আমিও সেই সমাজেরই একজন, আমাকে ক্ষমা করবেন

আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল ঘিরে নেতাকর্মীদের চাওয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশের রাজনীতিতে ফের সক্রিয়া না হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন সাবেক সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ।গতকাল তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে দেয়া এক বার্তায় তিনি নেতাকর্মীদের ভালোবাসা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সবাইকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। ভবিষ্যতেও ভালো কাজের উদ্যোগে সবার সহযোগিতা পাবেন সে আশাবাদও জানিয়েছেন সোহেল তাজ। এর আগে কাউন্সিল উপলক্ষে তিনি দেশে আসায় নেতাকর্মীরা আশায় বুক বেধেছিলেন। সবার আশা ছিল, সোহেল তাজ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসছেন। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কাউন্সিল শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তিনি।

এসব নিয়েই সোহেল তাজ ফেসবুকে দেয়া ওই বার্তায় বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে আপনাদের মন্তব্যগুলো আমি মনযোগের সঙ্গে পড়েছি। আমার প্রতি আপনাদের অনুভূতি, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি যদি আপনাদের কাউকে কোনো কারণে কষ্ট দিয়ে থাকি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। সেটা কখনই আমার উদ্দেশ্য ছিল না।’

তিনি আরও লেখেন, ‘আমার কাছে এও প্রতীয়মান হয়েছে যে, আপনারা অনেকেই আমার প্রতি ভালোবাসার কারণে আমাকে অনেক প্রশংসা করেছেন, সেজন্য আমি অভিভূত এবং কৃতজ্ঞ। যদিও জানি না আমি এই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য কি না। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ভুল-ত্রুটি, চড়াই-উৎরাই নিয়েই একটি মানুষ। আর সেই মানুষকে নিয়েই সমাজ। আমিও সেই সমাজেরই একজন। তবে আমার ব্যক্তি জীবনে এবং রাজনীতির প্রাঙ্গণে আমি সব সময় চেষ্টা করেছি আমার বাবা ও মা’র আদর্শ বুকে ধারণ করে নিজেকে পরিচালনা করতে।’

সোহেল তাজ বলেন, ‘আমি আপনাদের সবার কাছে দোয়া চাই যেন ভবিষ্যৎ জীবনে যাই করি না কেন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা সামাজিক কাজ, তা যেন সৎ ও স্বচ্ছভাবে করতে পারি।’

নিজ বক্তব্য দেয়ার পর সোহেল তাজ রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালে লেখা একটি খোলা চিঠি সংযুক্ত করেন।

নিচে তা হুবহু তুলে ধরা হল-

অনেক কষ্ট করে গড়ে তোলা সুন্দর একটি জীবন ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কৈশোর বয়স থেকে নিজে দিনরাত কাজ করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। বাবা-মায়ের দেয়া শিক্ষা, দেশপ্রেম থেকেই দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে সবকিছু ছেড়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলাম। প্রথমে সামাজিকভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। আর্সেনিক নিয়ে সচেতনতার কাজও অনেক করেছি। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরেছি দিনের পর দিন।

বাবা ও মায়ের রাজনৈতিক সহকর্মীদের পরামর্শ এবং কাপাসিয়ার মানুষের অনুরোধেই আমার সক্রিয় রাজনীতিতে আসা। তাঁরা আমাকে বুঝিয়েছিলেন, রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে আরও ভালো করে দেশের মানুষের জন্য কাজ করা সম্ভব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও শরীরে বয়ে চলা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের রক্তই আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিতে এবং দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে।

ক্ষমতা, অর্থসম্পদ, খ্যাতি প্রতিপত্তির জন্য আমি রাজনীতিতে যোগ দিইনি। যদি উদ্দেশ্য তা-ই হতো, তাহলে সবকিছু মেনে নিয়ে এখনও এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ আঁকড়ে থাকতাম। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাকে বাকি জীবন এই লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রাখেন। নিজের দলীয় ও তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি করা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ২০০১ সালের নির্বাচনে কাপাসিয়ার মানুষের ভালোবাসায় প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলাম।

দুর্ভাগ্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আমার কাপাসিয়ার মানুষের ওপর বিএনপি-জামায়াত জোটের চলতে থাকে একের পর এক হামলা, মামলা ও নির্যাতন। প্রতিবাদে কাপাসিয়ার সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলি। বিএনপি-জামায়াতের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন আমার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী যুবলীগের সভাপতি জালাল উদ্দীন সরকার। পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে জামাল ফকিরকে।

এসবের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ অনশন করতে গিয়ে বারবার পুলিশের নির্মম হামলার শিকার হয়েছি। বস্তুত বিএনপি-জামায়াতের পাঁচটি বছর হামলা, মামলা ঠেকাতে আমাকে বেশির ভাগ সময় রাজপথ ও আদালত প্রাঙ্গণে সময় কাটাতে হয়েছে। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেকে জড়াইনি। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে যা আয় হতো, তাই দিয়েই চলত আমার রাজনীতি। এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিও বিক্রি করেছি রাজনীতির জন্য। খুব সাদামাটা সাধারণ জীবনযাপন করেছি।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের কর্মকাণ্ড আমাকে হতাশ করলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের যুগোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার আমাকে রাজনীতিতে আরও বেশি উত্সাহিত করে। যে ইশতেহারটি ছিল প্রগতিশীল ও দিনবদলের একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকার। আশাবাদী হই, একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির।

যে সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ পাবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা, উদীচী ও একুশে আগস্ট হত্যাকাণ্ড, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া ও অাহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। বাংলাদেশ হবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা—সব মিলিয়ে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম।

আর তাই যে মন্ত্রণালয় কেউ নিতে চায়নি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসে সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এই দায়িত্বটি ছিল শুধু মন্ত্রিত্ব নয়, একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব অপরিসীম। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বের অনেকটাই ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আমার সব সময়ই চেষ্টা ছিল পুলিশ বাহিনীকে একটি সুশৃঙ্খল পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে জনগণের বন্ধু করে তোলা।

মন্ত্রিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সেই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কতটুকু পেরেছি বা কেন পারিনি, সে কথায় না গিয়ে শুধু এইটুকু বলতে চাই, আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি, সব সময় অনিয়ম ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। সেটা যে-ই করুক না কেন। যতটুকু সম্ভব আমি আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে চেষ্টাও করেছিলাম। সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়াও শুরু করতে সহযোগিতা করেছিলাম।

কথার পেছনে অনেক কথা থাকে। অনেক লুকায়িত সত্য থাকে। যা দেশ, জনগণ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে জনসম্মুখে বলা উচিত না। আর তা সম্ভবও নয়। শুধু এইটুকু বলি, আমি ‘সংগত’ কারণেই এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। যে কয়দিন দায়িত্বে ছিলাম, মন্ত্রিত্বের শপথ থেকে বিচ্যুত হইনি। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্নীতি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সোচ্চার ছিলাম।

যখন মনে করেছি, আমার সীমিত ক্ষমতায় জনগণের প্রতি দেয়া কমিটমেন্ট আর রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। কারণ পদ বা ক্ষমতার লোভে আমি রাজনীতিতে আসিনি। যদি তা-ই হতো তাহলে মন্ত্রিত্বের লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে প্রবাসে চাকরির জীবন বেছে নিতাম না। অর্থসম্পদ বা ক্ষমতার বিন্দুমাত্র মোহ আমার নেই।

আমার কাপাসিয়াবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা, ভালোবাসা, স্নেহ—আমার জন্য এলাকার মানুষের ত্যাগ স্বীকার, আবেগ এই সবকিছু চিন্তা করার পরও বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।

কাপাসিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কারণ কাপাসিয়ার মানুষের মর্যাদা ও সম্মান আমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি জানি, আমার এই সিদ্ধান্তে আপনারা ক্ষুব্ধ ও অভিমানী হবেন, প্রতিবাদ করবেন। কারণ যে ভালোবাসা ও সম্মান আপনারা আমাকে দিয়েছেন, এই সম্মানের ওপর কোনো কালিমা পড়ুক, তা আমি চাই না।

সংগত কারণেই সবকিছু খুলে বলতে পারছি না। এই কাপাসিয়ার মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক। এই কাপাসিয়ার মাঠে-ঘাটেই বেড়ে উঠেছেন আমার বাবা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। সেই মাটির গন্ধ আমার গায়েও। তাঁর আদর্শ নিয়েই আমার পথচলা। কাপাসিয়ার মানুষের জন্য অনেক কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই আমি প্রবাস-জীবনের ইতি টেনেছিলাম। আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ভালোবাসা ও দোয়া পেয়েছি। এর প্রতিদান হয়তো ততটুকু দিতে পারিনি। তবে সেই চেষ্টা আমার সব সময় ছিল।

আমি এইটুকু বলতে চাই, সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও আপনাদের পাশে থাকব সব সময়। হয়তো অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনো পথে। এই প্রতিজ্ঞা করছি। সক্রিয় রাজনীতিতে পুনরায় আসার সম্ভাবনা না থাকলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদের আদর্শে গড়া আওয়ামী লীগই আমার শেষ ঠিকানা। কারণ এই দলটির সঙ্গে আমার বাবার রক্ত মিশে আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েছেন। কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত করেননি। জীবন দিয়েও তা প্রমাণ করে গেছেন।

কাপাসিয়ায় আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী যাঁরা আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার, জেল-জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলব, আমি সব সময় যেটা আপনাদের বলে এসেছি, তা হচ্ছে ব্যক্তি-স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির রাজনীতি বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মতো নীতি-আদর্শের রাজনীতি করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী কাপাসিয়ার নেতৃত্ব যেন ভালো মানুষের দ্বারা পরিচালিত হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। কাপাসিয়ার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা সেই পথে এগিয়ে যান। আপনাদের সবার মতো আমিও তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে। হয়তো একদিন সুস্থ একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ হবে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী একটি দেশ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর