ঢাকা ০৮:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কামলা নাই, হামার ধান হামি কাটছি একনা করে কামলার দাম ৬০০ টাকা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩২:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭
  • ২৮৩ বার

“এক নাগাড়ে ঝড়ি (বৃষ্টি) হয়া ধান মাটিত শুতে গেছে। আধা পাকা ধান কাটলেও সমস্যা না কাটলেও সমস্যা। কামলাও নাই। অটো রিকশা হয়া মানুষ আর ধান কাটপের আসে না। অটোর ডাইবারী করে। উপায় না পায়া নিজের ধান নিজেই কাটা শুরু করছি। একনা করে কামলার দাম ৬০০ টাকা। ভিওত (জমিতে) পানি থাকলে ৭০০ টাকা নেয়।” উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে ঘুরে ধান কাটা মাড়াইয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে একথাগুলো বলেন, বগুড়া সদর উপজেলার মানিকদাইড় গ্রামের ধানচাষি মণ্টু মিয়া।
উত্তর জনপদের মাঠে মাঠে এখন সোনালি ধান শোভা পাচ্ছে। পাকা ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিজুড়ে ফুটে উঠছে কৃষকের হাসি। সেই হাসি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে কিষানের দল। গেল সপ্তাহের প্রায় দিনেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসও ছিল। ধানের শীষ বৃষ্টিতে ভিজে ভারি হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। এতে কৃষকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুয়ে পড়া ধান পানিতে বেশি সময় থাকলে নিশ্চিত নষ্ট হয়ে যাবে। সংগত কারণেই আধাপাকা ধানও বাধ্য হয়ে কাটতে হচ্ছে অনেককে।
এদিকে কৃষি অফিস থেকেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পাইকিং করে ৮০ ভাগ পেকেছে এমন ধান কাটার জন্য বলা হচ্ছে। ফলে চাষিরা একযোগে ধান কাটতে মাঠে নেমেছে। এতে এই অঞ্চলে চরম শ্রমিক সংকটে পড়েছে। শুকনা জমিতে একজন শ্রমিকের কাজের মজুরি ৬০০ টাকা আর জমিতে পানি থাকলে ৭০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে একজন শ্রমিক। বেশি মজুরির দেয়ার পরেও চাহিদা অনুযায়ী ধানকাটা শ্রমিক মিলছে না। বাধ্য হয়ে জমির মালিকরাই কাস্তে হাতে তুলে নিয়েছে। নিজের ধান নিজেরই কাটছে।
কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে বর্তমানের পাকা ধান মাঠে আছে ৫ লাখ হেক্টর জমির বেশি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আরো ৫ লাখ হেক্টর জমির ধান একবারে পেকে যাবে। শনিবার পর্যন্ত এ অঞ্চলে ৩০ ভাগ ধান কাটার হয়েছে। আরো ৭০ ভাগ ধান জমিতে আছে। এতে শ্রমিকের সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বটতলা বাজার এলাকার বোরো চাষি মোন্তাছির রহমান, আনসার আলী, পচাবস্তা গ্রামের আমজাদ হোসেন জানায়, স্থানীয় তেনাছিরা বিলের বেশির ভাগ ধান মাঠে পেকে আছে। বৃষ্টি-বাতাসের আতঙ্কে ভুগছেন এখনকার চাষিরা। তারা বলছে ধানকাটা শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এই এলাকায় যে কয়জন ধানের কাজ করে তাদের সিরিয়াল পাওয়াই মুশকিল।
এদিকে নওগাঁর আত্রাই, রানী নগর, বগুড়ার নন্দিগ্রাম, কাহালু, আদমদীঘি, দুপচাঁচিয়া, শিবগঞ্জ, সোনাতলা, জয়পুর হাটের কালাই এলাকায় গিয়ে চোখে পড়েছে মাঠের পাকা ধান কাটা নিয়ে কৃষকের করুণ অবস্থা।
কথা হয় বগুড়া শহরের অটোচালক ইব্রাহিম হোসেনের সঙ্গে। সে সারিয়াকান্দি উপজেলার বাসিন্দা। এক বছর আগেও ধানের সেজনে মাঠে ধান কাটার কাজ করতো। সে জানায় ধানকাটা কাজ অনেক পরিশ্রমের। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে কাজ করতে হয়। সে তুলনায় অটো চালানো অনেক সহজ এবং বেশি ইনকাম।
অপর দিকে মাঠে ধানকাটা শুরু হওয়ার পাশাপাশি চালু হয়েছে হাসকিং চালকলগুলো। মিলে চাল যাওয়া চাতালগুলো সরব হয়ে উঠেছে। এই চালগুলোতেও একটা বড় অনেক শ্রমিক কাজ করে। মাঠের পাশাপাশি চাতালগুলোতে শ্রমিকের সংকট সমান তালে দেখা দিয়েছে।
দুপচাঁচিয়া উপজেলা চাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মোবারক হোসেন, চাতাল মালিক আবু কালাম আজাদ জানান, গত তিন চার বছর ধরে ভরা মৌসুমে তারা শ্রমিক সংকটে ভোগেন। একারণে চাহিদা অনুযায়ী তারা উৎপাদ করতে পারেন না। এর ফলে ানেক সময় লোকসানের শিকার হতে হয়। তারা আরো জানান, মৌসুম শুরু হওয়ার ১ মাস আগেই শ্রমিকদের আগ্রিম টাকা দিয়ে বুক দিতে হয়। এখানে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা, নলডাঙ্গা, রংপুরের পীরগাছা, চৌধুরানী এলাকার শ্রমিকরা কাজ করে। বর্তমানে চাতাল শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কমেছে।
২০ বছর আগে উত্তরে মোট কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৮০ লাখের বেশি। এখন নিয়মিত কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা নেমে এসছে ১০ লাখে। এই ১০ লাখ শ্রমিকের অর্ধেক দেশের পূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বোরো কাটা-মাড়াইয়ের কাজে গেছে। ফলে মাত্র ৫ লাখ শ্রমিক এখন কাজ করছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাজুড়ে।
কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগ বগুড়া আঞ্চলিক অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় কোনো অংশে কম হয়নি। কৃষি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছে। তিনি জানান, এবার আমরা ৮০ ভাগ পেকেছে এমন ধান কাটার জন্য কৃষকদের পাইকং লিফলেট দিয়ে জানিয়েছে। কৃষকরা অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী মাঠে কাজ করছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কামলা নাই, হামার ধান হামি কাটছি একনা করে কামলার দাম ৬০০ টাকা

আপডেট টাইম : ১২:৩২:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭

“এক নাগাড়ে ঝড়ি (বৃষ্টি) হয়া ধান মাটিত শুতে গেছে। আধা পাকা ধান কাটলেও সমস্যা না কাটলেও সমস্যা। কামলাও নাই। অটো রিকশা হয়া মানুষ আর ধান কাটপের আসে না। অটোর ডাইবারী করে। উপায় না পায়া নিজের ধান নিজেই কাটা শুরু করছি। একনা করে কামলার দাম ৬০০ টাকা। ভিওত (জমিতে) পানি থাকলে ৭০০ টাকা নেয়।” উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে ঘুরে ধান কাটা মাড়াইয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে একথাগুলো বলেন, বগুড়া সদর উপজেলার মানিকদাইড় গ্রামের ধানচাষি মণ্টু মিয়া।
উত্তর জনপদের মাঠে মাঠে এখন সোনালি ধান শোভা পাচ্ছে। পাকা ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিজুড়ে ফুটে উঠছে কৃষকের হাসি। সেই হাসি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে কিষানের দল। গেল সপ্তাহের প্রায় দিনেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসও ছিল। ধানের শীষ বৃষ্টিতে ভিজে ভারি হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। এতে কৃষকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুয়ে পড়া ধান পানিতে বেশি সময় থাকলে নিশ্চিত নষ্ট হয়ে যাবে। সংগত কারণেই আধাপাকা ধানও বাধ্য হয়ে কাটতে হচ্ছে অনেককে।
এদিকে কৃষি অফিস থেকেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পাইকিং করে ৮০ ভাগ পেকেছে এমন ধান কাটার জন্য বলা হচ্ছে। ফলে চাষিরা একযোগে ধান কাটতে মাঠে নেমেছে। এতে এই অঞ্চলে চরম শ্রমিক সংকটে পড়েছে। শুকনা জমিতে একজন শ্রমিকের কাজের মজুরি ৬০০ টাকা আর জমিতে পানি থাকলে ৭০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে একজন শ্রমিক। বেশি মজুরির দেয়ার পরেও চাহিদা অনুযায়ী ধানকাটা শ্রমিক মিলছে না। বাধ্য হয়ে জমির মালিকরাই কাস্তে হাতে তুলে নিয়েছে। নিজের ধান নিজেরই কাটছে।
কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে বর্তমানের পাকা ধান মাঠে আছে ৫ লাখ হেক্টর জমির বেশি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আরো ৫ লাখ হেক্টর জমির ধান একবারে পেকে যাবে। শনিবার পর্যন্ত এ অঞ্চলে ৩০ ভাগ ধান কাটার হয়েছে। আরো ৭০ ভাগ ধান জমিতে আছে। এতে শ্রমিকের সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বটতলা বাজার এলাকার বোরো চাষি মোন্তাছির রহমান, আনসার আলী, পচাবস্তা গ্রামের আমজাদ হোসেন জানায়, স্থানীয় তেনাছিরা বিলের বেশির ভাগ ধান মাঠে পেকে আছে। বৃষ্টি-বাতাসের আতঙ্কে ভুগছেন এখনকার চাষিরা। তারা বলছে ধানকাটা শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এই এলাকায় যে কয়জন ধানের কাজ করে তাদের সিরিয়াল পাওয়াই মুশকিল।
এদিকে নওগাঁর আত্রাই, রানী নগর, বগুড়ার নন্দিগ্রাম, কাহালু, আদমদীঘি, দুপচাঁচিয়া, শিবগঞ্জ, সোনাতলা, জয়পুর হাটের কালাই এলাকায় গিয়ে চোখে পড়েছে মাঠের পাকা ধান কাটা নিয়ে কৃষকের করুণ অবস্থা।
কথা হয় বগুড়া শহরের অটোচালক ইব্রাহিম হোসেনের সঙ্গে। সে সারিয়াকান্দি উপজেলার বাসিন্দা। এক বছর আগেও ধানের সেজনে মাঠে ধান কাটার কাজ করতো। সে জানায় ধানকাটা কাজ অনেক পরিশ্রমের। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে কাজ করতে হয়। সে তুলনায় অটো চালানো অনেক সহজ এবং বেশি ইনকাম।
অপর দিকে মাঠে ধানকাটা শুরু হওয়ার পাশাপাশি চালু হয়েছে হাসকিং চালকলগুলো। মিলে চাল যাওয়া চাতালগুলো সরব হয়ে উঠেছে। এই চালগুলোতেও একটা বড় অনেক শ্রমিক কাজ করে। মাঠের পাশাপাশি চাতালগুলোতে শ্রমিকের সংকট সমান তালে দেখা দিয়েছে।
দুপচাঁচিয়া উপজেলা চাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মোবারক হোসেন, চাতাল মালিক আবু কালাম আজাদ জানান, গত তিন চার বছর ধরে ভরা মৌসুমে তারা শ্রমিক সংকটে ভোগেন। একারণে চাহিদা অনুযায়ী তারা উৎপাদ করতে পারেন না। এর ফলে ানেক সময় লোকসানের শিকার হতে হয়। তারা আরো জানান, মৌসুম শুরু হওয়ার ১ মাস আগেই শ্রমিকদের আগ্রিম টাকা দিয়ে বুক দিতে হয়। এখানে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা, নলডাঙ্গা, রংপুরের পীরগাছা, চৌধুরানী এলাকার শ্রমিকরা কাজ করে। বর্তমানে চাতাল শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কমেছে।
২০ বছর আগে উত্তরে মোট কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৮০ লাখের বেশি। এখন নিয়মিত কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা নেমে এসছে ১০ লাখে। এই ১০ লাখ শ্রমিকের অর্ধেক দেশের পূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বোরো কাটা-মাড়াইয়ের কাজে গেছে। ফলে মাত্র ৫ লাখ শ্রমিক এখন কাজ করছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাজুড়ে।
কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগ বগুড়া আঞ্চলিক অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় কোনো অংশে কম হয়নি। কৃষি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছে। তিনি জানান, এবার আমরা ৮০ ভাগ পেকেছে এমন ধান কাটার জন্য কৃষকদের পাইকং লিফলেট দিয়ে জানিয়েছে। কৃষকরা অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী মাঠে কাজ করছে।