদ্ধে নিজের সরকারের আমলেই কঠোর কঠিন আন্দোলন করে সফলতা আনেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টলবীর তার উপাধি।
অবশ্য কোনো কোনো সময় বিভিন্ন কারণে দলের ভেতরে-বাইরে সমালোচনাও বয়ে বেড়াতে হয়েছে নোমান-মহিউদ্দিনকে। বিশেষ করে নিজ নিজ দলে সিনিয়র হয়েও জুনিয়র এমনকি এককালে ওস্তাদ হয়ে পরবর্তীতে শিষ্যতূল্য নেতাদের সাথে বিরোধ ও গ্রুপিং এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে বিভক্তি, আন্তঃকোন্দল, হানাহানি তৈরির ব্যাপারেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠে। তবে নিজেদের রাজনীতির জগৎ ছাপিয়ে চট্টগ্রামে তাদের সামাজিকতার জগৎ আরও অনেক ব্যাপক ও গভীর। ছোট-বড় ধনী-গরিব যে কোনো মানুষকে কাছে টানার জাদুকরি ক্ষমতা আছে দু’জনার। বিয়ে-শাদি মেজবানে দাওয়াত পেলেই ছুটে যান। মৃত্যু সংবাদ পেলে নামাজে জানাজায় হাজির হন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে অগণিত নিহত মানুষের লাশ নিজ হাতে দাফন-কাফন দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। আবার তখন মন্ত্রী নোমান কক্সবাজারে ছুটে গিয়ে দূর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিয়েছেন রিলিফ বিলিয়েছেন দিনে-রাতে। এসবের প্রেক্ষিতে তাদের পপুলারিটি ব্যবহারের এমন নজিরও দেখা গেছে, স্টেডিয়াম পাড়ায় কোনো রেস্তোঁরায় কাস্টমার আকর্ষণের জন্য নোমান-মহিউদ্দিনের পাশাপাশি ছবি দেয়ালে টানানো হয়! ‘সবমিলে ওল্ড ইজ গোল্ড’, কিংবা ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’- এই আপ্ত প্রবাদ বাক্যটা নোমান আর মহিউদ্দিনের বেলায় খাপে খাপ খেয়ে যায়।
‘মউ-ভাইনা’ (মামা-ভাগিনা) আবদুল্লাহ আল নোমান এবং এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে গতকাল (সোমবার) আলাদাভাবে কথা হয় । আবদুল্লাহ আল নোমান বললেন, ‘বিএনপির সেই শিশুকাল থেকে চট্টগ্রামে দলকে গড়ে তুলেছি। সুসংগঠিত করেছি। কর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছি। চট্টগ্রামের উন্নয়ন আন্দোলনে মাঠে নেমেছি। দলীয় কর্মীরা তো বটেই, দলের গন্ডির বাইরেও ভিন্ন আদর্শের দল অথবা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে বিপুল ভালবাসা পেয়েছি এটাই আমার জীবনের পরম পাওয়া’। মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, ‘জনগণের স্বার্থ রক্ষায় আজীবন আন্দোলন সংগ্রামের জন্য সবসময়ই আমি প্রস্তুত। কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারিনা। চট্টগ্রামকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে চাই। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে আমি আপোসহীন’।
রাজনীতির কী হালচাল-
নোমান-মহিউদ্দিনের রাজনীতির হালচাল সম্পর্কে মানুষ জানতে চায়। বিশেষত বন্দরনগরীসহ সমগ্র বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজনীতি সচেতন মানুষ এই দুই নেতার গতি-প্রকৃতি কী তা দিয়ে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের হালঅবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। সেই অর্থে তারা দু’জন হলেন চট্টগ্রামে দুই বড় দলের ‘ব্রান্ড অ্যাম্বেসেডর’। আবদুল্লাহ আল নোমান বিগত আগস্ট’ ১৬ ইং বিএনপির পুনঃগঠিত কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটি ঠাঁই পাননি। তিনি এবং তার দলীয় সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি, কিন্তু পূরণ হয়নি। এ নিয়ে চট্টগ্রামে দলের সভা-সমাবেশে ক্ষোভ-অসন্তোষ, হতাশা প্রকাশ পায়। মহানগরে তার সমর্থকরা দল থেকে ‘গণপদত্যাগে’রও হুমকি দেন। এতকিছুর পরও তিনি রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। আরও নতুন স্থায়ী কমিটির সদস্যের পদ খালি থাকায় নোমান আশা ছাড়েননি। বরং নতুন করে ‘বিবেচনা’ হলে পুরস্কারও পেতে পারেন এরজন্য অপেক্ষা করছেন। গতবারে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে নিজের যোগ্যতা, ত্যাগ ও মেধা বিবেচনায় স্থান পান চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেই সাথে নোমানকেও স্থায়ী কমিটিতে প্রত্যাশী দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থকদের দাবি হচ্ছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় আনার। তাছাড়া অতীতে চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে অন্তত ২ জন নেতা অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
তবে আবদুল্লাহ আল নোমান দলের হাইকমান্ডের প্রতি অভিমানে অশেষ অভিমানে ‘নীল’ হয়ে আছেন। তার কাছে জানতে চাই কীসের অভিমানে তিনি গত বেশ কয়েক মাস ধরে নামের আগে কেন্দ্রীয় ‘ভাইস চেয়ারম্যান’ পদবী ব্যবহার করছেন না এবং তার সমর্থকরাও সেটি অনুসরণ করছেন। পরিচয় দিচ্ছেন ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী’ হিসেবে। জবাবে জানালেন, আমি তো আগেই বলেছি সেই পদবী নিয়ে আমি মোটেও আর আগ্রহী না। তবে দলের শিশু অবস্থাটা থেকেই আছি, চট্টগ্রামে দলকে ভাল অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। অতীতে সংসদ নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ বহন করে। তবে কী নিষ্ক্রীয় রয়েছেন? প্রশ্নের জবাবে বললেন, কই না তো। আমি তো এখন এই মুহূর্তেও (গতকাল) দলীয় কাজেই সক্রিয় আছি, জামালপুরে দলের কর্মসূচি নিয়ে যাওয়ার পথে আছি।
অন্যদিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের সীমা ছাড়িয়ে সারাদেশে আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ফারাক থাকলেও রাজনীতির মাঠে ময়দানে তিনি এখনও বেশ তেজী অবস্থানে রয়েছেন। গতবারের চসিক নির্বাচনে মেয়রে পদে পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমনটি প্রত্যাশার উঁচুতে থেকেও তা পাননি। গুঞ্জন থাকলেও মন্ত্রিত্ব ভাগ্যে জোটেনি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনও ঠাঁই হয়নি। তার কাছে জানতে চাই আজ প্রবীণ রাজনীতিবিদের কাতারে দাঁড়িয়ে দলের কাছ থেকে অতীত অবদানের উপযুক্ত মূল্যায়ন পেয়েছেন কিনা। জবাবে বলেন, ‘আমি মূল্যায়ন চাই না। সবসময়ই চট্টগ্রামবাসীর সাথেই থাকতে চাই। আমার কোন মিল-ফ্যাক্টরি নেই। কিন্তু জনগণ আছেন। তারাই আমার বড় শক্তি ও প্রেরণার উৎস’। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা সকলেই একথা জানি, চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশকে অনেক কিছুই দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর বিনিময়ে চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে যেভাবে সুসমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল তা এখনও হয়নি। উন্নত হলেই চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতিতে আরও অনেক ব্যাপক অবদান রাখতে অবশ্যই সক্ষম হবে।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে নিজ দলের কোনো কোনো নেতা-মন্ত্রী-এমপির মধ্যে বিরোধ হয়েছে অতীত-বর্তমানে বিভিন্ন সময়েই। কারো সাথে মিটেছে আবার কারো সাথে সম্পর্ক শীতল এমনকি মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। আবার নিজেই এগিয়ে এসে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতেও কার্পণ্য দেখান না। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি দলের নগর সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় আক্রমণ ও অভিযোগ করেন। লালদীঘির ‘গরম বক্তৃতা’র সমাবেশ পর্যন্ত তা গড়ায়। কিন্তু কিছুদিন আগেই পর পর দু’টি সমাবেশে ‘নাছির ভাই, এইক্কা আইয়ুন (নাছির ভাই এদিকে আসেন)’ বলে তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে কাছে টেনে কোলাকুলি করেন। মেয়রকে নিজের বাড়িতে আপ্যায়িত করান। তার এ ধরনের উদার মনোভাবের জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চট্টগ্রাম সফরকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ‘চট্টগ্রামের নেতাদের মুরব্বী, আমারও মুরব্বী’ বলে তাকে সম্মান দেখিয়ে গেছেন। চাটগাঁর রাজনীতির অন্দরমহলে এহেন ‘সৌন্দর্য’ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

অভিমান নিয়েও অপেক্ষায় নোমান সবসময়ই তেজী মহিউদ্দিন চৌধুরী

আপডেট টাইম : ১২:৫০:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭

আবদুল্লাহ আল নোমান। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত ‘মামা-ভাগিনা’ রাজনীতিবিদ। রাজনীতির মাঠে পাকা খেলোয়ার। একে অন্যের ভাল বন্ধুও বটে। তবে রাজনীতিতে দুই জনের দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান। একজন বিএনপির, আরেকজন আওয়ামী লীগের। তা সত্তে¡ও একে অপরকে কখনও ঘাটান না। নিজ দলে কেউ কেউ তা বাঁকা দৃষ্টিতে ‘আঁতাত’ হিসেবে দেখতে চান। তবে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সহাবস্থান ও স¤প্রীতির যতটুকু ‘সৌন্দর্য’ আর ‘সামাজিক বন্ধন’ অটুট আছে তা বিকাশিত করেছেন নোমান-মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ কারণে অনেক রাজনীতিবিদের ভিড়ে তারা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছেন। ফলে দু’জনই সমানে জনপ্রিয়। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী নোমান। আর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ১৭ বছর ধরে সাবেক নির্বাচিত সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। বয়সের ভার অনেক বেড়েছে। তবে তারা কেউই চাটগাঁ এমনকি জাতীয় রাজনীতিতে এখনও ‘অতীত’ হয়ে যাননি। রাজনীতি নিয়ে কোথাও কথামালা, গল্প-আড্ডা, গুঞ্জন হলে তারা উভয়েই অতীত ও বর্তমানে সর্বস্তরের চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে আলোচনায় উঠে আসেন। এরশাদ বিরোধী জোটবদ্ধ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে নিউমার্কেট চত্বরের রাজপথে তারা একত্রে কাটিয়েছেন। সুদীর্ঘ রাজনীতিতে রয়েছে ত্যাগ, শ্রম-ঘাম। রাজনীতির পাশাপাশি চট্টগ্রামের স্বার্থ রক্ষার জন্য উভয়ে দরদী। আশির দশকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের অন্যতম রূপকার নোমান। অন্যদিকে উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার থাকার পাশাপশি চট্টগ্রাম বন্দরে এএসএ (স্টিভিডোরিং সার্ভিসেস অব আমেরিকার)-এর বন্দর স্থাপনের বিরুদ্ধে নিজের সরকারের আমলেই কঠোর কঠিন আন্দোলন করে সফলতা আনেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টলবীর তার উপাধি।
অবশ্য কোনো কোনো সময় বিভিন্ন কারণে দলের ভেতরে-বাইরে সমালোচনাও বয়ে বেড়াতে হয়েছে নোমান-মহিউদ্দিনকে। বিশেষ করে নিজ নিজ দলে সিনিয়র হয়েও জুনিয়র এমনকি এককালে ওস্তাদ হয়ে পরবর্তীতে শিষ্যতূল্য নেতাদের সাথে বিরোধ ও গ্রুপিং এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে বিভক্তি, আন্তঃকোন্দল, হানাহানি তৈরির ব্যাপারেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠে। তবে নিজেদের রাজনীতির জগৎ ছাপিয়ে চট্টগ্রামে তাদের সামাজিকতার জগৎ আরও অনেক ব্যাপক ও গভীর। ছোট-বড় ধনী-গরিব যে কোনো মানুষকে কাছে টানার জাদুকরি ক্ষমতা আছে দু’জনার। বিয়ে-শাদি মেজবানে দাওয়াত পেলেই ছুটে যান। মৃত্যু সংবাদ পেলে নামাজে জানাজায় হাজির হন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে অগণিত নিহত মানুষের লাশ নিজ হাতে দাফন-কাফন দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। আবার তখন মন্ত্রী নোমান কক্সবাজারে ছুটে গিয়ে দূর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিয়েছেন রিলিফ বিলিয়েছেন দিনে-রাতে। এসবের প্রেক্ষিতে তাদের পপুলারিটি ব্যবহারের এমন নজিরও দেখা গেছে, স্টেডিয়াম পাড়ায় কোনো রেস্তোঁরায় কাস্টমার আকর্ষণের জন্য নোমান-মহিউদ্দিনের পাশাপাশি ছবি দেয়ালে টানানো হয়! ‘সবমিলে ওল্ড ইজ গোল্ড’, কিংবা ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’- এই আপ্ত প্রবাদ বাক্যটা নোমান আর মহিউদ্দিনের বেলায় খাপে খাপ খেয়ে যায়।
‘মউ-ভাইনা’ (মামা-ভাগিনা) আবদুল্লাহ আল নোমান এবং এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে গতকাল (সোমবার) আলাদাভাবে কথা হয় । আবদুল্লাহ আল নোমান বললেন, ‘বিএনপির সেই শিশুকাল থেকে চট্টগ্রামে দলকে গড়ে তুলেছি। সুসংগঠিত করেছি। কর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছি। চট্টগ্রামের উন্নয়ন আন্দোলনে মাঠে নেমেছি। দলীয় কর্মীরা তো বটেই, দলের গন্ডির বাইরেও ভিন্ন আদর্শের দল অথবা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে বিপুল ভালবাসা পেয়েছি এটাই আমার জীবনের পরম পাওয়া’। মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, ‘জনগণের স্বার্থ রক্ষায় আজীবন আন্দোলন সংগ্রামের জন্য সবসময়ই আমি প্রস্তুত। কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারিনা। চট্টগ্রামকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে চাই। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে আমি আপোসহীন’।
রাজনীতির কী হালচাল-
নোমান-মহিউদ্দিনের রাজনীতির হালচাল সম্পর্কে মানুষ জানতে চায়। বিশেষত বন্দরনগরীসহ সমগ্র বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজনীতি সচেতন মানুষ এই দুই নেতার গতি-প্রকৃতি কী তা দিয়ে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের হালঅবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। সেই অর্থে তারা দু’জন হলেন চট্টগ্রামে দুই বড় দলের ‘ব্রান্ড অ্যাম্বেসেডর’। আবদুল্লাহ আল নোমান বিগত আগস্ট’ ১৬ ইং বিএনপির পুনঃগঠিত কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটি ঠাঁই পাননি। তিনি এবং তার দলীয় সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি, কিন্তু পূরণ হয়নি। এ নিয়ে চট্টগ্রামে দলের সভা-সমাবেশে ক্ষোভ-অসন্তোষ, হতাশা প্রকাশ পায়। মহানগরে তার সমর্থকরা দল থেকে ‘গণপদত্যাগে’রও হুমকি দেন। এতকিছুর পরও তিনি রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। আরও নতুন স্থায়ী কমিটির সদস্যের পদ খালি থাকায় নোমান আশা ছাড়েননি। বরং নতুন করে ‘বিবেচনা’ হলে পুরস্কারও পেতে পারেন এরজন্য অপেক্ষা করছেন। গতবারে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে নিজের যোগ্যতা, ত্যাগ ও মেধা বিবেচনায় স্থান পান চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেই সাথে নোমানকেও স্থায়ী কমিটিতে প্রত্যাশী দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থকদের দাবি হচ্ছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় আনার। তাছাড়া অতীতে চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে অন্তত ২ জন নেতা অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
তবে আবদুল্লাহ আল নোমান দলের হাইকমান্ডের প্রতি অভিমানে অশেষ অভিমানে ‘নীল’ হয়ে আছেন। তার কাছে জানতে চাই কীসের অভিমানে তিনি গত বেশ কয়েক মাস ধরে নামের আগে কেন্দ্রীয় ‘ভাইস চেয়ারম্যান’ পদবী ব্যবহার করছেন না এবং তার সমর্থকরাও সেটি অনুসরণ করছেন। পরিচয় দিচ্ছেন ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী’ হিসেবে। জবাবে জানালেন, আমি তো আগেই বলেছি সেই পদবী নিয়ে আমি মোটেও আর আগ্রহী না। তবে দলের শিশু অবস্থাটা থেকেই আছি, চট্টগ্রামে দলকে ভাল অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। অতীতে সংসদ নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ বহন করে। তবে কী নিষ্ক্রীয় রয়েছেন? প্রশ্নের জবাবে বললেন, কই না তো। আমি তো এখন এই মুহূর্তেও (গতকাল) দলীয় কাজেই সক্রিয় আছি, জামালপুরে দলের কর্মসূচি নিয়ে যাওয়ার পথে আছি।
অন্যদিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের সীমা ছাড়িয়ে সারাদেশে আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ফারাক থাকলেও রাজনীতির মাঠে ময়দানে তিনি এখনও বেশ তেজী অবস্থানে রয়েছেন। গতবারের চসিক নির্বাচনে মেয়রে পদে পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমনটি প্রত্যাশার উঁচুতে থেকেও তা পাননি। গুঞ্জন থাকলেও মন্ত্রিত্ব ভাগ্যে জোটেনি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনও ঠাঁই হয়নি। তার কাছে জানতে চাই আজ প্রবীণ রাজনীতিবিদের কাতারে দাঁড়িয়ে দলের কাছ থেকে অতীত অবদানের উপযুক্ত মূল্যায়ন পেয়েছেন কিনা। জবাবে বলেন, ‘আমি মূল্যায়ন চাই না। সবসময়ই চট্টগ্রামবাসীর সাথেই থাকতে চাই। আমার কোন মিল-ফ্যাক্টরি নেই। কিন্তু জনগণ আছেন। তারাই আমার বড় শক্তি ও প্রেরণার উৎস’। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা সকলেই একথা জানি, চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশকে অনেক কিছুই দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর বিনিময়ে চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে যেভাবে সুসমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল তা এখনও হয়নি। উন্নত হলেই চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতিতে আরও অনেক ব্যাপক অবদান রাখতে অবশ্যই সক্ষম হবে।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে নিজ দলের কোনো কোনো নেতা-মন্ত্রী-এমপির মধ্যে বিরোধ হয়েছে অতীত-বর্তমানে বিভিন্ন সময়েই। কারো সাথে মিটেছে আবার কারো সাথে সম্পর্ক শীতল এমনকি মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। আবার নিজেই এগিয়ে এসে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতেও কার্পণ্য দেখান না। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি দলের নগর সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় আক্রমণ ও অভিযোগ করেন। লালদীঘির ‘গরম বক্তৃতা’র সমাবেশ পর্যন্ত তা গড়ায়। কিন্তু কিছুদিন আগেই পর পর দু’টি সমাবেশে ‘নাছির ভাই, এইক্কা আইয়ুন (নাছির ভাই এদিকে আসেন)’ বলে তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে কাছে টেনে কোলাকুলি করেন। মেয়রকে নিজের বাড়িতে আপ্যায়িত করান। তার এ ধরনের উদার মনোভাবের জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চট্টগ্রাম সফরকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ‘চট্টগ্রামের নেতাদের মুরব্বী, আমারও মুরব্বী’ বলে তাকে সম্মান দেখিয়ে গেছেন। চাটগাঁর রাজনীতির অন্দরমহলে এহেন ‘সৌন্দর্য’ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।