মানব সমাজে অন্যায়, জুলুম, প্রতারণা ও স্বার্থপরতার বিস্তার আজ এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, ন্যায়পরায়ণতার আলো যেন ক্রমেই নিভে যাচ্ছে। অথচ ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা মানবাধিকারের প্রতিটি স্তরকে আল্লাহর হক হিসেবে গণ্য করেছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান, শ্রমিককে প্রাপ্য অধিকার, প্রতিশ্রুতি ও চুক্তিতে বিশ্বস্ততা—সবই ইসলামী নৈতিকতার অঙ্গ। ঠিক এই বিষয়েই মহান আল্লাহ এক ভয়াবহ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, যা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত রয়েছে—
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ قَالَ اللهُ ثَلاَثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ
আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো।
এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোন আযাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর এক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার হতে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২২২৭)হাদিসের ব্যাখ্যা
এই হাদিস ইসলামের ন্যায়বিচারমূলক চেতনার এক গভীর দৃষ্টান্ত।
এতে আল্লাহ তাআলা সরাসরি প্রতিপক্ষ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, অর্থাৎ এদের অপরাধ এত গুরুতর যে, বিচারক হিসেবে আল্লাহ নিজেই বাদীপক্ষ হবেন। পৃথিবীর কোনো আদালতে এর চেয়ে ভয়ংকর অভিযোগ আর হতে পারে না।প্রথম শ্রেণি: প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারী
“رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ” — অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে চুক্তি করে পরে তা ভঙ্গ করে। ইসলাম চুক্তি বা প্রতিশ্রুতিকে এক পবিত্র আমানত হিসেবে গণ্য করে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
‘প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো, কারণ প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা আল-ইসরা, আয়াত : ৩৪)
এখানে ‘আল্লাহর নামে দেওয়া প্রতিশ্রুতি’ মানে হলো—মানুষ যখন আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কোনো অঙ্গীকার করে, তখন তা ভঙ্গ করা কেবল মানবের সঙ্গে প্রতারণা নয়, বরং আল্লাহর সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা। মহানবী (সা.) বলেছেন, “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে—(১) যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, (২) প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে, (৩) আমানত রাখলে খেয়ানত করে।” (বুখারি ও মুসলিম)
আজকের সমাজে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, ব্যবসায়িক চুক্তি ভঙ্গ, রাজনীতিতে কথার অমর্যাদা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। অথচ আল্লাহ বলেন—যে ব্যক্তি তাঁর নামে চুক্তি করে পরে তা ভেঙে দেয়, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর প্রতিপক্ষ হবে।
দ্বিতীয় শ্রেণি: মানব মর্যাদা বিনষ্টকারী
“وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ”— যে স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার দাম খায়। মানব মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। দাসপ্রথা বিলুপ্তির সূচনা করেছিল ইসলামই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ
‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।’ (সুরা আল-ইসরা, আয়াত : ৭০)
মানুষের স্বাধীনতা আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার। কারো শরীর, শ্রম, বা স্বাধীনতা অন্য কেউ কেনাবেচা করতে পারে না।
তবুও কেউ যদি অর্থলোভে বা ক্ষমতার অহংকারে কোনো স্বাধীন মানুষকে দাসের মতো বিক্রি করে, তবে সে এমন পাপ করে, যার বিরুদ্ধে আল্লাহ নিজে দাঁড়াবেন।
ইসলামী ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, কোনো মুসলিম যদি অন্যকে অন্যায়ভাবে দাস বানায়, খলিফা তাৎক্ষণিকভাবে তাকে শাস্তি দিয়েছেন এবং মুক্তি দিয়েছেন বন্দীকে। কারণ, মানব স্বাধীনতা ইসলামি শরীয়তে অপরিবর্তনীয় অধিকার।
তৃতীয় শ্রেণি: শ্রমিকের হক নষ্টকারী
“وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ”— যে শ্রমিককে কাজে লাগায়, তার পরিশ্রম গ্রহণ করে কিন্তু মজুরি দেয় না।
এই শ্রেণিই আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে গেলে, তাদের অধিকার আদায়ে প্রতিবাদ উঠলেই শক্তি প্রয়োগ করা হয়। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন,
أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ
‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দাও।’ (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ২৪৪৩)
ইসলাম শ্রমকে ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে। রাসুল (সা.) নিজে কাঁধে পাথর বহন করেছেন, দাউদ (আ.) নিজ হাতে লোহার বর্ম তৈরি করতেন।
সুতরাং শ্রমিকের হক নষ্ট করা শুধু অর্থনৈতিক অন্যায় নয়—এটি এমন একটি জুলুম, যার বিচারে আল্লাহ স্বয়ং বাদী হবেন।
ভয়াবহ প্রতিদান ও আল্লাহর ন্যায়বিচার
যখন আল্লাহ বলেন, “আমি তার প্রতিপক্ষ হবো”—এর মানে এই নয় যে, আল্লাহ কেবল সাক্ষ্য দেবেন; বরং তিনি নিজেই বাদীপক্ষ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার করবেন।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ
‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক (অন্যায়কারীদের জন্য) ওঁত পেতে আছেন।’ (সুরা আল-ফজর, আয়াত: ১৪)
এই হাদিস মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়—জীবনের প্রতিটি অন্যায়, প্রতারণা ও অধিকার হরণ শুধু আইনি অপরাধ নয়; এটি এক আধ্যাত্মিক দায়, যার বিচারে আল্লাহ নিজে নেমে আসবেন।
যেদিন কোনো প্রভাব, অর্থ, বা পরিবার নয়—শুধু ন্যায়বিচারের পাল্লা ভারি হবে।
এই হাদিস কেবল তিন শ্রেণির মানুষের নাম উল্লেখ করেছে, কিন্তু এর শিক্ষার পরিধি বহুদূর প্রসারিত। এটি আমাদের শেখায়—
কারণ, যে অন্যের হক মারে, সে আসলে আল্লাহর বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। আর যার বিরুদ্ধে আল্লাহ নিজেই প্রতিপক্ষ হন—তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত—উভয়ই ধ্বংস।