দেশের হাওরাঞ্চলে এবার যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা ওই অঞ্চলের সমন্বয়হীন উন্নয়নের ফল। যাঁরা উন্নয়নের পরিকল্পনা করেন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের অদূরদর্শিতার খেসারত দিচ্ছে ওই অঞ্চলের মানুষ। এবার আগাম বন্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা আগে এসেছে এবং বন্যার পানির উচ্চতাও অনেক বেশি ছিল—এই সত্য জানার পরও এ কথা বলতে হচ্ছে।
দীর্ঘকাল দেশের হাওর অঞ্চল প্রথাগত উন্নয়ন ধারার বাইরে ছিল। প্রকৃতপক্ষে এখনো জাতীয় উন্নয়নের নীতিকাঠামোর মূল ধারায় হাওর অঞ্চল যুক্ত নয়। তবে ওই অঞ্চলের জন্য আলাদাভাবে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে সেখানে ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজও চলেছে। কিন্তু প্রচলিত বাঁধ এবং কিছু রাস্তাঘাট ছাড়া তার আর তেমন কোনো সুফল হওরের মানুষের কাছে দৃশ্যমান নয়।
সরকার ২০ বছর মেয়াদের (২০১২-১৩ থেকে ২০৩১-৩২ পর্যন্ত) এই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে ২০১২ সালে। এই মহাপরিকল্পনায় প্রকল্প আছে ১৫৩টি। সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয়ের ৩৫টি বিভাগ ও সংস্থা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ডজনখানেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও (এনজিও) এর সঙ্গী। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় নির্ধারিত আছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা-অধ্যুষিত, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় আট হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে প্রকল্পগুলোর মধ্যে। আগাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, শস্য উৎপাদন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মৎস্য ও গবাদিপশুর উন্নয়ন, বনায়ন, পর্যটন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সড়ক ও নৌচলাচল উন্নয়নসহ অনেক বাহারি নামে আরও হরেক রকম প্রকল্প মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে।
এবার হাওর অঞ্চলে বিপর্যয়কর আগাম বন্যার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে ওই মহাপরিকল্পনার কী ফল হাওরের মানুষ তথা দেশবাসী পেল? মহাপরিকল্পনা গ্রহণের পর পাঁচ বছর চলে গেছে। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদের চার ভাগের এক ভাগ সময় শেষ। সেই অনুপাতে অর্থও ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়েছে কি?
সরজমিনে খোঁজ নিয়ে কিছু রাস্তা ও বাঁধের কাজ হয়েছে বলে জানা যায়। এ ধরনের কাজ মহাপরিকল্পনা গ্রহণের আগেও হয়েছে। মহাপরিকল্পনা গ্রহণই করা হয়েছিল উন্নয়নের সবগুলো বিষয় সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য। ঢাকায় সরকারি পর্যায়ে (বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ) খবর নিয়ে সেই সমন্বয়ের অভাবের কথাই কেবল জানা যায়। এ রকম যদি হয় তাহলে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এ ধরনের পরিকল্পনার মানে কী? শুধু অর্থ ব্যয় ছাড়া এ ধরনের পরিকল্পনা ও প্রকল্প থেকে দেশের মানুষ আর কি কোনো ফল পাওয়ার আশা করতে পারে? দেশবাসীর কাছে এসব প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য জবাব সরকারের দেওয়া উচিত। তা না হলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ক্রমাগতভাবে কমবে।
প্রশ্ন উঠেছে বিরোধী ও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়েও। অতীতে দেশের যেকোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াত। দেশের ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে যে সরকার ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করার আগে রাজনৈতিক দলগুলো রিলিফ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চলে গেছে। মানুষকে সাহায্য করেছে। সাহস দিয়েছে। দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মীদের সাংবার্ষিক কাজের মধ্যে এটা ছিল একটা বড় কাজ।
শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংগঠন, ছাত্র-যুব-সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানাভাবে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজকাল তাদের একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করা। আর অতি অবশ্যই সরকারের সমালোচনা করে দায়িত্ব শেষ করা। এই যখন অবস্থা, তখন এসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপরই বা মানুষ আস্থা রাখবে কী করে?
এবারের আগাম বন্যায় হাওর অঞ্চল সর্বস্বান্ত হয়েছে। সরকার প্রচুর অর্থ ও খাদ্যশস্যসহ বিপুল ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করেছে বলে জানাচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও অন্তত দুটি চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে রয়েছে। প্রথমত, এসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ভার সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের হাতে পড়ে যেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বঞ্চিত না হয়। দ্বিতীয়ত, এবার হাওর অঞ্চলে ত্রাণ কার্যক্রম অনেক দিন চালাতে হবে। কিন্তু সামনেই বর্ষাকাল। বর্ষায় হাওর অঞ্চলের মানুষ বিপুল জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে পড়ে। তখন সেই মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা এখনই নির্ধারণ করে অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে হাওর অঞ্চলের মানুষের ওপর তা ‘খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে নেমে আসবে।