শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবে, প্রভাব পড়েছে এসএসসি’র ফলে

এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে। এতে পরীক্ষার ফলাফলে সামান্য ছন্দপতন হলেও ভবিষ্যৎ শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, যে কাজ আরো দশ বছর আগে করার কথা ছিল সেটি দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতির ফসল যাতে শিক্ষার্থীরা পায় সেটা ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই পদ্ধতির ফলে উদার নীতিতে নম্বর দেয়ার অবস্থান থেকে বের হবেন পরীক্ষকরা। উত্তরপত্র মূল্যায়নের পদ্ধতিতে আরো কীভাবে পরিবর্তন আনা যায়, আরো বিজ্ঞানসম্মত করা যায়, সেদিকে এখন নজর দিতে হবে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এতদিন উদারভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের নামে ঢালাও পাস বা জিপিএ-৫ দেয়ার যে প্রবণতা ছিল, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য তা ছিল ক্ষতিকর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এখন সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে থাকে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পদ্ধতি চালুর জন্য তিন বছর ধরে গবেষণা, সরকারের সম্মতি পেয়ে সর্বশেষ পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। সবচেয়ে কঠিন কাজটি করতে হয়েছে, খাতা দেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষকরা সঠিক মূল্যায়ন করছে কিনা তা নিশ্চিত করা। এবার পাইলটিং হিসেবে বেশ সাড়া পাওয়া গেছে। ২০১৮ সাল থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়ও একই পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে সুষম নম্বর দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মাহবুবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, পরীক্ষকরা একটি পদ্ধতিতে খাতা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক শিক্ষক পরীক্ষার খাতা না দেখে কোচিং টিউশনির দিকে মনোযোগ দিতেন। প্রধান পরীক্ষক খাতা পুনরায় মূল্যায়ন করার কথা থাকলেও তিনি তা মোটেও আমলে নিতেন না। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে আসছিল, আমরা পরীক্ষকদের শোকজ দিয়েও বাগে আনতে পারছিলাম না। এবার নতুন পদ্ধতিতে কোনো পরীক্ষকের ফাঁকি দেয়ার সুযোগ ছিল না। মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর একেএম ছায়েফউল্লাহ বলেন, এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘদিন কষ্ট করতে হয়েছে। সারা দেশে পরীক্ষকদের ঢাকায় এনে প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। একবার না বুঝলে পুনরায় তাদের বুঝাতে হয়েছে। আশা করি আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে খাতায় মন খোলে নম্বর দেয়ার যে অভিযোগ রয়েছে তা আর থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, সময়োপযোগী মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একটি শিক্ষাবোর্ডের পাসের হার ২৫ শতাংশ কমে যাওয়া কিংবা আরেকটি বোর্ডের ৯০-এর ঘর অতিক্রম করার মধ্যে কোনো কারসাজি আছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এক বছর যে বোর্ডের ফলাফল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়, পরের বছর সেই বোর্ডের ফল ভালো হয়ে যায়। এটিও শুভ লক্ষণ নয়। এ জন্য যেকোনো পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার আগে এটার কোনো মিসইউজ যাতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য মাধ্যমিক স্তরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তার পরবর্তী শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। অথচ এতো দিন আমরা কী দেখেছি। এই মাধ্যমিক স্তর ছিল সবচেয়ে দুর্বল। শিক্ষার এ পর্যায়ে কোনো গলদ থাকলে উচ্চশিক্ষায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা আমরা দেখেছি। অতএব, প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে স্বীকৃত মান রক্ষার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে পাঠদানের দক্ষতা- যোগ্যতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। শিক্ষার মান ধরে রাখতে পরীক্ষার ফলাফলের অসংগতি দূর করতে যে নিবিড় ও নিরন্তর তদারকি প্রয়োজন। সমন্বয়হীনতা, সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং ইচ্ছামতো পরীক্ষা-নিরীক্ষার অপচেষ্টা রোধ করতে হবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শুধু খাতা মূল্যায়ন করেই শিক্ষার মান পুরোপুরি উন্নয়ন সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, খাতা মূল্যায়নের মাধ্যমেই শিক্ষা মানের একটি জায়গা ঠিক করা যায়। একই সঙ্গে শিক্ষার রাষ্ট্রীয় বাজেট বাড়ানো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো এবং কঠোর মনিটরিং করতে হবে। তবেই পরিপূর্ণ মান যেটি বলে সেটি পাবো। একাডেমিক শিক্ষার বাইরে শিক্ষার্থীদের খেলাখুলাসহ সহশিক্ষার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেদু) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার যে পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। আগে গণহারে খাতা শিক্ষকদের মধ্যে বিলি করা হতো। কিন্তু এবার খাতা নেয়ার আগে সব প্রধান পরীক্ষকদের তিন দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রায় একইরকম প্রশ্নে দুর্গম ও শহর এলাকার নম্বরের তারতম্য অনেক বেশি লক্ষ্য করা যেত। এখন সেটি কমে আসবে। কারণ মডেল উত্তরপত্রে একটি কাঠামোর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এবার প্রধান পরীক্ষকদের খাতাও আরেকজন পরীক্ষক দেখেছেন। এছাড়া প্রধান পরীক্ষকের অধীনে থাকা নিরীক্ষকরাও খাতা পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। একজন শিক্ষক খাতা দেখার পর আরো তিনজন এই খাতা পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। তাই শিক্ষকরা আগেই সাবধান হয়ে সঠিকভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। আগে যে শিক্ষককে এক হাজার খাতা দেয়া হতো এবার তাকে ৪০০ খাতা দেয়া হয়েছে। ফলে তিনি আগের তুলনায় ভালোভাবে খাতা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া এবার বোর্ড থেকে প্রান্তিক নম্বরের ক্ষেত্রে অর্থাৎ গ্রেড পরিবর্তন হয়ে যায় যে নম্বরগুলোতে গিয়ে সেখানে দুই-তিন নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর