‘সব ফলই ইবার ভালো হইচে মুটামুটি। লিচুডার ফলন খুব ভালো। দেশিডা পাকে গেচে। বোম্বাইডাও কেউ কেউ ঝড়-শীলির ভয়ে একটু কাঁচা থাকতিই ভাঙতিচে।গুনাইগাছায় সেইরাম ভাঙা চলতিচে। উৎসব-উৎসব ভাব সেকেনে! তবে একনো ভয় আছে। যদি ঝড় আর শীল পড়ে, তাহলি সব শেষ।’
কথা হচ্ছিল লিচু বাগানের পেশাদার ব্যাপারী মঞ্জুর রহমানের সঙ্গে। চাটমোহর পৌরসভার কাজীপাড়ার বাসিন্দা তিনি। এবার লিচুর ফলন কেমন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি উল্লিখিত মন্তব্য করেন। গত রোববার ‘লিচুগ্রাম’ নামে খ্যাত গুনাইগাছায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মঞ্জুর রহমানের কথা হয়। চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া সড়ক পথে গুনাইগাছা কালীবাড়ি ছাড়ালেই রাস্তার দু’পাশে লিচু গাছ চোখে পড়ে। গাছে কাঁচা-পাকা থোকা থোকা লিচু ঝুলে আছে। গ্রামে পা রাখতেই ব্যাপারীদের ব্যস্ততা চোখে পড়ল। লিচু গাছ থেকে পাড়া হচ্ছে। স্থানীয় ভাষায় একে ‘গাছ ভাঙা’ বলে। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা সহদেবের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, এবার লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। ঝড় কিংবা শীলাবৃষ্টি খুব একটা ক্ষতি করতে পরেনি। অনেক আগেই ব্যাপারীদের কাছে গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, গাছ থেকে লিচু নামানো হচ্ছে। গাছের নিচে গোল হয়ে বসে নারী-পুরুষ শ্রমিক লিচুর ঝোপার পাতা-ডাল ভাঙছে। গুনেগুনে তারা একশ লিচু আলাদা করে বেঁধে রাখছে। ব্যাপারীরা লিচুগুলো বিশাল ঝুড়িতে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন। সবাই যে যার কাজ করে চলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে তাড়া আছে। আসল কথা হলো, লিচুগুলো নেয়ার জন্য ট্রাক আসবে। তারপর সেই ট্রাকে লিচুগুলো চলে যাব দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এর একটা বড় অংশ যাবে রাজধানীতে। শাহজাদপুরের শক্তিপুর ও তালগাছী এলাকার বাসিন্দা মানিক মিয়া ও শাহজাহান আলী লিচুর ঝুড়ি সাজাতে সাজাতে বললেন, ‘কথা কওয়ার সুময় নাই ভাই। আল্লাহ যদি এবার সহায় থাকে গতবারের লোকসান উঠে যাবিনি। ভালো লিচু আছে এবার। পোকা-মাকরের অত্যাচার আবহাওয়া চড়া থাকায় কম। খালি বাঁদুরের তাপালিং বেশি। সেটা কারেন্ট জাল দিয়ে ঠেকাচ্ছি।’
দীর্ঘদিন লিচুর ব্যবসা করছেন আ. রশীদ। তিনি বলেন, ‘আরো কয়েকদিন পর ভাঙলি দানা ভালো হতো। কিন্তু তাতো হবার নয়। দামটা এখনই বেশি। অল্প সময়ের ফল। উঠা শুরু হলে, দাম কমে যাবে। তাই একটু আগেই ভাঙতিছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে শহরে দেশী ভালো জাতের লিচু ২০০ থেকে ২৫০ টাকা শ বিক্রি হচ্ছে। এ দামে বেচলি লাভ ভালো হবে। তাছাড়া এই লিচুর মান খুবই ভালো। প্রায় বোম্বাই লিচুর মতো।’
উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে গুনাইগাছা ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া, জ্বালেশ্বর, মল্লিকচক, পৈলানপুর, রামচন্দ্রপুর ও নতুনপাড়া গ্রামে রাস্তার ধারে লিচু বাগান বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে। লিচুচাষী নূরুল ইসলাম জানালেন, বাগানগুলো ৩০ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এই বেচাকেনা গাছে মুকুল আসা থেকে লিচু পাকা পর্যন্ত কয়েক দফায় হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার মানুষ এক সময় অসচ্ছল ছিলো। ফসল হতো না জমিতে। চাষাবাদ করে সংসার চলতো না অনেকের। লিচু তাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। এলাকার লিচু চাষীরা প্রায় সবাই এখন সচ্ছল। প্রায় প্রত্যেকের পাকা বাড়ি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে। লিচুচাষী সহদেব মন্ডল বলেন, ‘প্রায় ৩৩ বছর আগে বাবা এলাকায় প্রথম লিচুর বাগান শুরু করেন। তারই দেখানো পথে দুই দশকের মধ্যে আজ এখানে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর বাগান গড়ে উঠেছে। শুধু লিচু নয়, কুল বরইয়ের বাগানও গড়ে উঠেছে এখানে। প্রতি মৌসুমে কোটি টাকার মতো কুল বিক্রি হয়।’
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘শুধু গুনাইগাছা এলাকাটিতেই প্রায় ১০২ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান গড়ে উঠেছে। এলাকাটিকে এখন ‘লিচুগ্রাম’ হিসাবেই মানুষ চেনে। উপজেলার অন্যসব উঁচু এলাকাতেও লিচুচাষ বিস্তৃত হচ্ছে এখন। এটা আশাপ্রদ ব্যাপার। আমরা মাঠ পর্যায়ে তাদের পরামর্শ দিচ্ছি।’
ব্যাপারী জামাল উদ্দিন ও আবুল হোসেন বলেন, ‘এখনো ৫০ ভাগ লিচু ভাঙা বাকি আছে। বলা যাচ্ছে না কি হয়। গত বছর লিচুর সময় ঝড় ও শীলে ক্ষতি হয়। শেষ করে দিয়েছিল চালান-পাতি। এবার ২ কোটি টাকার লিচু বেচাকেনা হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন আলম বলেন, ‘লিচুচাষ লাভজনক বলে প্রতি বছরই বাগান বাড়ছে এলাকায়। ফলে এক সময় ঈশ্বরদীর মতো দেখা যাবে চাটমোহরও লিচুচাষের জন্য দেশে সুখ্যাতি অর্জন করবে।’