ঢাকা ০১:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হাদিসের কথা আল্লাহর সাথে শরীক করার ভয়াবহতা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৩২:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫
  • ৩৬ বার
মানবসভ্যতার ইতিহাসে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি একাই গোটা যুগের চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাওহীদের প্রতীক, শিরকের অন্ধকারে আলোর দিশারি। কিন্তু তাঁর নিজ পিতা—আযর—ছিলেন মূর্তি নির্মাতা ও উপাসক। ইবরাহীম (আঃ) তাঁকে বারবার সত্যের পথে আহ্বান করেছেন, কিন্তু পিতা শিরকেই অনড় ছিলেন।

কিয়ামতের ময়দানে এই পিতা-পুত্রের পুনর্মিলনের এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা পাই সহীহ বুখারীতে বর্ণিত এক হাদিসে-

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَلْقَى إِبْرَاهِيْمُ أَبَاهُ آزَرَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَى وَجْهِ آزَرَ قَتَرَةٌ وَغَبَرَةٌ فَيَقُوْلُ لَهُ إِبْرَاهِيْمُ أَلَمْ أَقُلْ لَكَ لَا تَعْصِنِيْ فَيَقُوْلُ أَبُوْهُ فَالْيَوْمَ لَا أَعْصِيكَ فَيَقُوْلُ إِبْرَاهِيْمُ يَا رَبِّ إِنَّكَ وَعَدْتَنِيْ أَنْ لَا تُخْزِيَنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ فَأَيُّ خِزْيٍ أَخْزَى مِنْ أَبِي الأَبْعَدِ فَيَقُوْلُ اللهُ تَعَالَى إِنِّيْ حَرَّمْتُ الْجَنَّةَ عَلَى الْكَافِرِيْنَ ثُمَّ يُقَالُ يَا إِبْرَاهِيْمُ مَا تَحْتَ رِجْلَيْكَ فَيَنْظُرُ فَإِذَا هُوَ بِذِيْخٍ مُلْتَطِخٍ فَيُؤْخَذُ بِقَوَائِمِهِ فَيُلْقَى فِي النَّارِ

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আঃ) তার পিতা আযরের দেখা পাবেন। আযরের মুখমণ্ডল ে কালি এবং ধূলাবালি থাকবে। তখন ইবরাহীম (আঃ) তাকে বললেন, আমি কি পৃথিবীতে আপনাকে বলিনি যে, আমার অবাধ্যতা করবেন না? তখন তাঁর পিতা বলবে, আজ আর তোমার অবাধ্যতা করব না।

অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) আবেদন করবেন, হে আমার রব! আপনি আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছিলেন যে, হাশরের দিন আপনি আমাকে লজ্জিত করবেন না। আমার পিতা রহম হতে বঞ্চিত হবার চেয়ে বেশী অপমান আমার জন্য আর কী হতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কাফিরদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। পুনরায় বলা হবে, হে ইবরাহীম! তোমার পদতলে কী? তখন তিনি নীচের দিকে তাকাবেন। হঠাৎ দেখতে পাবেন তাঁর পিতার জায়গায় সর্বাঙ্গে রক্তমাখা একটি জানোয়ার পড়ে রয়
এর চার পা বেঁধে জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলা হবে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৫০)হাদিসের ব্যাখ্যা

এই হাদিসটি বহু প্রাচীন ব্যাখ্যাকার ও মুহাদ্দিসগণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা একমত যে, আযর ঈমানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এবং ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া তাঁর মুক্তির কারণ হতে পারেনি। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাকে ‘লজ্জিত না করার’ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এক বিশেষ হিকমতের মাধ্যমে।

ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন: 

“এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইবরাহিম (আ.)-এর পিতা আযর কাফির অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন।

যদিও ইবরাহিম (আ.) দুনিয়ায় তাঁর জন্য ইস্তেগফার করেছিলেন, কিন্তু যখন আল্লাহ ঘোষণা করলেন যে, সে কাফির, তখন তিনি দোয়া বন্ধ করেন।”তিনি আরও বলেন:  “আযরকে জানোয়ারে রূপান্তরিত করা হয়েছিল যেন ইবরাহিম (আ.)-এর চোখে তাঁর পিতার দুঃখজনক পরিণতি না আসে এবং তাঁর মন ব্যথিত না হয়। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতিশ্রুতি ‘তোমাকে লজ্জিত করব না’ পূর্ণ করেছেন।” (ফাতহুল বারী, খণ্ড ৬, পৃ. ৪৭৮)

ইমাম নববী (রহ.) বলেন

ইমাম নববী ‘শরহ সহীহ মুসলিম’-এ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন— “ইবরাহিম (আ.)-এর আখিরাতের এই আবেদন আসলে তাঁর পিতার মুক্তির জন্য নয়, বরং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল। কারণ তিনি জানতেন, কাফিরের জন্য রহমত নেই। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, আল্লাহ যেন প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা করেন।”

তিনি আরও বলেন: “আযরকে পশুর রূপে পরিণত করা তাঁর অপমানের প্রতীক, এবং এইভাবে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে কুফর ও শিরকের পরিণতি হিসেবে।”  (শরহ সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৮৬)

ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন

প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী বলেন— “ইবরাহিম (আ.) তাঁর পিতার জন্য ইস্তেগফার করেছিলেন এক প্রতিশ্রুতির কারণে— ‘সা-আস্তাগফিরুল্লাাহা লাকা’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৪৭)। কিন্তু যখন নিশ্চিত হলেন যে, তিনি আল্লাহর শত্রু হয়ে মারা গেছেন, তখন সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এই হাদিস প্রমাণ করে যে, আযর ঈমান আনেননি এবং আখিরাতে মুক্তি পাবেন না।”

তিনি আরও বলেন—
“আযরের জানোয়ারে রূপান্তর একটি প্রতীকী ঘটনা— যাতে ইবরাহিম (আ.)-এর মনে আর মানবিক কষ্ট না থাকে। সেই রূপে তাঁকে আর পিতা বলে চিনতে পারবেন না।” (আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন, সূরা আত-তাওবা: ১১৪)

ইবনে তায়মিয়্যা (রহ.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি

শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়্যা বলেন— “এই হাদিস কুরআনের আয়াতেরই বাস্তব ব্যাখ্যা: ‘ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এক প্রতিশ্রুতির কারণে; কিন্তু যখন বুঝলেন যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১১৪)”

“আযরকে পশুর রূপে পরিণত করা আল্লাহর হিকমতেরই প্রকাশ;  যাতে ইবরাহিম (আ.) লজ্জিত না হন এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণ থাকে।” (মাজমু’ ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃ. ৩২৮)

ইবনে কাসীর (রহ.)-এর তাফসির

বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসীর রহ. বলেন— “এই হাদিস ইঙ্গিত দেয় যে, আযরকে আখিরাতে এক ভয়াবহ রূপে উপস্থাপন করা হবে। ইবরাহিম (আ.) দুনিয়ায় ভেবেছিলেন, হয়তো তিনি একদিন ঈমান আনবেন। কিন্তু যখন কুফরে মারা গেলেন, তখন আল্লাহ ঘোষণা করলেন— ‘কাফেরদের জন্য জান্নাত হারাম।’” (তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, সূরা আত-তাওবা: ১১৪)

হাদিস থেকে আমাদের নৈতিক ও ঈমানি শিক্ষা

১. কাফেরের জন্য শাফা‘আত গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ বলেন— “আল্লাহর নিকটে সুপারিশ কেবল তাঁর অনুমতি প্রাপ্তদের জন্যই গ্রহণযোগ্য।”  (সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬)

২. আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সর্বদা সত্য। আল্লাহ ইবরাহিম (আ.) লজ্জিত করেননি; বরং এমন এক দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন যেখানে তাঁর পিতা আর মানুষ হিসেবে পরিচিত নয়।

৩. ঈমানের সীমার বাইরে আত্মীয়তা মূল্যহীন। রক্তের সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক, কুফর সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। পবিত্র  কোরআনে আছে—“যদি তারা তোমার সঙ্গে আমার ব্যাপারে জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও লড়াই করে, তবে তাদের অনুসরণ করো না।”  (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৫)

৪. দোয়ার সীমা ঈমান পর্যন্ত। মুসলমান তার অমুসলিম আত্মীয়ের জন্য দুনিয়াবি কল্যাণের দোয়া করতে পারে— যেমন স্বাস্থ্য, হেদায়াত ও নিরাপত্তা। কিন্তু মৃত্যুপরবর্তী ক্ষমা প্রার্থনা করা জায়েজ নয়। এর স্পষ্ট প্রমাণই এই হাদিস।

এই হাদিস মানবজাতির জন্য এক গভীর বাস্তব শিক্ষা বহন করে।
হযরত ইবরাহিম (আ.) ছিলেন আল্লাহর খলিল—প্রিয়তম বন্ধু। তবুও তাঁর পিতা আযরকে মুক্ত করতে পারেননি। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর ন্যায়বিচার সর্বোচ্চ, এবং শিরক ও কুফর কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমার যোগ্য নয়।

এই হাদিস শুধু আখিরাতের এক করুণ দৃশ্য নয়, বরং এ পৃথিবীর মানুষকে এক কঠোর সত্য স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঈমানই হচ্ছে সেই সম্পর্কের বন্ধন যা আল্লাহর নিকটে গণ্য, আর কুফর সেই বন্ধন যা সবকিছু ছিন্ন করে দেয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

হাদিসের কথা আল্লাহর সাথে শরীক করার ভয়াবহতা

আপডেট টাইম : ১১:৩২:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫
মানবসভ্যতার ইতিহাসে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি একাই গোটা যুগের চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাওহীদের প্রতীক, শিরকের অন্ধকারে আলোর দিশারি। কিন্তু তাঁর নিজ পিতা—আযর—ছিলেন মূর্তি নির্মাতা ও উপাসক। ইবরাহীম (আঃ) তাঁকে বারবার সত্যের পথে আহ্বান করেছেন, কিন্তু পিতা শিরকেই অনড় ছিলেন।

কিয়ামতের ময়দানে এই পিতা-পুত্রের পুনর্মিলনের এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা পাই সহীহ বুখারীতে বর্ণিত এক হাদিসে-

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَلْقَى إِبْرَاهِيْمُ أَبَاهُ آزَرَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَى وَجْهِ آزَرَ قَتَرَةٌ وَغَبَرَةٌ فَيَقُوْلُ لَهُ إِبْرَاهِيْمُ أَلَمْ أَقُلْ لَكَ لَا تَعْصِنِيْ فَيَقُوْلُ أَبُوْهُ فَالْيَوْمَ لَا أَعْصِيكَ فَيَقُوْلُ إِبْرَاهِيْمُ يَا رَبِّ إِنَّكَ وَعَدْتَنِيْ أَنْ لَا تُخْزِيَنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ فَأَيُّ خِزْيٍ أَخْزَى مِنْ أَبِي الأَبْعَدِ فَيَقُوْلُ اللهُ تَعَالَى إِنِّيْ حَرَّمْتُ الْجَنَّةَ عَلَى الْكَافِرِيْنَ ثُمَّ يُقَالُ يَا إِبْرَاهِيْمُ مَا تَحْتَ رِجْلَيْكَ فَيَنْظُرُ فَإِذَا هُوَ بِذِيْخٍ مُلْتَطِخٍ فَيُؤْخَذُ بِقَوَائِمِهِ فَيُلْقَى فِي النَّارِ

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আঃ) তার পিতা আযরের দেখা পাবেন। আযরের মুখমণ্ডল ে কালি এবং ধূলাবালি থাকবে। তখন ইবরাহীম (আঃ) তাকে বললেন, আমি কি পৃথিবীতে আপনাকে বলিনি যে, আমার অবাধ্যতা করবেন না? তখন তাঁর পিতা বলবে, আজ আর তোমার অবাধ্যতা করব না।

অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) আবেদন করবেন, হে আমার রব! আপনি আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছিলেন যে, হাশরের দিন আপনি আমাকে লজ্জিত করবেন না। আমার পিতা রহম হতে বঞ্চিত হবার চেয়ে বেশী অপমান আমার জন্য আর কী হতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কাফিরদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। পুনরায় বলা হবে, হে ইবরাহীম! তোমার পদতলে কী? তখন তিনি নীচের দিকে তাকাবেন। হঠাৎ দেখতে পাবেন তাঁর পিতার জায়গায় সর্বাঙ্গে রক্তমাখা একটি জানোয়ার পড়ে রয়
এর চার পা বেঁধে জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলা হবে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৫০)হাদিসের ব্যাখ্যা

এই হাদিসটি বহু প্রাচীন ব্যাখ্যাকার ও মুহাদ্দিসগণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা একমত যে, আযর ঈমানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এবং ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া তাঁর মুক্তির কারণ হতে পারেনি। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাকে ‘লজ্জিত না করার’ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এক বিশেষ হিকমতের মাধ্যমে।

ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন: 

“এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইবরাহিম (আ.)-এর পিতা আযর কাফির অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন।

যদিও ইবরাহিম (আ.) দুনিয়ায় তাঁর জন্য ইস্তেগফার করেছিলেন, কিন্তু যখন আল্লাহ ঘোষণা করলেন যে, সে কাফির, তখন তিনি দোয়া বন্ধ করেন।”তিনি আরও বলেন:  “আযরকে জানোয়ারে রূপান্তরিত করা হয়েছিল যেন ইবরাহিম (আ.)-এর চোখে তাঁর পিতার দুঃখজনক পরিণতি না আসে এবং তাঁর মন ব্যথিত না হয়। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতিশ্রুতি ‘তোমাকে লজ্জিত করব না’ পূর্ণ করেছেন।” (ফাতহুল বারী, খণ্ড ৬, পৃ. ৪৭৮)

ইমাম নববী (রহ.) বলেন

ইমাম নববী ‘শরহ সহীহ মুসলিম’-এ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন— “ইবরাহিম (আ.)-এর আখিরাতের এই আবেদন আসলে তাঁর পিতার মুক্তির জন্য নয়, বরং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল। কারণ তিনি জানতেন, কাফিরের জন্য রহমত নেই। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, আল্লাহ যেন প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা করেন।”

তিনি আরও বলেন: “আযরকে পশুর রূপে পরিণত করা তাঁর অপমানের প্রতীক, এবং এইভাবে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে কুফর ও শিরকের পরিণতি হিসেবে।”  (শরহ সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৮৬)

ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন

প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী বলেন— “ইবরাহিম (আ.) তাঁর পিতার জন্য ইস্তেগফার করেছিলেন এক প্রতিশ্রুতির কারণে— ‘সা-আস্তাগফিরুল্লাাহা লাকা’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৪৭)। কিন্তু যখন নিশ্চিত হলেন যে, তিনি আল্লাহর শত্রু হয়ে মারা গেছেন, তখন সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এই হাদিস প্রমাণ করে যে, আযর ঈমান আনেননি এবং আখিরাতে মুক্তি পাবেন না।”

তিনি আরও বলেন—
“আযরের জানোয়ারে রূপান্তর একটি প্রতীকী ঘটনা— যাতে ইবরাহিম (আ.)-এর মনে আর মানবিক কষ্ট না থাকে। সেই রূপে তাঁকে আর পিতা বলে চিনতে পারবেন না।” (আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন, সূরা আত-তাওবা: ১১৪)

ইবনে তায়মিয়্যা (রহ.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি

শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়্যা বলেন— “এই হাদিস কুরআনের আয়াতেরই বাস্তব ব্যাখ্যা: ‘ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এক প্রতিশ্রুতির কারণে; কিন্তু যখন বুঝলেন যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১১৪)”

“আযরকে পশুর রূপে পরিণত করা আল্লাহর হিকমতেরই প্রকাশ;  যাতে ইবরাহিম (আ.) লজ্জিত না হন এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণ থাকে।” (মাজমু’ ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃ. ৩২৮)

ইবনে কাসীর (রহ.)-এর তাফসির

বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসীর রহ. বলেন— “এই হাদিস ইঙ্গিত দেয় যে, আযরকে আখিরাতে এক ভয়াবহ রূপে উপস্থাপন করা হবে। ইবরাহিম (আ.) দুনিয়ায় ভেবেছিলেন, হয়তো তিনি একদিন ঈমান আনবেন। কিন্তু যখন কুফরে মারা গেলেন, তখন আল্লাহ ঘোষণা করলেন— ‘কাফেরদের জন্য জান্নাত হারাম।’” (তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, সূরা আত-তাওবা: ১১৪)

হাদিস থেকে আমাদের নৈতিক ও ঈমানি শিক্ষা

১. কাফেরের জন্য শাফা‘আত গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ বলেন— “আল্লাহর নিকটে সুপারিশ কেবল তাঁর অনুমতি প্রাপ্তদের জন্যই গ্রহণযোগ্য।”  (সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬)

২. আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সর্বদা সত্য। আল্লাহ ইবরাহিম (আ.) লজ্জিত করেননি; বরং এমন এক দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন যেখানে তাঁর পিতা আর মানুষ হিসেবে পরিচিত নয়।

৩. ঈমানের সীমার বাইরে আত্মীয়তা মূল্যহীন। রক্তের সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক, কুফর সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। পবিত্র  কোরআনে আছে—“যদি তারা তোমার সঙ্গে আমার ব্যাপারে জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও লড়াই করে, তবে তাদের অনুসরণ করো না।”  (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৫)

৪. দোয়ার সীমা ঈমান পর্যন্ত। মুসলমান তার অমুসলিম আত্মীয়ের জন্য দুনিয়াবি কল্যাণের দোয়া করতে পারে— যেমন স্বাস্থ্য, হেদায়াত ও নিরাপত্তা। কিন্তু মৃত্যুপরবর্তী ক্ষমা প্রার্থনা করা জায়েজ নয়। এর স্পষ্ট প্রমাণই এই হাদিস।

এই হাদিস মানবজাতির জন্য এক গভীর বাস্তব শিক্ষা বহন করে।
হযরত ইবরাহিম (আ.) ছিলেন আল্লাহর খলিল—প্রিয়তম বন্ধু। তবুও তাঁর পিতা আযরকে মুক্ত করতে পারেননি। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর ন্যায়বিচার সর্বোচ্চ, এবং শিরক ও কুফর কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমার যোগ্য নয়।

এই হাদিস শুধু আখিরাতের এক করুণ দৃশ্য নয়, বরং এ পৃথিবীর মানুষকে এক কঠোর সত্য স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঈমানই হচ্ছে সেই সম্পর্কের বন্ধন যা আল্লাহর নিকটে গণ্য, আর কুফর সেই বন্ধন যা সবকিছু ছিন্ন করে দেয়।