দূর থেকে তাকে আলাদা করা যেত দীর্ঘ কায়ার কারণে

আখতারুজ্জামান আজাদ (ফেসবুক স্ট্যাটাস):

কবি মাহবুবুল হক শাকিল যেদিন ‘মনখারাপের গাড়ি’ নিয়ে বইমেলার ফটক পেরিয়ে প্রথম ঢুকলেন, তার পেছনে ছিল শতাধিক ছাত্রের মিছিল। শত জনের মাঝেও দূর থেকে তাকে আলাদা করা যেত তার দীর্ঘ কায়ার কারণে। জনপরিবেষ্টিত শাকিল অন্বেষা প্রকাশনের সামনে এসে দাঁড়ালেন; অন্বেষা জনারণ্যে ডুবে গেল, অন্বেষা-সংলগ্ন স্টলগুলো কয়েক মিনিটের জন্য স্থবির হলো। শাকিল একে-একে অটোগ্রাফ দিয়ে বই হস্তান্তর করতে লাগলেন, চোখের পলক ফেলতেই বইয়ের স্টক শেষ। পরিচিত কয়েক ক্রেতার হাত থেকে বই নিয়ে দেখলাম আঠাও শুকোয়নি ঠিকমতো, সোজা হয়নি মলাটের মেরুদণ্ড; তবু এক কপি করে বই হস্তগত করতে পেরেই ক্রেতাবর্গ যারপরনাই খুশি। সেদিন টের পেয়েছিলাম মাহবুবুল হক শাকিল কতটা প্রভাব বিস্তারকারী তার দলের নেতাকর্মীদের ভেতরে, আর কতটা কারিশমা লুকিয়ে আছে তার নির্বিকার মুখমণ্ডলে।

কবি শাকিলকে বইমেলায় কখনও একা পাইনি। কখনও তিনি ছিলেন মিছিল-পরিবেষ্টিত, কখনও বা ছিলেন প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সাথে ধূমায়মান চায়ের কাপে আড্ডামুখর। ফলে, কখনও মুখোমুখি আলাপ হয়নি তার সাথে, এমনকি জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময়টুকু ছাড়া তার সাথে ফেসবুকের গোপন কুঠুরিতেও আমার কোনো বাক্যবিনিময় হয়নি। অর্থাৎ কবি শাকিলের সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই, জানি না কেমন তার কণ্ঠস্বর।

এই আকাশ-সংস্কৃতির প্রশস্ত পৃথিবীতে মুখোমুখি আলাপই শেষ কথা নয়। এখানে বছরের পর বছর পরস্পরের লেখা পাঠ করা হয়, লাইকের ছলে বুড়ো আঙুলের অগ্রভাগ মর্দন হয়, তৈরি হয় এক অদৃশ্য মায়াজাল। কবি শাকিল বা আমি সেই জালের বাইরে নই। জাকারবার্গ এমনই জাল পেতেছেন সংসারে।

শাকিল জীবনানন্দ ঘরানার কবি ছিলেন বলেই আমার ধারণা হয়। নৈরাশ্যবাদ, বিচ্ছেদ-বেদনা, হার্দিক হাহাকার, নাগরিক নৈঃশব্দতা— এই উপকরণগুলোই ঘুরে-ফিরে এসে তার নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলোয়। তিনি বেদনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, পানশালায় প্রবোধ খুঁজেছেন, প্রেম নিয়ে পাশা খেলেছেন, দিনকে রাত আর রাতকে দিন করেছেন। সর্বোপরি তিনি মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হয়েছেন, পদে-পদবিতে বড় হয়েও হামিং বার্ডের মতো ছোট থেকেছেন।

বেশ কিছুকাল মৃত্যুচিন্তা তাকে গ্রাস করেছিল বলেই অনুমিত হয়। শেষ কিছুকাল তিনি বস্তুত মৃতাবস্থায় বেঁচে ছিলেন। প্রয়াণের আঠোরো দিন আগে তিনি লিখেছিলেন— ‘জন্ম জন্মান্তর ধরে ঠায় বসে তিমি-শিকারির একাগ্রতায়; রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, আয়ুক্ষয়ের শেষপ্রান্তে এসে।’ প্রয়াণের একদিন আগে লেখা তার কবিতাংশটি তো গোটা গণমাধ্যমজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দাউদাউ দাবানল হয়ে— ‘মৃতদের কান্নার কোনো শব্দ থাকে না, থাকতে নেই; নেই কোনো ভাষা, কবরের কোনো ভাষা নেই। হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাৎ বুকে নিয়ে স্মৃতি, তোমাদের উত্তপ্ত স্মৃতিমুখর রাতে।’ পুরো কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন এক রহস্যমানবীকে নিয়ে, সরাসরি ঐ মানবীর নাম উল্লেখ করে। খ্যাতি আর ক্ষমতার আইভরি টাওয়ারের চূড়ান্ত চূড়ায় থেকে সরাসরি নামউল্লেখপূর্বক কোনো নারীকে নিয়ে এমন কবিতা লেখার স্পর্ধা দেখানো কেবল একজন আপাদমস্তক কবির পক্ষেই সম্ভব, শখের বা খণ্ডকালীন কোনো পদ্যকারের পক্ষে এ রীতিমতো অসম্ভব। সেই মানবীকে উদ্দেশ করেই শাকিল প্রশ্ন ছুড়েছিলেন— ‘কতটা কষ্ট পেলে পুরুষ কবি হয়, নারী কি তা জানে বিলক্ষণ?’

মাত্র গত ফেব্রুয়ারি মাসেই শাকিল লিখেছিলেন— ‘সম্ভবত খুব শীঘ্রই মারা যাব আমি ঘাতকের হাতে, অসাধারণ পরিপক্ব এই হত্যা-ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আমার খুব বেশি ভালো লাগার একজন মানুষ। তাকে একটি পত্র লিখে সিলগালা করে রেখে দিয়েছি খুবই আস্থাভাজন আরেকজনের কাছে, আমি মরে যাওয়ার পর তাকে পৌঁছে দেবে বলে। আমার না-থাকা জুড়ে থাকব আরো বেশি আমি।’ এই পঙক্তিগুলো খেয়ালি শাকিলের কোনো কবিতারই অংশ, নাকি হত্যার ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেও অবিচল থাকার ইশতেহার; তা বের করা গোয়েন্দা সংস্থার কাজ। কবি শাকিলের মহাপ্রস্থানের পর খুব বেশি জানতে ইচ্ছে করছে তার ‘খুব বেশি ভালো লাগার’ সেই ‘একজন মানুষটি’ কে, কে তার সেই ‘আস্থাভাজন আরেকজন’ এবং কী লেখা আছে সেই ‘সিলগালা’ পত্রে।
শুনেছি শাকিল প্রবল ক্ষমতাধর ছিলেন। তার কাছে নাকি অনেকেই যেতেন অনুগ্রহ অন্বেষণে। জানি না কতটা পরাক্রমশালী তিনি ছিলেন। কেবল এটুকু লক্ষ করেছি— তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহযোগী ছিলেন, সেই তথ্যটুকু পর্যন্ত তার ফেসবুক প্রোফাইলে উল্লিখিত ছিল না; উল্লিখিত ছিল না তার পদবিসমগ্র। আমরা যেখানে দেড় ছটাক পদ পেয়ে ফেসবুকে দেড় কুইন্টাল আস্ফালন দেখাই, সেখানে তিনি তার প্রোফাইলকে করে রেখেছিলেন লো-প্রোফাইল; পদবির ভারে ভারাক্রান্ত না হয়ে তিনি ছিলেন নির্ভার, নির্বিকার। তিনি চেয়ারে বসলেও চেয়ার কাঁধে নিয়ে পথ চলেননি।

কবিদের মাঝে এমন দু-একজন থাকা জরুরি— যিনি শব্দের জাদুকরও হবেন, হবেন রাজনৈতিকভাবেও শক্তিধর। সেই কবি অন্যান্য কবি ও সরকারের মধ্যে কাজ করবেন একটা সেতু হিশেবে, কোনো কবি বা শিল্পী বিপদগ্রস্ত হলে তিনি অবগত করতে পারবেন সরকারকে, যাতে সরকার এগিয়ে আসতে পারবে ঐ কবি বা শিল্পীকে রক্ষা করতে। মাহবুবুল হক শাকিল ছিলেন কবি-সাহিত্যিক ও বর্তমান সরকারের মাঝে সেই সেতুটি। সর্বশেষ, কবি হেলাল হাফিজকে প্রধানমন্ত্রীর দরবারে নিয়ে গিয়ে শাকিল চিকিৎসার বন্দোবস্ত করিয়েছিলেন, নেপথ্যে থেকে যুগিয়েছিলেন অনেক কবির পথ্য, পাশে থেকে আগলে রেখেছিলেন অনলাইনের অনেক বিপন্ন কর্মীকেও। শাকিলের প্রয়াণে সেই সেতুটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। এ রকম নতুন আরেকটি সেতু গড়ে উঠতে সময় লাগবে, হয়তো আরো কয়েক যুগ।

আগেই বলেছি পরস্পরের সাথে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও কবি শাকিল বা আমি জালের বা মায়াজালের বাইরে নই। তিনি একবার ফেসবুকে সেকাল-একালের আট-দশজন কবির নাম উল্লেখ করে পোস্ট দিয়ে লিখেছিলেন একটি বাক্য— ‘এই নামগুলো পাশাপাশি সাজালেই দাঁড়িয়ে যায় একটি অনবদ্য কবিতা।’ অবাক করার মতো ব্যাপার হলো সেই আট-দশজনের তালিকায় শাকিল আমার নামটিও রেখেছিলেন।

নিজের কবিতার আবৃত্তির অ্যালবাম দেখে যেতে পারলেন না শাকিল, ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় নিজের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েও শাকিল তা করে যেতে পারলেন না। হিশেব কষলে নিশ্চয়ই তার অসমাপ্ত আরো অসংখ্য কাজের তালিকা তৈরি করতে পারবেন ঘনিষ্ঠজনেরা। তার তৃতীয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামী ৬ ফেব্রুয়ারিই হোক, ঐদিন অন্বেষা পরিণত হোক শাকিলভক্তদের মিলনমেলায়।

ঝিনুককে নীরবে সইতে বলে আবুল হাসান চলে গিয়েছিলেন মাত্র আটাশে; রুদ্র বেঁচে ছিলেন আরো সাত বছর, বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে অভিমানের খেয়ায় চড়ে রুদ্র চলে গিয়েছিলেন পঁয়ত্রিশে। শাকিলের সৌভাগ্য, মনখারাপের গাড়িওয়ালা শাকিল বেঁচে ছিলেন সাতচল্লিশ বছর। অকালমৃত হাসান-রুদ্রদের তুলনায় শাকিলকে সকালমৃতই বলা চলে। মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগেও শাকিল এইভাবে ঘোষণা করেছিলেন আপন মৃত্যুর ইশতেহার— ‘তোমার হেমন্তদিনে আমার বসন্ত আসে ক্রমাগত স্বাদু জিলাপির মতো, ভুলেও অনিকেত আমি ঠিকানা জানি না। এইসব মধুরাত শেষ হয় নিশ্চয় মরণের কালে। আমাদের শরীর মরে যায়, মরে যায় নিকষ অক্ষর, নক্ষত্রশোভিত রাত।’

চলেই গেলেন শাকিল; দেখা হলো না, কথা হলো না জীবিত শাকিলের সাথে। প্রত্যহ পাঁচবার প্রার্থনার মতো মৃত্যুকে ডাকলে মৃত্যু তো আসবেই, যমদূত তো জনমের তরে আলিঙ্গন করবেই, সামদাদোর মোজাইক মেঝেতে তো রচিত হবেই মরণের মোহন কবিতা!

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর