লাল-সবুজের প্রান্তরে উড়ে বিজয়ের নিশান

প্রতিদিন যেমন সূর্য ওঠে, তেমনই সূর্য ওঠেছিল ৪৫ বছর আগে। বাংলার সবুজ প্রান্তরে রক্ত লাল সূর্য বয়ে এনেছিল নতুন বার্তা। এইদিনে বাঙালির হাজার বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছিল। বুকের রক্তে অনেক দাম জাতি পেয়েছিল আপন ঠিকানা- স্বাধীন ভূখণ্ড,সার্বভৌম বাংলাদেশ। এদেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দখলদার পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিয়ে একাত্তরের এইদিনে লাল-সবুজের প্রান্তরে উড়িয়ে দেয় বিজয়ের নিশান। আজও সেই অহংকারের পতাকা উড়ছে পত পত।

বাঙালির সেই মহান বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর আজ। এদেশের মানুষের জন্য গৌরব, অহঙ্কার ও সবচেয়ে আনন্দময় দিন। একাত্তরের এ দিনেই বাঙালি অর্জন করেছিল প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। বিজয়ের এই দিনে মুক্তির জয়গানে মুখর বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আজ স্মরণ করবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, সেই অকুতোভয় বীরদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ বিজয়। যাদের আত্মত্যাগে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৭১’র পৌষের এমনই এক পড়ন্ত বিকেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল বীর বাঙালি। এ এক ঐতিহাসিক বিজয়ের অবিস্মরণীয় দিন। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তৈরি মঞ্চে পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন-বি এবং ইস্টার্ণ কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পন করে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পাকিস্তানী সেনা। লাখো লাখো উৎফুল্ল জনতার সামনে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পন দলিলে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে সই করলেন পাকিস্তানের পক্ষে জেনারেল নিয়াজী ও মিত্রবাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এ সময় মুজিবগর সরকারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। দীর্ঘ জঠর যন্ত্রনা ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর জন্ম নিল একটি নতুন দেশ-‘বাংলাদেশ’।

অভুত এ বিজয় অর্জনে অসীম আত্মত্যাগ করতে হয়েছে বাঙালিকে। ৭১’র ২৫ মার্চ থেকে শেষ দিন পর্যৗল্প পরিকল্পিত ও বর্বরোচিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানী ও এদেশীয় জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের হায়েনারা। টানা নয় মাসে এক কোটিরও বেশি বাঙালিকে ঘর ছাড়া করে তারা। যুদ্ধ শুরুর মাত্র ছয় মাসেই হত্যা ও ধর্ষনের পর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে প্রায় পোনে এক কোটি হিন্দুকে। প্রায় তিন হাজার হিন্দুকে জোরপুর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। নৃশংস সে হত্যাযজ্ঞের নির্দশন হিসেবে এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়েছে ৯শ’ ২০টি বধ্যভুমি। ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজের উপর চালানো হয়েছে বর্বরোচিত হত্যা ও নির্যাতন। শহীদ হন প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ।

আনন্দ-উৎসব ও শোক-শ্রদ্ধায় এক অভুত সম্মিলনে দেশের সর্বত্রই আজ পালিত হবে বিজয় দিবস। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর দিবসটি এসেছে ভিন্ন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। দেশে চলছে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজ। ফাঁসি হয়েছে কয়েক যুদ্ধাপরাধীর। মানুষ এখন আশাবাদী একাত্তরে যারা জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছে তাদের প্রত্যেকের বিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে হবেই হবে।

রাজধানী ঢাকা ও প্রধান শহরগুলো ছাড়িয়ে বিজয় উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়বে নিভৃত গ্রামেও। দেশ সাজবে বিজয়ের সাজে। সুউচ্চ ভবনগুলোর আলোকসজ্জা, আলোকিত করবে প্রাণ। মানুষ নামবে পথে। গালে-কপালে এঁকে লাল সবুজ পতাকা, শিশু হাসবে, হাঁটবে। মেলা বসবে। নাগরদোলা নাচবে। উৎসবের সমারোহে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জাতি স্মরণ করবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, প্রবাসী সরকারের নেতৃবৃন্দ, সেক্টর কামান্ডার আর খ্যাত-অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী, বীর বীরাঙ্গনাদের। স্মরণে, শোকে ও শ্রদ্ধায়, ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে স্মৃতিসৌধ, সমাধি।

আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে সূচনা হবে বিজয় দিবসের কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে প্রত্যুষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢল নামবে সাধারণ মানুষের। বিজয় আবেগে উদ্বেলিত সাধারণ মানুষের ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ আর সকল শহীদ মিনার।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে একাত্তরের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন।

সকাল দশটায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হবে বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ। এতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন।

এছাড়াও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), সিপিবি, ওয়াকার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ রাজধানীর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে।

এর মধ্যে আছে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর