নব্বইয়ের দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে ইসলামি বিশ্বে যেন অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। একের পর এক মুসলিম বিশ্বের এ দেশ থেকে সে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ যুদ্ধ। চলমান এ যুদ্ধের লাভ-ক্ষতির হিসেবে দেখা যায়, একটি গোষ্ঠিকে দমনের জন্যে সন্ত্রাসবাদের কলঙ্ক চাপিয়ে পরাশক্তিরা ব্যয়বহুল যুদ্ধ পরিচালনা করছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে নিজেদেরই ধ্বংস করে চলেছে মুসলিম বিশ্বের অনেক সম্প্রদায়। ধ্বংস করে চলেছে তাদের হাজার বছরের আদর্শ আর নৈতিক মূল্যবোধের চেতনাকে। বিশ্বের শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলো বলছে, এ যুদ্ধ চলছে দুটি পক্ষের মাঝে। এক পক্ষ সাম্রাজ্যবাদি অপর পক্ষ ইসলামি বিশ্বের উর্বর দেশগুলো। এ যুদ্ধের আসল কারণ সাম্রাজ্যবাদিদের সঞ্চিত শক্তির ভিত যেন আরও দির্ঘস্থায়ী হয়। অপরপক্ষ যারা যুদ্ধে লিপ্ত তারা শুধু জানেন নিজেদের ধর্মকে রক্ষার জন্যই যুদ্ধ করছেন। ধর্মকে রক্ষা করতে গিয়ে তারা যে নিজেদের ধ্বংস করছেন এ বোধদয় হয়ে উঠছে না এখনো।
প্রতিদিন কোনো না কোনো দেশে লাশের পাহাড় জমছে। ইসলামি বিশ্বের সোনালি জমিন এখন লাশের কফিনে মুড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে বিশ্বের মুসলমানরা সংখ্যালঘু হতে বেশিদিন সময় লাগবে না। কোনো খ্রিস্টান রাষ্ট্র, ইহুদি রাষ্ট্র বা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে এভাবে ধর্মিয় উগ্রতায় জড়িয়ে ধ্বংস হতে দেখা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মুসলিম বিশ্বের অন্ধ নেতারা সাম্রাজ্যবাদিদের দ্বারস্থ হওয়ার কারণেই উগ্রবাদের এ ধর্মান্ধতাকে আরো দির্ঘস্থায়ী করে জিঁইয়ে রাখা হচ্ছে। সরল মানুষের ধর্মান্ধতার উগ্রতা পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসবাদে। মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর ধর্মীয় বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে হেন স্বার্থের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করে চলেছেন সাম্রাজ্যবাদিরা। মুসলিম প্রধান দেশের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশ ঘটানো হয়েছে ধর্মীয় উগ্রতার নানান বিভক্তি।
এসব ষড়যন্ত্রে কাজে লাগানো হয়েছে এ ধর্মেরই উগ্র মানসিকতার ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু ব্যক্তিকে। এরা ধর্মীয় পুস্তকের নামে সাম্রাজ্যবাদিদের কৌশলী ইশারায় বা পরোক্ষ সহযোগিতায় ধর্মকে বিকৃত করে হাদিস বানিয়ে বাজারজাত করছে। এরা জিহাদের নামে বেহেস্তের টিকেট দিলেও নিজেরা সেই বেহেস্তে যেতে আগ্রহী নয়।
সেই কথিত বেহেস্তে যেতে আকুল হয়ে উঠে কিছু সহজ-সরল মুসলিম যুবক। যারা নিজেদের অজান্তে সাম্রাজ্যবাদিদের ক্রিড়নক হয়ে ধ্বংস করে চলেছে নিজেদের দেশ ও ভবিষ্যতকে। যা এখন মুসলিম বিশ্বের কমবেশি প্রতিটি দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়ে একাধারে ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে। যার নতুন পরিণতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলমানরা।
রোহিঙ্গা সলিডারিটির বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করলে ১২ সেনা নিহত হয়। প্রতিশোধের এই তকমা দিয়েই এখনো নৃশংস কায়দায় মুসলিম নিধন অব্যাহত রেখেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদের ওপর কি পরিমাণ নৃশংসতা চলছে তা প্রকাশের ভাষা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর গণমাধ্যমে যে চিত্র বিশ্ববাসী দেখছে তা বর্ণনা করতে গেলে চোখ ভিজে যায়। নৃশংসতার দহনে কলম থমকে যায়। নিষ্ঠুর পাশবিকতার চিত্র কল্পনায় ভেসে আসতেই কলম বন্ধ করে দম বন্ধ বিরতি নিতে হয়। প্রকাশের ভাষা হারিয়ে যায়। এ কেমন বর্বরতা এ কেমন নিষ্ঠুরতা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু নিরীহ মানুষের ওপর এমন নৃশংসতা এর আগে কেউ দেখেনি।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদিদের দায় চাপিয়ে এখনো চলছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। হাজার হাজার মুসলমান নিধনের চিত্র দেখে বিশ্ব মোড়লরা যেন তৃপ্তির ঢেকুর গিলছে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সরকারকে এই নিষ্ঠুরতার জন্য যেভাবে হুঁশিয়ারি দেয়া দরকার তা না করে বাংলাদেশকে সিমান্ত খুলে দিতে বলছে। জাতিসংঘের এই একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদিদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
বিভিন্ন প্রকাশনায় যুদ্ধ বিশারদ আর ভূ-রাজনীতিবিদদের মতামত এশিয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যেই সাম্রাজ্যবাদি শক্তি তাদের গোপন কুটনৈতিক কৌশলে এই যুদ্ধ জিঁইয়ে রাখছে। দেশে দেশে মুসলিম নিধনের ধারাবাহিক অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে তারা। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবির বিভিন্ন দেশে প্রতিদিনের রোমহর্ষক এই নিধনযজ্ঞের খবরে অট্টহাসিতে দম ফাটাচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদিরা। তারা যে শুধু যুদ্ধের উপসর্গ তৈরি করে দিয়েছেন তা নয় যুদ্ধরসদের ব্যবসাও করে চলেছেন দেদার। তাদের অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত চাঙ্গা করে তুলছে এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে কেউ কেউ ধর্ম যুদ্ধ বলেও ব্যখ্যা করছেন। যার কারণে সাম্রাজ্যবাদিদের ষড়যন্ত্রের কথা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
প্রিয় পাঠক, ধর্ম প্রসঙ্গে সামান্য জানাশোনায় যা বুঝি এবার তা নিয়ে আলোকপাত করছি। পৃথিবীর সভ্য মানুষ ধর্মকে কখনো অধিক গুরুত্ব দিয়েছে আবার কখনো কম গুরুত্ব দিয়েছে। ধর্ম নিয়ে রয়েছে নানা রকমের দ্বিধা-বিভক্তি। বিজ্ঞানের আকাশচুম্বি অগ্রগতির পরও কালের স্রোতে ধর্ম বয়ে চলেছে তার নিজ গুনে। অবিশ্বাসীরাও একসময় ধর্মকে আঁকড়ে ধরেন, যখন তিনি বার্ধক্যে যেতে থাকেন।
পরলৌকিকতা বিশ্বাস না করলেও জিবন সায়াহ্নে গিয়ে তারা ভাবতে থাকেন এরপর কি? বা মৃত্যুর পর কি ? তখনই ধর্ম জেগে উঠে বিবেকের ঘরে। এ জন্যই বিশ্বব্যাপী ধর্ম অনস্বীকার্য এক অনন্য মাধ্যম হয়ে বয়ে চলেছে সকল সম্প্রদায় ও সকল গোত্রের মাঝে। এই ধর্মকে পুঁজি করে বহুকাল ধরে চলছে মত পথের পার্থক্যের লড়াই।
ধর্মকে যখনি পার্থিব ব্যবহারের অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হয়, তখনই এ অস্ত্র হয়ে উঠে বিশাল শক্তি সম্ভারের মহাপর্বত। কিসের পরমাণু বোমা কিসের কি? এ বোমার চেয়ে শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র হতে পারে না। বর্তমানে অসীম শক্তি সম্ভারের এই বোমাটিকেই ব্যবহার করছেন বিশ্বের শাসক শ্রেণির ক‚টনৈতিক কিংবদন্তিরা। যাদের বুদ্ধিতে মুহ‚র্তেই বিভিন্ন দেশের চিত্র পাল্টে যায়। যার উদাহারণ ইরাক, আফগান, লিবিয়া, সিরিয়া পাকিস্তানসহ আরও কটি মুসলিমপ্রধান দেশ।
আমাদের পরিস্থিতিও ভালো নই! আমরা এই মহামারি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারলাম না! আমাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে ধ্বংসের পথে। পরাশক্তির ক‚টনৈতিকরা দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমেই ধর্মের খোলসে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছে আমাদের দেশে। ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের যত মত আর পথ থাকুক না কেন হত্যা, আত্মহত্যা বা নৃশংসতাকে কখনোই বৈধতা দেয়া হয়নি। যে ধর্মে জিবনাচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তিনির্ভর ও কল্যাণমুখি নির্দেশনা রয়েছে। সে ধর্মটিই হচ্ছে ইসলাম ধর্ম বা শান্তির ধর্ম।
একসময় পৃথিবির বিভিন্ন দেশে কিছু কুসংস্কার থাকলেও প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) পৃথিবীতে আসার পর এসবের যৌক্তিক সমাধান হয়েছে। এখন যে সকল কুসংস্কার বা গোড়ামি ইসলাম ধর্মে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসবই ইসলামবিদ্বেষী ক‚টনৈতিকদের দীর্ঘ পরিকল্পনার ষড়যন্ত্রের ফসল। মুসলিম বিশ্বের সহজ-সরল অনেক মুসলমানরাই ধর্মের নামে অধর্মের আবরণ গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের অজান্তে। যেসব মতবাদ ইসলামবিদ্বেষীরা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সুকৌশলে ধর্মিয় পুস্তকে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
পাক, ভারত ও বাংলায় একসময় ইসলাম ধর্মের শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দের ইতিহাস সহস্রাব্দের মানব ইতিহাসকে আলোকিত করে। সেই আলোকিত ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে মুসলমানদের বিশ্বে চলছে এখন নারকীয় বর্বরতা। মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করছে পশুর মতো। প্রতারণার ধর্মজালে পড়ে অনায়াসে আত্মাহুতি দিচ্ছে বেহেস্তকামী একশ্রেণির সহজ সরল মুসলমানরা।
যারা ইসলাম ধর্ম ও এর মৌলিক নীতি বাস্তবায়নের জন্যে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন তাদের উদ্দেশে বলছি, ইসলাম কি আসলেই যুদ্ধ বা তরবারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাকি, শান্তি, সম্প্রীতি, উদারতা, ত্যাগ আর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে পৃথিবি জয় করেছিল। অনেকের ধারণা, ইসলাম প্রচারে তলোয়ারের ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ওপরই বেশি নির্ভর করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জিবদ্দশায় সংঘটিত যুদ্ধগুলো ও পরবর্তিতে মুসলিম শাসকদের যুদ্ধ-বিগ্রহকে তুলে ধরার চেষ্টা করে।
এবার এ প্রসঙ্গে কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করছি-
৯ম হিজরির রজব মাসে সংঘটিত তাবুক যুদ্ধ ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জিবদ্দশার শেষ যুদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জিবদ্দশায় ২৭টি যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয়েছে। ছোট-খাটো যুদ্ধ ও নৈশ অভিযানের সংখ্যা ছিল ৬০টি; আরও কতগুলো যুদ্ধ সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়ায়নি। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জিবদ্দশায় জিহাদ হয়েছিল ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। সব যুদ্ধই ছিল প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। এসব যুদ্ধাভিযান, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ ও পরিচালনায় হয়েছিল, তাতে যে পরিমাণ রক্তপাত হয়েছিল, এ পর্যন্ত সংঘটিত একটি যুদ্ধের সহস্রভাগের সমান রক্তপাতের ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুনতে খুবই অবিশ্বাস্য শুনাবে যে এসব যুদ্ধে মোট নিহতের সংখ্যা মাত্র দেড় থেকে দুই হাজারের বেশি নয়, তাও এ সংখ্যায় উভয় পক্ষের নিহতেরাই অন্তর্ভুক্ত। এর পরিণতিতে জাজিরাতুল-আরবের চারপাশে যে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ কায়েম হয়েছিল তার কোনো তুলনাই চলে না। অথচ, পূর্বে গোটা জাজিরাতুল-আরবে হত্যা, ধ্বংস, প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড, গৃহযুদ্ধ ও লড়াই-সংঘর্ষের ধারা বংশানুক্রমিকভাবে অব্যাহত ছিল এবং শুধু তাই না, ব্যাপারগুলো খুবই সাধারণ ও নৈমিত্ত্যিক ব্যাপার ছিল।
এছাড়া ওইসব যুদ্ধের ওপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যেসব নৈতিক শিক্ষা ও সহানুভ‚তিশীল নির্দেশ ছিল তা আরববাসীদের প্রতিশোধ ও ক্রোধের আগুন নেভানোর বদলে চরিত্র সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড, হেদায়েত ও কল্যাণ লাভের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন কোথাও কোনো বাহিনি পাঠাতেন তখন তাদের প্রতি হেদায়েত থাকত, আমি তোমাদের আল্লাহকে ভয় করার এবং যেসব মুসলমান তোমাদের সঙ্গে রয়েছে তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণের উপদেশ দিচ্ছি।
তোমরা আল্লাহর নামে যুদ্ধরত হবে এবং আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে যারা আল্লাহর সঙ্গে কুফুরি করেছে। কোনো শিশু, নারী, অসহায় বৃদ্ধ কিংবা খানকাহ, গির্জা, মঠ, মন্দিরের ধর্মীয় পুরোহিত, বিশপ-যারা কোনো না কোনো ধর্মের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছে তাদের হত্যা করবে না। কোনো গাছ কাটবে না, কোনো গৃহ ধসিয়ে নেবে না।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জিবদ্দশাতে এই সামরিক কর্মকাণ্ডের সফলতা যে কত দ্রুত অর্জিত হয়েছে, তা এভাবে বোঝা যেতে পারে যে, প্রতিদিন গড়ে জাজিরাতুল-আরবের প্রায় ২৭৪ বর্গমাইল এলাকা ইসলামের অধীনে এসেছিল। মুসলমানদের জিবনহানির হিসাব নিলে দেখা যাবে, গড়ে মাসে একজন মানুষের অর্ধেক শাহাদতবরণ করেছে। ১০ বছরেরও কম সময়ে, প্রায় ১০ লাখ বর্গমাইল এলাকা ইসলামের অধীনে এসেছে।
শরিয়তের ওপর খোলাফায়ে রাশেদিন সবসময় আমল করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে যদি কোনো লোক তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই তথা আত্মীয়কে হত্যা করে এবং দীর্ঘসময় পর্যন্ত রক্তপাত করতে থাকে এবং তারা কখনো পরাস্ত হলে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও, তবে এই অবস্থায়ও যদি সে মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উচ্চারণ করে, তাহলে তাকেও তৎক্ষণাৎ মুক্ত করে দাও। এমনকি যদি তোমার পূর্ণ বিশ্বাসও হয় যে, সে প্রাণভয়ে কালেমা পড়েছে আদৌ বিশ্বাস করেনি, তবুও তার ওপর থেকে তলোয়ার সরিয়ে নাও। এমনকি বিপদমুক্ত হয়ে সে অন্য সময় তোমাদের হত্যা করবে বলে প্রবল আশঙ্কা থাকে তবুও। পরিবার থেকে শুরু করে যুদ্ধনীতিতেও যে ধর্মটি শ্রেষ্ঠত্যের প্রমাণ করে সেই ধর্মেরই আজ মর্মান্তিক ও নৃশংস দশা।
ইসলামি চিন্তাবিদদের অভিযোগ-একজন খ্রিস্টান নিহত হলে পশ্চিমা রাজনীতিক ও বুদ্ধিজিবিরা যেভাবে প্রতিবাদমুখর হয়, হাজারো মুসলমান মরলেও তারা সেভাবে প্রতিবাদ করে না। মিয়ানমারের রাখাইন ও মধ্য আফ্রিকায় মুসলমানরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের হাতে গণহত্যার শিকার। এর আগেও রাশিয়া, ভারত, চীন, ফিলিপাইন, ফিলিস্তিন, বসনিয়া ও কসোভোসহ পৃথিবির বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্বতিমুর ও দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা লাভে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা জগৎ উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলেও ফিলিপাইনের মিন্দানাও, দক্ষিণ থাইল্যান্ড, মিয়ানমারের রাখাইন, চীনের পূর্ব তুর্কিস্তান (ঝিংজিয়ান), ভারতের কাশ্মির এবং চেচনিয়া ও দাগিস্তানসহ রুশফেডারেশনভুক্ত ১২টি মুসলিম প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন করার জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা জগৎ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতকামীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।
দেশের বোদ্ধারা বলছেন, পৃথিবির বিভিন্ন মুসলিম দেশের এমন অসংগতির চিত্রগুলোই ষড়যন্ত্রকারীরা উগ্র মুসলমানদের সামনে নিয়ে এসে তাদের আরও উসকে দেয়। সংঘাত ছড়িয়ে দেয়। আবার অনেকে মনে করেন, মুসলমানদের প্রতি বিচারহীনতার কারণেও এই উগ্রবাদ দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
এ বিষয়টি নিয়ে আমরা যে যতই আলোচনা করি না কেন মূল আলোচনা আড়ালেই থেকে যায়। কারণ, সে বিষয়টি সাক্ষ্যপ্রমাণে দৃশ্যমান নয়। সাম্রাজ্যবাদিদের কাছে বাংলাদেশ ভ‚-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে তা আমরা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আঁচ করতে পারি না।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন-ভারতকে শাসন করতে হলে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তাই আইএস বা তাদের অনুসারি উগ্র গোষ্ঠিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দমনের বিষয়টিও মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাহলেই তো ‘সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো’ এই প্রবাদের যথার্থতা মিলবে।
গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুরের ঘটনার পর থেকে প্রতিদিন দেশবাসী এ দেশটাকে নতুন করে দেখছে। পাশের দেশে প্রতিদিন মুসলিম গণহত্যা। মানবতা মানবাধিকার সবকিছুই বিপর্যস্ত। এসব ঘটনায় দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক চরম আশঙ্কায় প্রতিনিয়ত বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। এ যেন অদৃশ্য এক যুদ্ধের মধ্যে দিন পার করছে দেশবাসী। স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সব জায়গায় এক অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে আছে দেশের মানুষ, আবার কখন কোথায় কি ঘটে?
যত আশঙ্কাই আমাদের ঘিরে রাখুক, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। পিছপা হওয়া যাবে না। যুদ্ধ চলছে গুলশান হামলার নৃশংসতার ঘৃণার সঙ্গে, যুদ্ধ চলছে যেন পল্লিকবি জসিমউদ্দিনের নকশি কাঁথার বাংলার সঙ্গে, যুদ্ধ চলছে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মায়ের অশ্রুর সঙ্গে, যুদ্ধ চলছে-কাজী নজরুল, শামসুর রহমান, শহিদ জননী জাহানার ঈমাম আর আল-মাহমুদের সোনালি কাবিনের বাংলার সঙ্গে। যুদ্ধ চলছে ৩০ লাখ শহিদের বিদেহী আত্মার সঙ্গে। যুদ্ধ চলছে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের বাংলার সঙ্গে। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক প্রথম ভোর
ই-মেইল ofshamimbd@gmail.com