ঢাকা ০২:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কি অধরাই রয়ে যাবে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২৩:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
  • ১২ বার

ঘটনার শুরুটা ছিল ৫ জুন, ২০২৪। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আবার বহাল হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন ছাত্ররা। সেদিন বিকেলে বিষ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে উঠে বিখ্যাত স্লোগান—‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা।’

প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী। সেখান থেকে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সমাবেশ করেন তারা। সমাবেশ থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম। দাবি ছিল— ২০১৮ সালের সরকারি প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে হবে।

অর্থের উৎস নিয়ে ছাত্রদল-শিবিরের পাল্টাপাল্টি, সংগঠনগুলোর আয়ের উৎস কোথায়? - খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর

এরপর আন্দোলনে আন্দোলনে জুলাইয়ের প্রথমার্ধে ঢাকার রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের অবরোধ-বিক্ষোভ জোরদার হয়। ১১ জুলাই হাইকোর্ট জানান, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারে। আন্দোলন যখন আরও তীব্র হয়, পুলিশ সতর্কবার্তা দেয় আর মন্ত্রীরা আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেয়— শুরু দেশের ইতিহাসে অভুতপূর্ব আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড’। কয়েকটি জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটে।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা হামলা চালালে আন্দোলন আরও জোরালো হয়। এরপর ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাইদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এ ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। পরদিন ১৭ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত চলে টানা বিক্ষোভ। স্বৈারাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে একের পর এক চলে ছাত্রদের ওপর গুলি। এতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ জনতার মাঝেও। কোটা পুনর্বহালের দাবি ততদিনে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

ক্ষমতা ধরে রাখতে পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব এমনকি সেনাবাহিনী দিয়ে ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালায় হাসিনা সরকার। দেশব্যাপী রক্ত ঝরে হাজারো ছাত্র-জনতার। তবে শেষ রক্ষা হয়নি স্বৈরাচার খুনি শাসকদের। প্রায় দুই হাজার শহীদ ও ১০ হাজারের বেশি আহতের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্ট ২০২৪ সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। এতে পতন ঘটে রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা সরকারের।

জুলাই ঘোষণাপত্র না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

এক বছর পর আবারও জুলাই এসে হাজির। আজ সোমবারের রাতটি পোহালেই কাল সকাল থেকে শুরু হবে সেই ঐতিহাসিক জুলাই মাস। এক বছর পর এই মাসে ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদ ঘোষণা করবে সরকার- এই আশায় আছেন জুলাই অভ্যুত্থানের শরিক সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে, সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতায় এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে, জুলাইয়ের মধ্যে অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বা সনদ পাওয়া যাবে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারির সংগঠকেরা।

নিজেরাই জুলাই সনদ ঘোষণা করব : নাহিদ ইসলাম

জুলাই আন্দোলনের একটি লিখিত দলিল ‘ঘোষণাপত্র ও সনদ’ চেয়ে বারবার দাবি জানিয়ে আসছে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো।

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' কি জনতার মুক্তির সনদ হবে?

সনদ ঘোষণার দাবিতে সবচেয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সোমবার (৩০ জুন) বিকেলে ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শহীদদের অবদান, নেতৃত্বের ভূমিকা ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার সংজ্ঞায়ন। এটি একটি জাতীয় দলিল হয়ে সংবিধানিক ভিত্তি পাবে।

তিনি জানান, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রনেতৃত্ব ঘোষণাপত্র দিতে চাইলেও সরকার সব পক্ষের সম্মতিতে তা জারি করতে চায় বলে উদ্যোগটি স্থগিত রাখা হয়। সরকার একাধিকবার সময় বেঁধে দিলেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে খসড়া দলিল দেওয়া হলেও সমন্বিত একটি দলিল এখনো আসেনি।

নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকার যদি আর উদ্যোগ না নেয়, তবে আমরা নিজ উদ্যোগে ইশতেহার প্রকাশ করব। চাই, সব পক্ষ নিজেদের খসড়া তৈরি করুক— সবার সম্মিলনে রাষ্ট্রীয় ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করতে সরকার বাধ্য হবে।

জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধান নিয়ে কী ভাবনা? - BBC News বাংলা

তিনি জানান, শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকেই জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।

সনদ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা থাকবে। সংবিধানে কোথায় পরিবর্তন আসবে, তা নির্ধারণে রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল হবে এই সনদ। গণভোট, গণপরিষদ অথবা সংসদীয় প্রক্রিয়ায় তা কার্যকর হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের (৩৬ জুলাই) মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ প্রকাশ করতে না পারলে সরকারের পক্ষে জুলাই উদযাপন করার নৈতিক অধিকার থাকবে না।

রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একটি স্বীকৃতিপত্রের দরকার আছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও জুলাই ঘোষণাপত্রের কোনো নাম-নিশানা আমরা দেখি না। তারা একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমরা আন্দোলন করেছি, আবার একটি জুলাই চলে এসেছে কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো আশার আলো দেখিনি।

জুলাই ঘোষণাপত্র কবে, সংবিধান নিয়ে কী থাকছে সেখানে?

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে একত্রিতভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা বারবার দেখেছি একটি গোষ্ঠী বা একটি রাজনৈতিক দল সেটাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এটি না হলে আবার ফ্যাসিবাদ ফিরে আসলে যারা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল সবার গলায় ফাঁসি ঝুলবে। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল এটাকে গণঅভ্যুত্থান বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না। রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে।

ইনকিলাব মঞ্চের বক্তব্য

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ দাবি করে সবচেয়ে বেশি সরব থাকা অরাজনৈতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ। তাদের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি বলেন, একটি বছর কেটে গেলেও রক্তাক্ত জুলাইয়ের স্বীকৃতি এখনো আসেনি। রক্ত, জীবন, শারীরিক পঙ্গুত্ব, দুঃস্বপ্ন— সবকিছুর মূল্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতা ও কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বীকৃতি যদি না আসে, তবে নতুন বাংলাদেশ গড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

জুলাই ঘোষণাপত্র কবে, সংবিধান নিয়ে কী থাকছে সেখানে?

তিনি বলেন, জুলাইয়ে আমরা যেটা আশা করেছিলাম, তা হলো নতুন বাংলাদেশ, ইনসাফভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র, যেখানে কেউ আর স্বৈরাচার হতে পারবে না। সেই কাঙ্ক্ষিত রূপরেখা হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র— যেটি এখনো অধরা। মানুষ আবারও অধিকার আদায়ের জন্য প্রস্তুত।

ছাত্রনেতাদের প্রশ্ন এখন একটাই— ঘোষণাপত্র ও সনদ কি শুধু প্রতিশ্রুতির ফাঁদেই পড়ে রইবে নাকি ৫ আগস্টের আগে জাতিকে সেই সুস্পষ্ট দলিল, পথচলার সেই নতুন দিকনির্দেশনাটি উপহার দেওয়া হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কি অধরাই রয়ে যাবে

আপডেট টাইম : ১২:২৩:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

ঘটনার শুরুটা ছিল ৫ জুন, ২০২৪। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আবার বহাল হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন ছাত্ররা। সেদিন বিকেলে বিষ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে উঠে বিখ্যাত স্লোগান—‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা।’

প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী। সেখান থেকে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সমাবেশ করেন তারা। সমাবেশ থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম। দাবি ছিল— ২০১৮ সালের সরকারি প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে হবে।

অর্থের উৎস নিয়ে ছাত্রদল-শিবিরের পাল্টাপাল্টি, সংগঠনগুলোর আয়ের উৎস কোথায়? - খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর

এরপর আন্দোলনে আন্দোলনে জুলাইয়ের প্রথমার্ধে ঢাকার রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের অবরোধ-বিক্ষোভ জোরদার হয়। ১১ জুলাই হাইকোর্ট জানান, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারে। আন্দোলন যখন আরও তীব্র হয়, পুলিশ সতর্কবার্তা দেয় আর মন্ত্রীরা আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেয়— শুরু দেশের ইতিহাসে অভুতপূর্ব আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড’। কয়েকটি জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটে।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা হামলা চালালে আন্দোলন আরও জোরালো হয়। এরপর ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাইদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এ ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। পরদিন ১৭ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত চলে টানা বিক্ষোভ। স্বৈারাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে একের পর এক চলে ছাত্রদের ওপর গুলি। এতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ জনতার মাঝেও। কোটা পুনর্বহালের দাবি ততদিনে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

ক্ষমতা ধরে রাখতে পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব এমনকি সেনাবাহিনী দিয়ে ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালায় হাসিনা সরকার। দেশব্যাপী রক্ত ঝরে হাজারো ছাত্র-জনতার। তবে শেষ রক্ষা হয়নি স্বৈরাচার খুনি শাসকদের। প্রায় দুই হাজার শহীদ ও ১০ হাজারের বেশি আহতের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্ট ২০২৪ সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। এতে পতন ঘটে রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা সরকারের।

জুলাই ঘোষণাপত্র না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

এক বছর পর আবারও জুলাই এসে হাজির। আজ সোমবারের রাতটি পোহালেই কাল সকাল থেকে শুরু হবে সেই ঐতিহাসিক জুলাই মাস। এক বছর পর এই মাসে ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদ ঘোষণা করবে সরকার- এই আশায় আছেন জুলাই অভ্যুত্থানের শরিক সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে, সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতায় এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে, জুলাইয়ের মধ্যে অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বা সনদ পাওয়া যাবে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারির সংগঠকেরা।

নিজেরাই জুলাই সনদ ঘোষণা করব : নাহিদ ইসলাম

জুলাই আন্দোলনের একটি লিখিত দলিল ‘ঘোষণাপত্র ও সনদ’ চেয়ে বারবার দাবি জানিয়ে আসছে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো।

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' কি জনতার মুক্তির সনদ হবে?

সনদ ঘোষণার দাবিতে সবচেয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সোমবার (৩০ জুন) বিকেলে ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শহীদদের অবদান, নেতৃত্বের ভূমিকা ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার সংজ্ঞায়ন। এটি একটি জাতীয় দলিল হয়ে সংবিধানিক ভিত্তি পাবে।

তিনি জানান, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রনেতৃত্ব ঘোষণাপত্র দিতে চাইলেও সরকার সব পক্ষের সম্মতিতে তা জারি করতে চায় বলে উদ্যোগটি স্থগিত রাখা হয়। সরকার একাধিকবার সময় বেঁধে দিলেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে খসড়া দলিল দেওয়া হলেও সমন্বিত একটি দলিল এখনো আসেনি।

নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকার যদি আর উদ্যোগ না নেয়, তবে আমরা নিজ উদ্যোগে ইশতেহার প্রকাশ করব। চাই, সব পক্ষ নিজেদের খসড়া তৈরি করুক— সবার সম্মিলনে রাষ্ট্রীয় ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করতে সরকার বাধ্য হবে।

জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধান নিয়ে কী ভাবনা? - BBC News বাংলা

তিনি জানান, শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকেই জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।

সনদ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা থাকবে। সংবিধানে কোথায় পরিবর্তন আসবে, তা নির্ধারণে রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল হবে এই সনদ। গণভোট, গণপরিষদ অথবা সংসদীয় প্রক্রিয়ায় তা কার্যকর হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের (৩৬ জুলাই) মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ প্রকাশ করতে না পারলে সরকারের পক্ষে জুলাই উদযাপন করার নৈতিক অধিকার থাকবে না।

রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একটি স্বীকৃতিপত্রের দরকার আছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও জুলাই ঘোষণাপত্রের কোনো নাম-নিশানা আমরা দেখি না। তারা একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমরা আন্দোলন করেছি, আবার একটি জুলাই চলে এসেছে কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো আশার আলো দেখিনি।

জুলাই ঘোষণাপত্র কবে, সংবিধান নিয়ে কী থাকছে সেখানে?

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে একত্রিতভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা বারবার দেখেছি একটি গোষ্ঠী বা একটি রাজনৈতিক দল সেটাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এটি না হলে আবার ফ্যাসিবাদ ফিরে আসলে যারা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল সবার গলায় ফাঁসি ঝুলবে। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল এটাকে গণঅভ্যুত্থান বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না। রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে।

ইনকিলাব মঞ্চের বক্তব্য

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ দাবি করে সবচেয়ে বেশি সরব থাকা অরাজনৈতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ। তাদের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি বলেন, একটি বছর কেটে গেলেও রক্তাক্ত জুলাইয়ের স্বীকৃতি এখনো আসেনি। রক্ত, জীবন, শারীরিক পঙ্গুত্ব, দুঃস্বপ্ন— সবকিছুর মূল্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতা ও কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বীকৃতি যদি না আসে, তবে নতুন বাংলাদেশ গড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

জুলাই ঘোষণাপত্র কবে, সংবিধান নিয়ে কী থাকছে সেখানে?

তিনি বলেন, জুলাইয়ে আমরা যেটা আশা করেছিলাম, তা হলো নতুন বাংলাদেশ, ইনসাফভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র, যেখানে কেউ আর স্বৈরাচার হতে পারবে না। সেই কাঙ্ক্ষিত রূপরেখা হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র— যেটি এখনো অধরা। মানুষ আবারও অধিকার আদায়ের জন্য প্রস্তুত।

ছাত্রনেতাদের প্রশ্ন এখন একটাই— ঘোষণাপত্র ও সনদ কি শুধু প্রতিশ্রুতির ফাঁদেই পড়ে রইবে নাকি ৫ আগস্টের আগে জাতিকে সেই সুস্পষ্ট দলিল, পথচলার সেই নতুন দিকনির্দেশনাটি উপহার দেওয়া হবে।