ঢাকা ০১:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের উদ্যোগ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৭:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৩৯ বার
আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর তিন বছর পূর্তি হবে। এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হলেও সেগুলো খুব একটা কার্যকর পথে অগ্রসর হয়নি। মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের পক্ষ থেকে এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ সে রকমভাবে ছিল না। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রই এই যুদ্ধকে বন্ধের পরিবর্তে তা জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল এবং সেই লক্ষ্যে ইউক্রেনকে যাবতীয় অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তা দিয়ে এসেছে।

যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় রাশিয়াকে। এটাও ঠিক যে রাশিয়াই এটা শুরু করেছিল, সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে এই যুদ্ধ শুরু না করলে এত দিনে ইউক্রেন হয়তো পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হয়ে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে রাশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এত দিন ধরে ক্রিমিয়াকে দখলে রাখা নিয়ে রাশিয়ার যে দম্ভ রয়েছে, সেখানে হয়তো বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারত। আসলে সব কিছু বিবেচনা করে দেখলে এই যুদ্ধ শুরু করাটা রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি অনিবার্য বাস্তবতা ছিল।
একইভাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই যুদ্ধকে পশ্চিমা স্বার্থের অনুকূলে এক প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তিন বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্বে এসেই এটিকে অপ্রয়োজনীয় এবং মার্কিন স্বার্থের প্রতিকূল হিসেবে বিবেচনা করছেন।দায়িত্ব গ্রহণের আগেই এবং নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই ট্রাম্প এই যুদ্ধ বন্ধে তার উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এই যুদ্ধ হতেই দিতেন না এবং দায়িত্ব পেলে এক দিনের মধ্যে এই যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন প্রায় এক মাস হতে চলল।
এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ না হলেও যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিও যে এই যুদ্ধ থেকে মুক্তি চান এমন আকুতিও উঠে এসেছে ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই। দুই পক্ষই ট্রাম্পের মধ্যস্থতার অপেক্ষায় ছিলেন। এবার সে অপেক্ষার অবসান হতে চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প তাঁর উদ্যোগ শুরু করেছেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেন। এই আলোচনায় পুতিনের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করা হয়েছে। পুতিনের সঙ্গে আলোচনার পর ট্রাম্প কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গেও। সেখান থেকেও একই বার্তা পেয়েছেন তিনি। তবে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে এর প্রক্রিয়া কি হবে তা এখনো অজানা। তার পরও ধারণা করা যায় যে এর জন্য ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে কিছু মূল্য চুকাতে হবে। এর কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দিক থেকে। ইউক্রেনের আর ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হচ্ছে না, বিষয়টি এরই মধ্যে তাদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে রাশিয়ার দিক থেকে পাল্টা হামলার ঝুঁকি মোকাবেলায় ইউক্রেনকে কী ধরনের প্রতিরক্ষামূলক সমর্থন দেওয়া হবে, সেটাও একটি বিষয়। জানা যাচ্ছে, ইউক্রেনের মূল্যবান কিছু খনিজ পদার্থের ভাগাভাগির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে নিরাপত্তা সমর্থনের নিশ্চয়তা দিতে পারে।প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তাঁর ব্যাবসায়িক কৌশলে নিজেকে যেমন সফল করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও সব সময় দেশের আর্থিক বিষয়কে সর্বাগ্রে রাখার চেষ্টা করেন। অনেক সমালোচনার পরও তাঁর বিগত মেয়াদে (২০১৭-২১) দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি ভালো ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। এবারও চীন, মেক্সিকো, কানাডা এবং ভারতের মতো দেশগুলোর বিপরীতে নিজেদের বাণিজ্যিক ঘাটতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত করারোপের মতো ঘোষণা দিয়ে এরই মধ্যে একটি দর-কষাকষির মতো জায়গায় উপনীত হয়েছেন। এর ফলাফলও পেয়েছেন কিছুটা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার সর্বশেষ আলোচনায় দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত আমদানি এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পণ্য ক্রয়ে কর ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। ধারণা করা যায়, নতুন করে বাণিজ্যযুদ্ধ এড়াতে চীনের সঙ্গেও একটি কার্যকর চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। এসব বিষয়ের অবতারণা এ কারণে যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টিও তিনি একই রকমভাবে তার অর্থনৈতিক স্বার্থের নিরিখে দেখছেন কি না সেটি বিবেচনার দাবি রাখে।

এরই মধ্যে ট্রাম্প বলেই ফেলেছেন যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে, যার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু চাওয়ার থাকতে পারে। এ সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন যে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ হলে ইউক্রেনে তিনি দেশটির বিরল খনিজ পদার্থে বিনিয়োগের বিনিময়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করতে চান। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ইউক্রেনের তরফ থেকেও উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে সাক্ষাতে জেলেনস্কি তাঁর দেশের খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রে বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে কাজ করার আগ্রহ দেখান। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না হলেও ধারণা করা যায় যে ইউক্রেনের চাওয়া থাকবে ভবিষ্যতে এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেন ইউক্রেনের নিরাপত্তার সামগ্রিক দায়িত্ব নেয়। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি রাশিয়া কিভাবে দেখবে এবং এর সঙ্গে যদি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েনের প্রশ্ন জড়িত থাকে, তাহলে সেটি রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি মনে করবে কি না সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে হলে এবং এ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সম্মতি প্রয়োজন রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাক্ষাৎ কবে হবে তা নিয়ে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শিগগির তাঁরা বৈঠক করতে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে ব্যবহারের জন্য দুই নেতার পক্ষ থেকেই সম্মতি জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে পুতিনের বিদেশযাত্রা সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব যেহেতু আইসিসির সদস্য নয়, তাই সেখানে নিশ্চিন্তে যেতে পারেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও ভালো যাচ্ছে। তা ছাড়া সৌদি আরব এই যুদ্ধের পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েছে। ধারণা করা যায়, রিয়াদে দুই নেতার সাক্ষাতে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও উপস্থিত থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠকে সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও কিছু মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আশা করা যায়, সৌদি আরবে দুই নেতার মধ্যে বৈঠকের মাধ্যমে বহুপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে ট্রাম্পের আগ্রহের বিপরীতে জেলেনস্কির তরফ থেকে তার দেশের নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই আলোচনার বিষয়ে খুব একটা প্রতিক্রিয়া না জানালেও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়ে সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই যুদ্ধে সব দিক দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে অর্থ সরবরাহের বিষয়টি অব্যাহত থাকার কারণেই এই যুদ্ধে এত দিন ধরে ইউক্রেন টিকে থাকতে পেরেছিল। সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন আর কোনো অর্থ খরচ করতে চাইছে না, বরং যা খরচ করেছে তা সুদাসলে আদায় করতে চাইছে। এমন বাস্তবতায় এই যুদ্ধ নিয়ে ইউক্রেন বা তার পক্ষ নিয়ে কারো মতামত নিতান্তই মূল্যহীন। এখন বর্তমান বাস্তবতায় রাশিয়াকে কোন উপায়ে এবং কিভাবে এটি নিয়ে একটি চুক্তিতে রাজি করানো যাবে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ইউক্রেনের দখলকৃত ভূমির মালিকানা না ছাড়ার ঘোষণা যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি রাশিয়ার পশ্চিম কুরস্ক অঞ্চলের ইউক্রেন কর্তৃক দখলকৃত ভূমির মালিকানাও দাবি করা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় এটা নিয়ে কিভাবে সমাধানে আসা সম্ভব হবে, তা নিয়ে ট্রাম্প কি ভেবেছেন বা পুতিন কী ভাবছেন এবং তিনি কিভাবে এ ক্ষেত্রে সম্মত হবেন, সেটা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে নিশ্চয়ই একটি খসড়া সিদ্ধান্ত হয়ে থাকতে পারে। তবে ধারণা করা যায়, আপাতত রাশিয়া ইউক্রেনের ভূমির দাবীকৃত মালিকানা না পেলেও তার ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং জব্দকৃত অর্থের ওপর নিষাধাজ্ঞা প্রত্যাহার রাশিয়াকে বাড়তি সুবিধা দেবে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ধরনটি যেমন ফর্মেই থাকুক না কেন, এর নিশ্চয়তা ইউক্রেনকেও একটি সম্মানজনক অর্জন এনে দিতে পারে। যেভাবেই হোক, যুদ্ধ শেষ হোক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের উদ্যোগ

আপডেট টাইম : ১২:১৭:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর তিন বছর পূর্তি হবে। এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হলেও সেগুলো খুব একটা কার্যকর পথে অগ্রসর হয়নি। মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের পক্ষ থেকে এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ সে রকমভাবে ছিল না। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রই এই যুদ্ধকে বন্ধের পরিবর্তে তা জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল এবং সেই লক্ষ্যে ইউক্রেনকে যাবতীয় অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তা দিয়ে এসেছে।

যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় রাশিয়াকে। এটাও ঠিক যে রাশিয়াই এটা শুরু করেছিল, সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে এই যুদ্ধ শুরু না করলে এত দিনে ইউক্রেন হয়তো পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হয়ে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে রাশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এত দিন ধরে ক্রিমিয়াকে দখলে রাখা নিয়ে রাশিয়ার যে দম্ভ রয়েছে, সেখানে হয়তো বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারত। আসলে সব কিছু বিবেচনা করে দেখলে এই যুদ্ধ শুরু করাটা রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি অনিবার্য বাস্তবতা ছিল।
একইভাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই যুদ্ধকে পশ্চিমা স্বার্থের অনুকূলে এক প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তিন বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্বে এসেই এটিকে অপ্রয়োজনীয় এবং মার্কিন স্বার্থের প্রতিকূল হিসেবে বিবেচনা করছেন।দায়িত্ব গ্রহণের আগেই এবং নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই ট্রাম্প এই যুদ্ধ বন্ধে তার উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এই যুদ্ধ হতেই দিতেন না এবং দায়িত্ব পেলে এক দিনের মধ্যে এই যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন প্রায় এক মাস হতে চলল।
এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ না হলেও যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিও যে এই যুদ্ধ থেকে মুক্তি চান এমন আকুতিও উঠে এসেছে ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই। দুই পক্ষই ট্রাম্পের মধ্যস্থতার অপেক্ষায় ছিলেন। এবার সে অপেক্ষার অবসান হতে চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প তাঁর উদ্যোগ শুরু করেছেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেন। এই আলোচনায় পুতিনের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করা হয়েছে। পুতিনের সঙ্গে আলোচনার পর ট্রাম্প কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গেও। সেখান থেকেও একই বার্তা পেয়েছেন তিনি। তবে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে এর প্রক্রিয়া কি হবে তা এখনো অজানা। তার পরও ধারণা করা যায় যে এর জন্য ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে কিছু মূল্য চুকাতে হবে। এর কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দিক থেকে। ইউক্রেনের আর ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হচ্ছে না, বিষয়টি এরই মধ্যে তাদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে রাশিয়ার দিক থেকে পাল্টা হামলার ঝুঁকি মোকাবেলায় ইউক্রেনকে কী ধরনের প্রতিরক্ষামূলক সমর্থন দেওয়া হবে, সেটাও একটি বিষয়। জানা যাচ্ছে, ইউক্রেনের মূল্যবান কিছু খনিজ পদার্থের ভাগাভাগির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে নিরাপত্তা সমর্থনের নিশ্চয়তা দিতে পারে।প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তাঁর ব্যাবসায়িক কৌশলে নিজেকে যেমন সফল করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও সব সময় দেশের আর্থিক বিষয়কে সর্বাগ্রে রাখার চেষ্টা করেন। অনেক সমালোচনার পরও তাঁর বিগত মেয়াদে (২০১৭-২১) দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি ভালো ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। এবারও চীন, মেক্সিকো, কানাডা এবং ভারতের মতো দেশগুলোর বিপরীতে নিজেদের বাণিজ্যিক ঘাটতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত করারোপের মতো ঘোষণা দিয়ে এরই মধ্যে একটি দর-কষাকষির মতো জায়গায় উপনীত হয়েছেন। এর ফলাফলও পেয়েছেন কিছুটা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার সর্বশেষ আলোচনায় দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত আমদানি এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পণ্য ক্রয়ে কর ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। ধারণা করা যায়, নতুন করে বাণিজ্যযুদ্ধ এড়াতে চীনের সঙ্গেও একটি কার্যকর চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। এসব বিষয়ের অবতারণা এ কারণে যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টিও তিনি একই রকমভাবে তার অর্থনৈতিক স্বার্থের নিরিখে দেখছেন কি না সেটি বিবেচনার দাবি রাখে।

এরই মধ্যে ট্রাম্প বলেই ফেলেছেন যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে, যার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু চাওয়ার থাকতে পারে। এ সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন যে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ হলে ইউক্রেনে তিনি দেশটির বিরল খনিজ পদার্থে বিনিয়োগের বিনিময়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করতে চান। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ইউক্রেনের তরফ থেকেও উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে সাক্ষাতে জেলেনস্কি তাঁর দেশের খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রে বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে কাজ করার আগ্রহ দেখান। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না হলেও ধারণা করা যায় যে ইউক্রেনের চাওয়া থাকবে ভবিষ্যতে এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেন ইউক্রেনের নিরাপত্তার সামগ্রিক দায়িত্ব নেয়। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি রাশিয়া কিভাবে দেখবে এবং এর সঙ্গে যদি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েনের প্রশ্ন জড়িত থাকে, তাহলে সেটি রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি মনে করবে কি না সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে হলে এবং এ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সম্মতি প্রয়োজন রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাক্ষাৎ কবে হবে তা নিয়ে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শিগগির তাঁরা বৈঠক করতে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে ব্যবহারের জন্য দুই নেতার পক্ষ থেকেই সম্মতি জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে পুতিনের বিদেশযাত্রা সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব যেহেতু আইসিসির সদস্য নয়, তাই সেখানে নিশ্চিন্তে যেতে পারেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও ভালো যাচ্ছে। তা ছাড়া সৌদি আরব এই যুদ্ধের পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েছে। ধারণা করা যায়, রিয়াদে দুই নেতার সাক্ষাতে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও উপস্থিত থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠকে সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও কিছু মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আশা করা যায়, সৌদি আরবে দুই নেতার মধ্যে বৈঠকের মাধ্যমে বহুপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে ট্রাম্পের আগ্রহের বিপরীতে জেলেনস্কির তরফ থেকে তার দেশের নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই আলোচনার বিষয়ে খুব একটা প্রতিক্রিয়া না জানালেও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়ে সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই যুদ্ধে সব দিক দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে অর্থ সরবরাহের বিষয়টি অব্যাহত থাকার কারণেই এই যুদ্ধে এত দিন ধরে ইউক্রেন টিকে থাকতে পেরেছিল। সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন আর কোনো অর্থ খরচ করতে চাইছে না, বরং যা খরচ করেছে তা সুদাসলে আদায় করতে চাইছে। এমন বাস্তবতায় এই যুদ্ধ নিয়ে ইউক্রেন বা তার পক্ষ নিয়ে কারো মতামত নিতান্তই মূল্যহীন। এখন বর্তমান বাস্তবতায় রাশিয়াকে কোন উপায়ে এবং কিভাবে এটি নিয়ে একটি চুক্তিতে রাজি করানো যাবে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ইউক্রেনের দখলকৃত ভূমির মালিকানা না ছাড়ার ঘোষণা যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি রাশিয়ার পশ্চিম কুরস্ক অঞ্চলের ইউক্রেন কর্তৃক দখলকৃত ভূমির মালিকানাও দাবি করা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় এটা নিয়ে কিভাবে সমাধানে আসা সম্ভব হবে, তা নিয়ে ট্রাম্প কি ভেবেছেন বা পুতিন কী ভাবছেন এবং তিনি কিভাবে এ ক্ষেত্রে সম্মত হবেন, সেটা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে নিশ্চয়ই একটি খসড়া সিদ্ধান্ত হয়ে থাকতে পারে। তবে ধারণা করা যায়, আপাতত রাশিয়া ইউক্রেনের ভূমির দাবীকৃত মালিকানা না পেলেও তার ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং জব্দকৃত অর্থের ওপর নিষাধাজ্ঞা প্রত্যাহার রাশিয়াকে বাড়তি সুবিধা দেবে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ধরনটি যেমন ফর্মেই থাকুক না কেন, এর নিশ্চয়তা ইউক্রেনকেও একটি সম্মানজনক অর্জন এনে দিতে পারে। যেভাবেই হোক, যুদ্ধ শেষ হোক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।