মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস তেলিয়াপাড়া বাংলো : মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক

দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল গাজীপুরের জয়দেবপুরে। সেখানে ভাওয়াল রাজাদের রাজপ্রাসাদে আমরা থাকতাম। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদুল হুসেইন খান। ৭১ সালের জানুয়ারিতে আমাদের ব্যাটালিয়নকে তিন ভাগে ভাগ করে দেয় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। দেশব্যাপী নিরাপত্তার অজুহাতে এক ভাগকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ শহরে। আরেকভাগকে টাঙ্গাইলে এবং তৃতীয় ভাগকে পাঠানো হয় জয়দেবপুরে। ৩রা মার্চের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পরিস্থিতি আরও বদলাতে থাকে। তবে ২৬শে মার্চের তিনদিন আগে অধিনায়ক মাসুদুল হুসেইন খানকে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। নতুন একজন বাঙালি অফিসার লে. কর্নেল রাকিবকে আমাদের অধিনায়ক করা হয়। ২৬শে মার্চ দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক লে. কর্নেল রাকিব যে কারণেই হোক আমাদের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ২৭শে মার্চ থেকে উপ-অধিনায়ক মেজর কেএম সফিউল্লাহ অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। সেনাবাহিনীর রেওয়াজ মোতাবেক সর্বকনিষ্ঠ অফিসার দায়িত্ব হলো ইন্টিলিজেন্ট অফিসার হিসেবে অধিনায়ককে সার্বক্ষণিক সহায়তা করা। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমি অধিনায়কের সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিলাম। ২৯শে মার্চ সকালে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জয়দেবপুর এবং রাজেন্দ্রপুরের অংশ সবাই ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে মিলিত হলাম। সেখান থেকে সামরিক পরিকল্পনা হলো। ক্যাপ্টেন মো. মতিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র দলকে পাঠানো হলো নরসিংদীতে। বাকিদেরকে নিয়ে কি করণীয় চিন্তাভাবনা শুরু হলো। সেসময় সংবাদ এলো- চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং কুমিল্লা থেকে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যারা বেরিয়েছেন তারা সবাই বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আছেন। আর আমরা মধ্যাঞ্চলে আছি। আরও খবর পেলাম- পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া এবং সত্তরের নির্বাচনে মেম্বার অব এসেম্বলি নির্বাচিত হওয়া কর্নেল মো. আতাউল গণি ওসমানী কৌশলে দেশত্যাগ করে সীমান্তের ওপারে চলে গেছেন। এসব সংবাদ ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল- বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল অধিনায়ক একত্রিত হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার। রেলওয়ে টেলিফোনের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে সংবাদ পাঠাই। সেখান থেকে আরও দক্ষিণে অষ্টম ইস্টবেঙ্গলে সংবাদ গেল। ইতিমধ্যে আমরা ময়মনসিংহ ত্যাগ করে কিশোরগঞ্জ চলে এসেছি। সিলেটের সন্তান ক্যাপ্টেন মো. আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দলকে পাঠানো হলো সিলেট সুরক্ষার জন্য। ২রা এপ্রিল আমাদের যোগাযোগ পাকাপাকি হয়। একটি বগিতে নিরাপত্তার জন্য সৈন্য, আরেকটি ইঞ্জিনে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ থেকে আমরা রওনা হলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে আমরা নেমে গেলাম। ৪ঠা এপ্রিল সেখান থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চাবাগানের বাংলোতে পৌঁছলাম। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল থেকে মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে ইন্টিলিজেন্স অফিসার হিসেবে আমি ছিলাম। অষ্টম ইস্টবেঙ্গল থেকে মেজর জিয়াউর রহমান ও তার সঙ্গে একজন এবং চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল থেকে মেজর খালেদ মোশাররফ ও তার সঙ্গে দু-তিনজন। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার যারা এদিক-ওদিক ছিলেন তারা সবাই তেলিয়াপাড়া চাবাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে উপস্থিত হন। এখানে উল্লেখ্য, আমি অত্যন্ত কনিষ্ঠ অফিসার ছিলাম। তখন আমি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কেউ ছিলাম না। নীতিনির্ধারক ছিলেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। ৪ঠা এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চাবাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সেটাকে আমরা বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রথম অপারেশনাল কনফারেন্স বা প্রথম অপারেশনাল কো-অর্ডিনেশনাল কনফারেন্স বলতে পারি। এর সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানী। বৈঠকটি দুপুরের দিকে শুরু হয়। বাংলোর ডাইনিং টেবিলে আমরা বসলাম বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে। বিদ্যুৎ না থাকায় ওই দিন হারিকেনের আলো দিয়ে বৈঠক করেছিলাম। বৈঠকে লিখিত কোন এজেন্ডা ছিল না। সেখানে আলোচনা হয়- যুদ্ধটা কিভাবে পরিচালনা করা যায়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল- সমন্বয়হীনভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। যেহেতু পাকিস্তানিরা সমগ্র বাংলাদেশ দখল করেছে। কিন্তু আমরা এই মুহূর্তে পুরো বাংলাদেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু করতে পারব না। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে সমগ্র বাংলাদেশকেই যুদ্ধের আওতায় আনা। এই মুহূর্তে তিনটি ব্যাটালিয়ন যেহেতু পূর্বাঞ্চলে আছি সেহেতু আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়টা করে ফেলি। তখন সিদ্ধান্ত হলো- আপাতত আমরা তিনটি ব্যাটালিয়নকে নিয়ে তিনটি সেক্টরকে ভাগ করে ফেলি। ভবিষ্যতের সেক্টরগুলোর জন্য পরিকল্পনা করে রাখি। যখন অন্যান্য ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ হবে তখন তাদেরকেও সক্রিয় করে ফেলবো। যেহেতু প্রথম বিদ্রোহ করেছিল চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সুতরাং চট্টগ্রাম থেকে ফেনী সীমান্ত এলাকাকে এক নম্বর সেক্টর ঘোষণা করা হলো। মেজর জিয়াউর রহমানকে সেই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ফেনী নদী থেকে আখাউড়ার পর্যন্ত এলাকাকে দুই নম্বর সেক্টর করা হয়। সেই সেক্টরের কমান্ডার করা হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। আখাউড়া থেকে শ্রীমঙ্গল শহর পার হয়ে ভারতের খোয়াই শহর পর্যন্ত তিন নম্বর সেক্টর করা হয়। সেটার কমান্ডার করা হয় মেজর সফিউল্লাহকে। তারপর খোয়াই থেকে সিলেটের সীমান্ত পর্যন্ত চার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত. পাঁচ নম্বরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী, ছয় নম্বর সেক্টরের কমান্ডার করা হয় মেজর কাজী নুরুজ্জামানকে। পরবর্তীতে বাকি সেক্টরগুলো ভাগ করা হয়।

বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়েছিল- প্রথমত. যতদ্রুত সম্ভব কর্নেল ওসমানী বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে চলে যাবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমন্বয় করবেন। তাদের সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালনার জন্য একটি সরকার গঠন করবেন। দ্বিতীয়ত. যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হবেন কর্নেল এমএজি ওসমানী। তৃতীয়ত. যোগাযোগের অসুবিধার জন্য পূর্বাঞ্চলে (আগরতলায়) একটি দ্বিতীয় স্তরের হেডকোয়ার্টার নির্মাণ করা হোক। সেখানে আরেকজন জ্যেষ্ঠ অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রবকে দায়িত্ব দেয়া হয়। চতুর্থত. এমএজি ওসমানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বলবেন- তারা যেন যুদ্ধরত সামরিক মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে থাকায় আমি তিন নম্বর সেক্টরে তেলিয়াপাড়া ও আখাউড়া এলাকায় যুদ্ধ করেছি। তেলিয়াপাড়ার ওই বৈঠকের পর ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে একটি দলকে আশুগঞ্জে মোতায়েন করা হয়। আরও দুটি দলকে শাহবাজপুর ও মাধবপুরে মোতায়েন করা হয়। মে মাসে বাংলার মাটিতে সর্বশেষ যুদ্ধ হয় তেলিয়াপাড়ায়। সেখানে তিনদফা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। বাংলোর চারপাশে আমরা বাংকার তৈরি করি। মে’র শুরুর দিকে হানাদার বাহিনীর একটি আর্টিলারি শেলের গোলা বাংলোর সামনের বটগাছের নিচের বাংকারে এসে পড়ে। এতে সঙ্গে সঙ্গেই সাতজন সহযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। চূড়ান্তপর্বে টিকতে না পেরে তেলিয়াপাড়া ত্যাগ করে আমরা ভারতে চলে যাই। নয় মাস যুদ্ধ করি ওই এলাকায়। ১৬ই ডিসেম্বর রাত ৮টায় ১১টি সেক্টরের মধ্যে আমরা তিন নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর