রোহিঙ্গা সমস্যা—বাংলাদেশের গলার কাঁটা, মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। মিয়ানমারের বৃহৎ জনগণ রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক মনে করে না।
যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে ইমিগ্র্যান্ট হয়েও এখনকার ইমিগ্র্যান্টদের আমেরিকাতে থাকতে দিতে চাচ্ছেন না। এমনকি মেক্সিকানদের তাড়িয়ে দিয়ে সীমান্ত বরাবর স্থায়ী প্রাচীর তুলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। পার্থক্যটা হলো ট্রাম্প হুমকি দিচ্ছেন আর মিয়ানমারের নোবেল বিজয়ী সু চি রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চিকে তার রাষ্ট্রের জাতিগত সমস্যার সমাধান করতে হবে। যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করার পূর্ণ অধিকার প্রতিটি রাষ্ট্রেরই আছে। রাষ্ট্রের যদি সার্বভৌমত্ব না থাকে বা অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা না থাকে তাহলে কোনো রাষ্ট্রেরই শৃঙ্খলা তথা অস্তিত্ব থাকবে না। তাই আমি মনে করি রোহিঙ্গাদের জাতিগত সমস্যা মিয়ানমারের একান্ত অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং এর সমাধান অবশ্যই মিয়ানমারকেই করতে হবে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বাইরের বা প্রতিবেশীর রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই অতিরিক্ত কোনো সমস্যা সৃষ্টি করার অধিকার মিয়ানমার বা কোনো রাষ্ট্রেরই নেই। যদি কোনো রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতে গিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে তাহলে তখন তা কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে না। অতএব, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা এখন আর মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক তথা এক সুদূপ্রসারী সীমান্ত সমস্যা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের নিয়ে এখনই ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে সংকট ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। শতাধিক বছর ধরে বসবাসকারীরা যদি রাষ্ট্রের নাগরিক না হয় তাহলে কোটি কোটি মার্কিনি আমেরিকান নাগরিক থাকতে পারবে না। একজন রেড ইন্ডিয়ান ক্ষমতায় এসে যদি সাদা-কালো সবাইকে মার্কিন মুলুক থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় তখন কি তা বিশ্ববাসী আমেরিকানদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে মেনে নেবে? ইতিমধ্যেই খোদ আমেরিকাতে বৈধ ও অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে যা আগামীতে আরও ব্যাপকতা লাভ করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের বাঁকে এবং প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ান বা নিউজিল্যান্ডের নাগরিক যারা হয়েছেন সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নাগরিকত্ব কি হবে সেই প্রশ্নের জবাব বিশ্ববাসীকেই দিতে হবে। একই সমস্যায় পড়তে হবে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের চাইনিজদের। কাজেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন এ আবদার বিশ্ববাসী কখনোই মেনে নিতে পারে না। কোনো সামরিক শক্তির আদেশে যেমন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নির্ধারিত হতে পারে না তেমনি নোবেল বিজয়ী কোনো মহীয়সী নারী তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারেন না। কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়ন করার অমানবিক সামরিক অভিযান মেনে নিতে পারে না। বিশ্বের যে কেউ বা কোনো রাষ্ট্র যদি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করার সামরিক বর্বরতা সমর্থন করে তাহলে ওই ব্যক্তি বা রাষ্ট্র বিশ্বের ইতিহাসে যুদ্ধবাদী প্রবঞ্চক হিসেবে ঘৃণিত হবে।

সু চি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়েও তার রাষ্ট্রের নাগরিক সমস্যা সমাধানে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে যুদ্ধবাদী মনোভাব প্রকাশ করেছেন তা বিশ্ব সমাজ মেনে নিতে পারে না। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করার জন্য সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সু চিকেই নিতে হবে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বরতার জবাবদিহিতা নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সু চিকেই করতে হবে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সু চি ক্ষমতায় গিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সৃষ্ট রোহিঙ্গা জাতিগত সমস্যার যৌক্তিক সমাধান না করে সামরিক জান্তার পথে হাঁটছে। এটা সু চির জন্য কতটুকু সঠিক হয়েছে তা ইতিহাসই একদিন বিচার করবে। ইতিহাস নির্মমভাবে সাক্ষী দেয় যে সব জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার স্বৈরাচারী পথ বেছে নিয়েছে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জন্য খুব বড় সমস্যা নয়। মিয়ানমার একটি সম্পদশালী রাষ্ট্র যার রয়েছে বিশাল খনিজ, বনজ ও কৃষি সম্পদ। মিয়ানমারের কৃষি উৎপাদনে রোহিঙ্গাদের অবদান অনস্বীকার্য। তা ছাড়া রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ার সুবাদে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার থেকে মিয়ানমারের জন্য ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সম্পদ এবং তাদের দেশ গঠনে ইতিবাচক সুযোগ মিয়ানমার সরকার তথা সু চিকেই করে দিতে হবে। ২ লাখ ৬১ হাজার বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট মিয়ানমারের জনসংখ্যা মাত্র ৫ কোটি ৪৫ লাখ এবং প্রতি বর্গমাইলে মাত্র ২১৫ জন মানুষ বাস করে। সারা বিশ্বে এখন সু চির বিরুদ্ধে ধিক্কার উঠেছে এবং সু চির নোবেল ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ সামরিক বাহিনীকে বর্বরোচিত আচরণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে না। ঘটা করে সামরিক বাহিনীর বর্বরতার ছবি ও ভিডিও দেখানো হচ্ছে কিন্তু সব বর্বরতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে সু চিকে। আমরা সবাই জানি সেনাবাহিনীকে সৃষ্টিই করা হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য। পৃথিবীর সব সভ্য দেশের সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র। সভ্য দেশের সেনাবাহিনী কতটুকু বর্বর তার প্রমাণ বিশ্ববাসী আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বচক্ষে দেখেছে, সে তুলনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তো শিশু। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই বর্বরোচিত আচরণে রোহিঙ্গা সমস্যা বহুমাত্রিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে বহু নিরীহ-নিরপরাধ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এ হত্যার দায়িত্ব অবশ্যই সু চিকে নিতে হবে। নিজের দেশের নাগরিক হত্যার জন্য যদি ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম, ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়াতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের হত্যা করার জন্য যদি সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল আদালতে বিচার হতে পারে তাহলে একই অপরাধের জন্য সু চির বিচার কেন হবে না এই দাবি এখন সারা বিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে। নিরপরাধ নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য জাতিসংঘকে অবশ্যই সু চির বিচার করতে হবে। এই দায়িত্ব জাতিসংঘ এড়াতে পারবে না বলেই বিশ্ববাসীর বিশ্বাস।

রোহিঙ্গার জাতিগত সমস্যায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমন আইনে নিরীহ জনগণের বাসভূমি পোড়ানো জঘন্যতম সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। সু চির সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে জঘন্যতম সন্ত্রাস করছে যার জন্য অবশ্যই সু চিকে আন্তর্জাতিক আদালতে দাঁড় করাতে হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক আদালত সে দায়িত্ব কোনো অবস্থাতেই এড়াতে পারে না বলেই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের বিশ্বাস।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় এড়াতে সু চিকেই রোহিঙ্গাদের জাতিগত সমস্যার সমাধান ইতিবাচকভাবে করতে হবে। রোহিঙ্গারা জন্মগতভাবে মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক এবং তা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যে চক্রটি সু চিকে সামরিক সমাধানের দিকে ঠেলে দিয়েছে তারা এত সহজে তা সমাধান করতে দেবে না। রোহিঙ্গা সমস্যা এখন যতই মানবিক হোক না কেন তা এখন ভূ-রাজনীতির জন্য জটিলতা সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

কোনো রাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং জাতির আত্মমর্যাদা সৃষ্টি হয় না। দুর্বলের পাশে কেউ থাকে না এবং শক্তিমানের বন্ধুর অভাব হয় না। দুর্বলকে অনেক নীতিকথা শুনতে হয় কিন্তু শক্তিমান কোনো নৈতিকতার ধার ধারে না। শক্তিমানের যা প্রয়োজন তা সে আদায় করে নেয়। তাই অনেকে মনে করেন মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদারে বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু মানবিক সহানুভূতি ও ত্রাণ-খয়রাত দিয়ে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধান হবে না। তাতে হয়তো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রিলিফ ধান্দাবাজদের রমরমা ব্যবসা হবে। রোহিঙ্গাদের কোনো কল্যাণ হবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, বেইজিং, চীন থেকে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর