কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতিতে দ্বিধাবিভক্ত আলেমরা

দেশে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। সর্বোচ্চ ডিগ্রি ‘দাওরায়ে হাদিস’-এর সনদে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর আলেম ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। কিন্তু এ স্বীকৃতি নিয়েই আবার আলেমরা হয়ে পড়েছেন দ্বিধাবিভক্ত। আহলে সুন্নাত নেতারা আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সংকোচন নীতি প্রত্যাহারসহ কওমি সনদ প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে নামবেন বলে জানিয়েছেন।

জানা গেছে, সারাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৩১টি। ২০০৮ সালে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশ তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) পরিচালিত এক গবেষণায় কওমি মাদ্রাসায় মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) এর তথ্যানুযায়ী এ সংখ্যা ২০ লাখের ওপর হবে। বেফাক ছাড়াও দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে আরো আঠারোটি কওমি মাদ্রাসার বোর্ড রয়েছে বলে জানা গেছে।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদানের বিষয়ে ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির লক্ষ্যে সুপারিশমালা প্রণয়নের করতে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে সরকার। চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলামের মহাপরিচালক মওলানা আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের এ কমিশন নিয়ে শুরু হয় আলেমদের মতবিরোধ।

বর্তমানে বাংলাদেশে আলিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা এবং স্বতন্ত্র মাদ্রাসা এ তিন ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা থেকে এ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ধারা ছিল না। ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষায় আলিয়া মাদ্রাসা ধারা এবং ১৮৯৯ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর কওমি মাদ্রাসা ধারার প্রচলন হয়।

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে মোহাম্মদ হাসান মাদানি বলেন, এটা দীর্ঘদিনের দাবির ফসল। সরকার দেরিতে হলেও কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এজন্য সরকারের প্রতি আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তবে এই ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া দরকার।’ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে কওমিপন্থী আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এক বৈঠকে কওমি মাদ্রাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন।

এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক নথি থেকে জানা গেছে, এখন থেকে সারা দেশে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা একই প্রশ্নপত্রে নেওয়া হবে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মতো পরীক্ষার উত্তরপত্র একসঙ্গে মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশ করা হবে। ‘কওমি মাদ্রাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’ এ কাজ পরিচালনা করবে। বর্তমানে সারা দেশে অন্তত ৬টি শিক্ষা বোর্ড আছে। বোর্ডগুলো আলাদাভাবে পরীক্ষা নিয়ে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির সনদ দিয়ে থাকে।

জানা যায়, কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির বিষয় নিয়ে ২৮ মার্চ কওমিপন্থী শীর্ষ আলেম এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোকে ভিত্তি ধরে দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবির সমমান দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দাওরায়ে হাদিসের ডিগ্রির মান বাস্তবায়নে নিয়োজিত কমিটি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে। এ শর্তেই সরকার সংশ্লিষ্টদের উল্লিখিত সমমান দিতে রাজি হয়েছে। বিপরীত দিকে, কওমি আলেমরাও ওই কমিটিতে সরকারের কোনো প্রতিনিধি না রাখার শর্ত দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও ওই শর্ত মেনে নিয়েছে। তবে কমিটি উল্লিখিত কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি দিতে উদ্যোগ নেয় সরকার।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও কওমি মাদ্রাসার শীর্ষস্থানীয় আলেম মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির প্রথম দাবিটি উঠেছিল ১৯৭৯ সালে। চট্টগ্রামের চকরিয়ার বাসিন্দা খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ এ দাবিটি তুলেছিলেন। এ দাবিতে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছিলেন। অতীতের সব সরকারের আমলেই এ দাবি উত্থাপন করা হয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ দাবি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান সরকার তাদের দাবির মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে এমএ বা মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে সরকার। এতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের কওমি শিক্ষার্থীরাও খুশি।

মাওলানা আজিজুল হক জানান, আলিয়া মাদ্রাসার ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষার পর কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়েও এরাবিকসহ ইসলামি বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে এমনই- যেখানে শুরু থেকে শেষ (দাওরায়ে হাদিস) পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ আলেম তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। দাওরায়ে হাদিস পাস করার পর তারা এখন দেশে বা দেশের বাইরে পিএইচডি, এমফিল তথা উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পারবেন। বিশেষজ্ঞ আলেম তৈরি হবে।

আজিজুল হক ইসলামাবাদী জানান, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় দেড়শ’ কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। যেখানে দাওরায়ে হাদিস পড়ানো হয়। এর মধ্যে হাটহাজারী ও পটিয়ার তিনটি বৃহৎ মাদ্রাসাতেই ৪০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে।

কওমি মাদ্রাসার যথার্থ অর্থ হলো জাতীয় মাদ্রাসা বা জাতীয় শিক্ষায়তন। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে কেন্দ্র করে চারটি ধারা প্রচলিত রয়েছে: (ক) কিতাব বিভাগ বা দরসিয়াত বিভাগ (খ) মক্তব বিভাগ (গ) সহীহ কুরআন শিক্ষা ও কিরাত বিভাগ এবং (ঘ) হিফজুল কুরআন বিভাগ।

বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা দুটি পর্যায়ে বিভক্ত: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা। তবে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ কওমি মাদ্রাসাতে এ স্তরের কোর্স ১ বছরে দাওরায়ে হাদিস পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয়। দ্বিতীয় বর্ষের কোর্স সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।

এদিকে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে ‘জঙ্গিবাদের আখড়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত অবিলম্বে কওমি মাদ্রাসার সরকারি সনদ প্রত্যাহার করে, দেশে একমুখি মাদ্রাসা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন সুন্নাত সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দীন বখতেয়ার। তিনি বলেন, সরকার দেড়শো বছর ধরে চলমান ওহাবী–দেওবন্দী মতাদর্শী বেসরকারি কওমি মাদ্রাসাকে সরকারি সনদ প্রদানের ঘোষণা দিয়ে আজ সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, যারা কখনো সরকারের আনুগত্য করেনি, সরকারি নিয়ম–কানুন মেনে চলেনি, যাদের শিক্ষা কারিকুলাম সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয়, অধিকন্তু এতোদিন যে মাদ্রাসা সমূহের বিরুদ্ধে জঙ্গি প্রজননের অভিযোগ ছিল, খোদ বর্তমান সরকারকে–যাদের ২০১৩ সনে মতিঝিল শাপলা চত্বর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাড়াতে হয়েছিল। এমন উগ্রগোষ্ঠির মাদ্রাসাগুলোকে পুরষ্কৃত করার ঘোষণাটি রীতিমত হতাশাজনক এবং সুগভীর ষড়যন্ত্রমূলক আঁতাত হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। তাছাড়াও সম্প্রতি মুফতি হান্নানসহ যেসব জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তারাও কওমি শিক্ষিত। অথচ আজ হঠাৎ করেই সে জঙ্গিগোষ্ঠিকে প্রত্যাশিত শাস্তির বদলে পুরষ্কৃত করার তামাশা দেখে জাতি নির্বাক হয়ে গেছে। এ সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষা নীতি বড়ই রহস্যময়।

আহলে সুন্নাত নেতৃবৃন্দ, আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সংকোচন নীতি প্রত্যাহারসহ কওমি সনদ প্রত্যাহারের দাবিতে আগামি ১৭ ও ১৮ এপ্রিল জেলা–উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং ২০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করার ঘোষণা দেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর