একজন রক্তমাংসের নারী: একটি যান্ত্রিক ঝংকার

জেসমিন চৌধুরী

ইন্টারনেট বিস্ফোরণের আগের যুগের কথা বলছি, হোয়াটসআপ বা ভাইবারের অস্তিত্বই কল্পনা করা যেত না তখন। আঠারো বছর বয়সের বোকাসোকা একটা নববিবাহিতা মেয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে স্বামীর সাথে বিলেতে এসেছে সংসার করতে। এই নতুন দেশে তার কেউ নেই। না বন্ধু না আত্মীয়, কিন্তু মেয়েটাকে তা বিচলিত করে না। বোকা বলেই হয়তো, মেয়েটা বেশ সাহসীও।

বিলেতের কথা অদ্ভুত সব গল্প শুনেছে সে। বাতাসে টাকা ওড়ে সেখানে, শুধু কুড়িয়ে নেয়ার অপেক্ষা। তবে তার মত সুন্দরী মেয়েকে রাস্তায় দেখলে ছেলেরা সরাসরি এসে সেক্সের প্রস্তাব দেবে, কাজেই খুব সাবধান থাকতে হবে তাকে। তেমন একটা সমস্যা নেই অবশ্য, সে শুনেছে ‘না’ বললে বিলেতে জোর করে না কেউ। আরো শুনেছে কোথাও একটা ধূলিকণা পর্যন্ত নেই বিলেতের পথে ঘাটে, এতো পরিষ্কার যে রাস্তায় জুতা না পরলেও চলে কিন্তু ঠান্ডার জন্যেই পরতে হয়।

বিলেতে এসে পৌঁছে তার সব ধারণাই ভুল বলে প্রমাণিত হলো। পথেঘাটে পড়ে থাকা খালি ক্রিস্পসের প্যাকেট উলটে পালটে টাকাতো দূরের কথা, একটা কানা পয়সাও পেল না কখনো। ভয়ে ভয়ে হলেও একা একা দু’চার বার দোকানে এটা সেটা কিনতে গেল মেয়েটি, সেক্সের প্রস্তাব দিল না কেউ। একদিকে প্রচন্ড ঠান্ডা, অন্যদিকে ঘরের আসবাবপত্রের ধূলা ঝাড়তে গিয়ে ভয়ানক সর্দি বাঁধিয়ে ফেলল বেচারি।

দু’চারদিন পার হতে না হতে নতুন দেশের চমক কেটে গিয়ে যখন মন খারাপ লাগতে শুরু করে, মা-বাবার জন্য মন হুহু করে উঠে তখন প্রথম মেয়েটি টের পায় কত বড় বোকামি করেছে সে। যখন সে বুঝতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিষ্ঠুর চক্রান্তেই তার এই দূর দেশে আসা এবং এর প্রতিনিধি পুরুষটির সুখ সুবিধা নিশ্চিত করা ছাড়া তার জীবনে আর কোনো লক্ষ্যই নেই, নিজেকে বলির পাঠার মত মনে হয় তার।

দূরদেশের এই শিকলহীন বন্দীত্বের কষ্টে তার বুক ফেটে কান্না আসে, কিন্তু আশেপাশে বলার মত কেউ কোথাও নেই। লিখতে ভালবাসে মেয়েটি, কিন্তু দেশে চিঠি যেতে দুই সপ্তাহ লাগে। উত্তর আসতে আরো দুই সপ্তাহ। নতুন জীবনের সকল জটিলতা, সকল বিভ্রান্তি মেয়েটির একবারেই একার সম্পত্তি, ভাগ বসানোর মত আশেপাশে কেউ নেই তার। বললেও কেউ বুঝবে না, তাই নিজের কষ্টগুলোকে নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখে সে। মা-বাবার কাছে সুদীর্ঘ সব চিঠি লেখে মেয়েটি- ছবির মত সাজানো সব পার্কের কথা, পথে ঘাটে দেখা অসভ্য বাচ্চাদের আর অর্ধনগ্ন মেয়েদের কথা, চুলে জেল লাগানো গায়ে উল্কি আঁকা পাঙ্কদের কথা, মাতাল আর বেশ্যাদের কথা। শুধু নিজের কথা কিছুই লেখে না সে, তার নিজের কোনো কথা কেউ বুঝবে না জানে বলেই।

মা-বাবা ভাইবোনের কন্ঠস্বর শুনতে মন চায় তার, ফেলে আসা বেড়াল ছানার মিঁউ মিঁউ ডাক শোনার জন্য মন আনচান করে। লং ডিস্টেন্স কল করতে চাইলেও পারে না, বিল অনাদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এন্টিক ফোন সেটটা তার দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসে। ঘরের পাশেই লাল রঙের পাবলিক ফোন বুথ থেকে কল করতে মিনিটে এক পাউন্ড কাটে। এক পাউন্ডে একটা মুরগী পাওয়া যায়, অথবা চার প্যাকেট পাউরুটি। সে চাইলেও কল করতে পারে না, তার বরের এতো টাকা নেই। মেয়েটি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে, তার কান্নার খবর কেউ রাখে না। সবাই ভাবে সে বিলেতে এসে মহাসুখে আছে, তাদের ভুল ভাঙ্গাতে চায় না সে।

মেয়েটি প্রায়ই লাল রঙ্গের ফোন বুথটার পাশে দাঁড়িয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে ভেতরের দিকে তাকায়। একটি পাউন্ড, মাত্র একটি পাউন্ড খরচ করলেই সে মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে পাবে, ভাবতেই উত্তেজনায় তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা প্রবল বেগে লাফাতে থাকে। কিন্তু সে একটি পাউন্ডও খরচ করার সাহস পায় না। গত কয়দিন ধরে স্বামীকে ভাত খাইয়ে নিজে লুকিয়ে চিড়া খেয়ে থেকেছে সে। সেটা জোগাড় করতেও বিয়েতে উপহার পাওয়া কয়েকটা শাড়ি বেচতে হয়েছে তাকে। এরপর হয়তো গয়নাও বেচতে হবে। চারদিকে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না আঠারো বছরের অর্বাচীন মেয়েটি।

একদিন বাজার করতে বেরিয়ে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। গুটিগুটি পায়ে সে লাল ফোন বুথটার দিকে এগিয়ে যায়। উত্তেজিত, কম্পিত হাতে ভারী দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকেই তার কান দু’টো লাল হয়ে উঠে। নগ্নবক্ষা মেয়েদের ছবিসহ অসংখ্যা মিনি পোস্টার সাঁটা ফোন বুথের চারটা দেয়াল জুড়ে। ‘Want to talk dirty? Call Julie on 0181 992 9245’

রিসিভারটা তুলে কয়েন স্লটে একটা পাউন্ড ঢুকিয়ে দেয় সে। সাথে সাথেই কানে বাজে ডায়াল টোন। তার বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা এতো জোরে লাফাতে শুরু করে, মনে হয় যে কোনো মুহুর্তে বেরিয়ে আসবে। কম্পিত হাতে একে একে কান্ট্রি কোড, সিটি কোড, তারপর নিজের বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করে সে। কয়েক সেকেন্ড পরেই অন্যপ্রান্তে রিং হবার শব্দ শোনা যায়।
***

সাত হাজার মাইল দূরের এক শহরতলীর একটি পাহাড়ের উপরের বাংলো বাড়ির ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। বাড়িটিতে এখন কবরের নিস্তব্ধতা। যখন তখন কেউ উচ্চকন্ঠে হেসে উঠে না, বারান্দায় হেঁটে হেঁটে জীবনানন্দের কবিতা পড়ে না কেউ আর। একদিন সন্ধ্যায় নীরব নিস্তব্ধ বাড়িটির ঠান্ডা নিরবতা ভেংগে হঠাৎ ঝনঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠে। মা, বাবা, কাজের ছেলে, এমনকি বেড়াল ছানাটাও ছুটে যায় ড্রয়িং রুমের দিকে কিন্তু রিসিভার তোলার আগেই রিংএর শব্দ থেমে যায়। মা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন, বাবা রিসিভার তুলে কানে লাগিয়ে দেখেন সব ঠিকঠাক আছে কি’না। বেড়াল বাচ্চাটা ফোনের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। কাজের ছেলেটি দরোজায় পিঠ ঠেকিয়ে অপেক্ষা করে, আবার কখন রিং বাজবে?

খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। একটু পরেই আবার ঝনঝন শব্দ। মা হাত বাড়াতে গেলে বাবা ইশারায় না করেন। তিনবার রিং হবার আগে ধরতে নেই, লাইন কেটে যেতে পারে। কিন্তু দুইবার রিং হবার পর আবার কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারপাশে।
***
সাত হাজার মাইল দূরের লাল রং এর ফোন বুথের ভেতরে দাঁড়িয়ে রিসিভার বুকের কাছে ধরে বুকফাটা কান্নায় ভেংগে পড়ে মেয়েটি। সে জানে তার বাবা-মা ফোনের পাশে বসে আছেন, সে জানে তিনটি রিং হবার আগে তার বাবা কখনো ফোন ধরবেন না। তাই প্রতিবার দু’টো রিং হবার পরই সে লাইন কেটে দেয়, তার মহামূল্যবান একটি পাউন্ড কয়েন স্লট থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসে।

অশ্রুভেজা গালে বিলেতি বসন্তের ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ নিয়ে দোকানের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কষ্টমিশ্রিত এক অদ্ভুত আনন্দে মেয়েটির মন ভিজে যায়। নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে সে। একটি পেনিও খরচ না করে হাজার হাজার মাইল দূরে মা-বাবার কাছে নিজের ভালবাসার ঝংকার পৌঁছে দিয়েছে সে। হোক সে ঝঙ্কার যান্ত্রিক, আপাতত এই সুখটুকু নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাকে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর