ঢাকা ০৫:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাগলপন্থী আন্দোলন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৫৭:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৬
  • ৩৩৬ বার

পাগলপন্থী আন্দোলন (১৮২৫-১৮৩৩) দীউয়ানি উত্তর যুগে (১৭৬৫ সালের পর থেকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলে জনগণের, বিশেষ করে কৃষক সমাজের উপর কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের মুৎসুদ্দি, কর্মকর্তা ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ আন্দোলন। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয়, ভূমি-সংক্রান্ত এবং ধর্মীয়। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

শেরপুরসহ উত্তর ময়মনসিংহ বাংলার মূলস্রোত থেকে নানাভাবে ছিল বিচ্ছিন্ন। এ অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতিও জাতিগত বৈশিষ্ট্য মূলত গারো, হাজং, ডলু, হুদি এবং রাজবংশী প্রভৃতি পাহাড়ি গোত্র দ্বারা প্রভাবিত। তাদের প্রধান ধর্ম ছিল প্রকৃতি পূজা। কালক্রমে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যায় এবং এ অঞ্চলে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক অল্প অল্প করে বসতি স্থাপন শুরু করে। যুগ যুগ ধরে অঞ্চলটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্রোহীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের কাজ করছিল।
বিদ্রোহের নিদর্শন

ময়মনসিংহে ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন সংস্কার ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। ঐতিহাসিক ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন একটি ঘর আজো আছে। এলাকাবাসী যার নামকরণ করেছেন ‘বিবির ঘর’ হিসেবে।

করিম শাহ ছিলেন পাগলপন্থী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। গোত্রীয়ভাবে সম্ভবত তিনি ছিলেন পাঠান এবং ১৭৭৫ সালের দিকে তিনি উত্তর ময়মনসিংহ জেলার সুশং পরগনার লেতারকান্দা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি ইসলামের এক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা দেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রচারে আকৃষ্ট হয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও প্রকৃতিপূজারী ছিল।

করিম শাহের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ছিল সহজ ও সাদাসিধা। তিনি শিক্ষা দেন যে, মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি, সুতরাং তারা সবাই সমান এবং পরস্পর ভাই ভাই। এ কারণে করিম শাহের অনুসারীগণ একে অপরকে ভাই সাহেব বলে সম্বোধন করত। সমতল অঞ্চলের লোকদের নিকট তাদের আচার আচরণ অদ্ভুত ও বিদঘুটে ঠেকত। ‘ভাই সাহেব’দের এজন্য সমতলের লোকেরা পাগল বলে ডাকত এবং করিম শাহ ও তাঁর অনুসারীদের কাজকর্ম ও প্রচার প্রচারণা পাগলপন্থী আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। সকল ধর্মের অহিংস উপাদানের সমন্বয়ে পাগলপন্থীদের ধ্যানধারণা তৈরি হয় এবং এগুলি কৃষকদের সনাতনী ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

করিম শাহ একান্তভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং জনগণ বিশ্বাস করত যে, তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন এবং অনুসারীদের মতে, তিনি রোগ নিরাময় ও তাদের ভাগ্য উন্নয়নের ক্ষমতা রাখতেন। বহুসংখ্যক লোক তাঁর সাহচর্য লাভের প্রত্যাশী ছিল। তারা তাঁর সঙ্গে অবস্থান করত এবং নানাভাবে তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকত। বিভিন্ন গোত্র ও দল থেকে আসা অনুসারীদের জন্য বসবাসের পৃথক পৃথক ব্যবস্থা ছিল।

১৮১৩ সালে করিম শাহ পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ ওরফে টিপু পাগল উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থীদের নেতৃত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনে চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়। পাগল ও তাদের সহযোগিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য জমিদার ও কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশ্য ১৮৩৩ সাল নাগাদ আন্দোলন বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এর পূর্বে কৃষকদের করুণ অবস্থা প্রশমনের ক্ষেত্রে এ আন্দোলন খানিকটা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে, অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেওয়া হয়।

টিপু শাহের পর (মৃত্যু ১৮৫২) জাকু পাথর ও দোবরাজ পাথর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাগলপন্থীগণ শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুঠ ও থানা দখল করে এবং থানার অস্ত্রশস্ত্র পুড়িয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের শাসক বলে ঘোষণা করে। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ময়মনসিংহ শহরে আশ্রয় নেয়। কিছু দিনের জন্য কোম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

পাগলপন্থী আন্দোলন

আপডেট টাইম : ০২:৫৭:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

পাগলপন্থী আন্দোলন (১৮২৫-১৮৩৩) দীউয়ানি উত্তর যুগে (১৭৬৫ সালের পর থেকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলে জনগণের, বিশেষ করে কৃষক সমাজের উপর কোম্পানির রাজস্ব বিভাগের মুৎসুদ্দি, কর্মকর্তা ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ আন্দোলন। সমকালীন অন্যান্য আন্দোলনের মতো এটি প্রকৃতিগতভাবে ছিল বিক্ষিপ্ত, সহজাত, অপরিকল্পিত, স্থানীয়, ভূমি-সংক্রান্ত এবং ধর্মীয়। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি পরিচালিত হয় জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

শেরপুরসহ উত্তর ময়মনসিংহ বাংলার মূলস্রোত থেকে নানাভাবে ছিল বিচ্ছিন্ন। এ অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতিও জাতিগত বৈশিষ্ট্য মূলত গারো, হাজং, ডলু, হুদি এবং রাজবংশী প্রভৃতি পাহাড়ি গোত্র দ্বারা প্রভাবিত। তাদের প্রধান ধর্ম ছিল প্রকৃতি পূজা। কালক্রমে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যায় এবং এ অঞ্চলে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক অল্প অল্প করে বসতি স্থাপন শুরু করে। যুগ যুগ ধরে অঞ্চলটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্রোহীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের কাজ করছিল।
বিদ্রোহের নিদর্শন

ময়মনসিংহে ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন সংস্কার ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। ঐতিহাসিক ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন একটি ঘর আজো আছে। এলাকাবাসী যার নামকরণ করেছেন ‘বিবির ঘর’ হিসেবে।

করিম শাহ ছিলেন পাগলপন্থী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। গোত্রীয়ভাবে সম্ভবত তিনি ছিলেন পাঠান এবং ১৭৭৫ সালের দিকে তিনি উত্তর ময়মনসিংহ জেলার সুশং পরগনার লেতারকান্দা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি ইসলামের এক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা দেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রচারে আকৃষ্ট হয়। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও প্রকৃতিপূজারী ছিল।

করিম শাহের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ছিল সহজ ও সাদাসিধা। তিনি শিক্ষা দেন যে, মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি, সুতরাং তারা সবাই সমান এবং পরস্পর ভাই ভাই। এ কারণে করিম শাহের অনুসারীগণ একে অপরকে ভাই সাহেব বলে সম্বোধন করত। সমতল অঞ্চলের লোকদের নিকট তাদের আচার আচরণ অদ্ভুত ও বিদঘুটে ঠেকত। ‘ভাই সাহেব’দের এজন্য সমতলের লোকেরা পাগল বলে ডাকত এবং করিম শাহ ও তাঁর অনুসারীদের কাজকর্ম ও প্রচার প্রচারণা পাগলপন্থী আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। সকল ধর্মের অহিংস উপাদানের সমন্বয়ে পাগলপন্থীদের ধ্যানধারণা তৈরি হয় এবং এগুলি কৃষকদের সনাতনী ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

করিম শাহ একান্তভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং জনগণ বিশ্বাস করত যে, তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন এবং অনুসারীদের মতে, তিনি রোগ নিরাময় ও তাদের ভাগ্য উন্নয়নের ক্ষমতা রাখতেন। বহুসংখ্যক লোক তাঁর সাহচর্য লাভের প্রত্যাশী ছিল। তারা তাঁর সঙ্গে অবস্থান করত এবং নানাভাবে তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকত। বিভিন্ন গোত্র ও দল থেকে আসা অনুসারীদের জন্য বসবাসের পৃথক পৃথক ব্যবস্থা ছিল।

১৮১৩ সালে করিম শাহ পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ ওরফে টিপু পাগল উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থীদের নেতৃত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনে চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়। পাগল ও তাদের সহযোগিগণ জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য জমিদার ও কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশ্য ১৮৩৩ সাল নাগাদ আন্দোলন বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এর পূর্বে কৃষকদের করুণ অবস্থা প্রশমনের ক্ষেত্রে এ আন্দোলন খানিকটা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে, অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেওয়া হয়।

টিপু শাহের পর (মৃত্যু ১৮৫২) জাকু পাথর ও দোবরাজ পাথর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাগলপন্থীগণ শেরপুর শহরে প্রবেশ করে জমিদার বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুঠ ও থানা দখল করে এবং থানার অস্ত্রশস্ত্র পুড়িয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের শাসক বলে ঘোষণা করে। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ময়মনসিংহ শহরে আশ্রয় নেয়। কিছু দিনের জন্য কোম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়।