হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা। বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই পানির নিচে ডুবে থাকে। জেলা শহর ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যসব অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের জন্য মিঠামইন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জের মরিচখালি পর্যন্ত ৫ হাজার ৬৫১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
কিন্তু ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রকল্পটি গত সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে অজুহাত তোলে গত ২১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে স্থগিত করে দেয়।
প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপন করা হলে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাধা দিয়ে বলেন, ‘হাওরের পরিবেশ নষ্ট করে এমন অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না।’
পাঁচ বছর মেয়াদের প্রকল্পটি ২০২৩ মার্চ থেকে চালু হয়ে আগামী ২০২৮ সালে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই-বাছাইয়ের পরেই একনেক অনুমোদন দিয়েছিল।
হাওরে উড়াল সড়ক পরিবেশবান্ধব কিনা তা নির্ভর করে এর নির্মাণ কৌশল এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের ওপর। উড়াল সড়ক নির্মাণ পরিবেশ-বান্ধব হবে, কারণ এটি হাওরের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও ভূমিরূপকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে ওই সময় ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সরকারের সচিব ড. মোহম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেছিলেন, প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই একনেকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়।
কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এরকম একটি প্রকল্প নেওয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রকল্পে নথিতে বলা হয়েছিল, ‘ভৌগোলিকভাবে হাওর অঞ্চল পশ্চাৎপদ। বছরের ছয় মাস থাকে পানির নিচে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যোগাযোগ ও শিক্ষার দিক থেকে উন্নত নয়। এছাড়া বছরে একবার মাত্র বোরো ফসল হয়। উন্নত রাস্তাঘাট না থাকার কারণে উৎপাদিত ধান বাজারজাত করতে সমস্যা হয়। প্রকল্প এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।’
নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘প্রকল্প এলাকা কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে।’
সাবেক ছয়বারের নির্বাচিত এমপি ও দুবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অবহেলিত, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত ও অনগ্রসর হাওরাঞ্চলকে একটি আধুনিক হাওরাঞ্চল গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এই মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, যা হাওরাঞ্চলের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্রেরও উপযোগী।
কিশোরগঞ্জের হাওরে উড়াল সড়ক বা উড়ালসেতুর প্রধান সুবিধাদি ছিল সব ঋতুতে নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ। এর ফলে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের মতো হাওর এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতো, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তো এবং জেলা সদর ও অন্যান্য এলাকার সাথে সংযোগ সহজ হতো।
স্থগিতকৃত মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে হাওরবাসী যেসব প্রধান সুবিধাদি পেতো –
১. সব ঋতুতে যোগাযোগ: বর্ষাকালে নৌপথের ওপর নির্ভরতা কমতো এবং বছরের যেকোনো সময় স্থলপথে চলাচল করা সম্ভব হতো, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রাকে সহজতর করতো।
২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষি ও অন্যান্য পণ্যের বাজারজাতকরণ সহজ হতো, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতো এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো।
৩. পর্যটন বিকাশ: হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে আসা পর্যটকদের যাতায়াত সহজতর হতো, যা এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশেও সহায়ক।
৪. সংযোগ স্থাপন: ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের মতো হাওর অঞ্চলের সঙ্গে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরসহ অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হতো, যা এলাকার জনবিচ্ছিন্নতা দূর করতো।
৫. সামরিক ও বেসামরিক সুবিধা: মিঠামইন সেনানিবাস পর্যন্ত এই উড়াল সড়ক নির্মিত হওয়ায় সামরিক যোগাযোগ ও জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা পৌঁছানো সহজতর হতো।
উড়াল সড়কটি হাওর জনপদের জন্য অপরিহার্য ছিল যেসব কারণে –
দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ভৌগোলিক কারণেই জনবিচ্ছিন্ন। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যকার প্রভেদ ও বৈষম্য দূর করতে উড়ালসেতু নির্মাণের বিষয়টি কার্যতই অপরিহার্য ছিল।
কেননা, সভ্যতার বিকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এটি বাণিজ্য, সামাজিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়তা করে। দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান, শিক্ষা ও ব্যবসার উন্নতি এবং সামাজিক সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এটি আধুনিক সভ্যতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তা স্থগিত করায় জনমনে নিদারুণ হতাশা ও বিষাদ তৈরি হয়েছে। এছাড়া চরম জন-অসন্তোষ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি তীব্র ক্ষোভও দানা বাঁধছে।
এক্ষেত্রে হাওরবাসী মনে করেন, নগর সভ্যতা যেখানে দিন দিন বিকশিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে উড়ালসেতু নির্মাণ প্রকল্পটি স্থগিত করে তাদের ওপর অবিচারই করা হয়েছে। সেইসাথে সভ্যতা থেকে দূরেও ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাদের।
হাওরবাসীর আশা ছিল, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দীর্ঘদিনের বিড়ম্বনা নিরসন হতো। খুলবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। হাওর হতো প্রচুর ঐশ্বর্যশালী।
তাই, প্রকল্পটির ওপর থেকে স্থগিতাদেশ তোলে নিয়ে পুনর্বহাল ও বাস্তবায়নের দাবি তুলেছেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আধুনিক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত হাওর জনগোষ্ঠী।
Reporter Name 



















