ভারতের সব দল ঢাকায় এক মঞ্চে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ফের এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে। গত ২২ অক্টোবর এ উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিংশতিতম সম্মেলন প্রাঙ্গণে বহু বিদেশি অতিথির সমাগম হয়েছিল। তার মধ্যে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে বললে অত্যুক্তি হয় না। এমন ঘটনা ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে কখনোই দেখা যায়নি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে দেখাও যাবে কি-না সন্দেহ। সেই বিরল রাজনৈতিক মিলনমেলার প্রাঙ্গণ হয়ে রইল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

ভারতে এক মঞ্চে কংগ্রেস ও বিজেপি নেতাদের উপস্থিত হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। বামপন্থিরা সত্তর দশকে ভারতে জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে এবং পরে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে অটল বিহারি বাজপেয়ি-লালকৃষ্ণ আদভানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর থেকে বিজেপি বামপন্থিদের কাছে অচ্ছুত হয়ে গেছে। তাই ইদানীং ভারতে বিজেপিবিরোধী দলগুলোর একত্রে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর সঙ্গে সহাবস্থান অলীক কল্পনা। কিন্তু ঢাকায় সেই রাজনৈতিক দূরত্ব মুছে গেল। কবির ভাষায় ‘মেলালেন তিনি মেলালেন।’ এই তিনি আর কেউ নন; আওয়ামী লীগের পুনর্নির্বাচিত সভানেত্রী শেখ হাসিনা। যার কুশলী নেতৃত্ব ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছে এক অনন্য নিদর্শন। এমনকি ভারতীয় নেতারা এক সুরে বলেছেন শেখ হাসিনা এখন দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রনেতা।

ভারতের প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর রাজনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলন হয়ে থাকে। কিন্তু এমন আকর্ষণ কোনো রাজনৈতিক দল অনুভব করে না, যেমনটা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে হয়েছে। ভারতের বর্তমান শাসক বিজেপি দলের সহসভাপতি ড. বিনয় প্রভাকর সহস্রবুদ্ধের সঙ্গে একই সম্মেলনে উপস্থিত বিরোধী জাতীয় কংগ্রেস দলের রাজ্যসভার নেতা গোলাম নবী আজাদ। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের সঙ্গে শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্ক অহি-নকুল বললে অত্যুক্তি হয় না। আওয়ামী লীগের কারণেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যমন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই মঞ্চ থেকে বক্তব্য রাখলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বিমান বসু। বক্তব্য রেখেছেন আসামের আগপ নেতা প্রফুল্ল মহন্ত, এনসিপির মজিদ মেনন এবং মিজো ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের নেতা।

সবচেয়ে উল্লেখ্য বিষয় হলো, ভারতীয় সব নেতাই এক সুরে কথা বলেছেন। জাতীয় সর্বসম্মতির এমন বহিঃপ্রকাশ কবে ঘটেছিল, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তা স্মরণে আনতে পারছেন না। জাতীয় কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা এবং বিজেপি মুখপাত্র সিদ্ধার্থনাথ সিং একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের সব রাজনৈতিক দল এক সুরে সমর্থন করেছিল বাংলাদেশিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি। সেই ‘ট্র্যাডিশন’ এখনও অব্যাহত রয়েছে_ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের বিরোধী বিএনপির অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ মন্তব্য করছেন না। তবে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের কোনো নেতা বা নেত্রী বিরোধী বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে বিশেষ বার্তা পৌছে দিয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। সফররত কোনো কোনো দেশের নেতারা বিএনপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

সাবেক কূটনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্পর্কে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বসম্মতি রয়েছে তার প্রমাণ দেখা মিলেছিল পার্লামেন্টে যখন ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনী বিতর্কের সময়। এমন সর্বসম্মতির ঘটনা বিরল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ঢাকা সফর করেছিলেন, তখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে সেই বিতর্কের অডিও-ভিডিও টেপ উপহার দিয়েছিলেন। তারই সম্প্রসারিত ভাবনা মূর্ত হয়েছিল এবারের বিংশতিতম অধিবেশনের সময়ে। কেবল জাতীয় স্তরের নেতারাই নন; পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসাম-মেঘালয় থেকেও আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীরা উপস্থিত হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে যেসব ভারতীয় নেতা-নেত্রী ভাষণ দিয়েছিলেন; দিলি্লতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে সেগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল। বিস্ময়ের বিষয়, দু’একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যম ব্যতীত গণমাধ্যমগুলো আশ্চর্যজনকভাবে এই বড় ধরনের রাজনৈতিক সমাবেশের বিষয়ে নীরব ছিল। এমন উপেক্ষার ঘটনা কূটনীতিবিদদেরই ভাবিয়ে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলো তুলনামূলক বেশি সংবাদ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যে বিরল নজির সৃষ্টি করেছিল, সে বিষয়টি অনুলি্লখিত থেকে গেছে। দক্ষিণ ভারতের নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস শেখ হাসিনার সভানেত্রী পদে পুনর্নির্বাচনের সংবাদ প্রকাশ করলেও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতির কথা অনুপস্থিত থেকে গেছে। জন্মু থেকে প্রকাশিত ডেইলি এক্সসেলসার কংগ্রেস নেতা গোলাম নবী আজাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মোলাকাত গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেখানেও অন্য দলের উপস্থিতির কথা উহ্য থেকে গেছে।

বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের সর্বসম্মতি থাকলেও যে প্রশ্নটি মৌলিক হয়ে উঠেছে দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হবে কি-না? ভারতের স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার সচেতন। সে বিষয়টি বারবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখ থেকেও উঠে আসছে। বাংলাদেশের বিষয়গুলো সম্পর্কে ভারত সরকার সমধিক সহানুভূতিশীল নয় এই কথাগুলো বাংলাদেশের বিরোধী দল ব্যবহার করতে চাইছে। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য মওদুদ আহমদসহ আরও অনেক বিএনপি নেতা ভারতে এসে সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বারবার বলতে চাইছেন, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কাছে আরও বেশি প্রত্যাশা করে। তারা এমন কথাও বলেছেন (যা প্রকাশিত হয়েছে), ভারত সরকার যেন কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সম্পর্ক না রাখে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো সরকারের রঙ দেখে সম্পর্ক বজায় রাখে না এটাই জবাবে বলেছে। বাংলাদেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেয়, তারা কোন সরকারকে নির্বাচিত করবে। নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই ভারত সরকার সম্পর্ক রাখবে এটাই ভারত সরকারের ঘোষিত নীতি। দিলি্লতে সরকার বদল হলেও সেই নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না।

যতটা ভারত সরকার, কূটনীতিবিদ, রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে আগ্রহ দেখায়, ততটা কিন্তু আজও ভারতের প্রধান সংবাদমাধ্যম দেখায় না এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রচার বিভাগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দিল্লির হাইকমিশনের অনেক বেশি তৎপর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভারতের ইংরেজি দৈনিকগুলোর তুলনায় হিন্দি দৈনিকগুলোর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশাসন কেবল ইংরেজি অথবা বাংলা ভাষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হলেই সন্তুষ্ট বোধ করে। ভারতের মতো বহুভাষী দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্যের প্রভূত অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ যে ভারতের জন্য অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্র এই সহজ সত্য সম্পর্কে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম অবহিত নয় এটাই বাস্তব। এখনও হিন্দি সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব দেয় সন্ত্রাসবাদ এবং তথাকথিত অনুপ্রবেশ। অথচ বাংলাদেশ বহু সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নে ভারতের চেয়েও এগিয়ে সেই তথ্য ভারতের সংবাদমাধ্যম জানে না। জানে না বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি হার চলতি বছরে ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। খাদ্যে বাংলাদেশ আজ স্বনির্ভর।

আওয়ামী লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ভারতের সবক’টি রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির পরে বাংলাদেশের বকেয়া সমস্যাগুলোর সমাধান হবে এমন একটা প্রত্যয় তৈরি হয়েছে। এ কথাটাই আরও জোরালোভাবে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর