ঢাকা ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ হকের সারাজীবন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৫:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬
  • ৩০৩ বার

একাশিতম জন্ম উৎসবে বাংলা একাডেমির ‘আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ’ সভাকক্ষে অগুনতি সাহিত্য অনুরাগীর সামনে প্রাণবন্ত অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে তিনি বলেছিলন, আমি এখনই চলে যেতে চাই না। ২০২০ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে চাই। উদযাপন করতে চাই ২০২১ সালে পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

সৈয়দ শামসুল হকের সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না। তাকে চলে যেতে হলো জীবনের অনিবার্য গন্তব্যে। ঠিক নিজের লেখা গানের মতোই তিনি, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানু দম ফুরাইলে ঠুস’।

নাহ, এই সব্যসাচি লেখক মোটেও ‘দম ফুরাইলে ঠুস’ হতে পারেন না। সৈয়দ শামসুল হক বেঁচে থাকবেন, তার লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস আর গানে গানে বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকবেন তার নাটকের সংলাপে, নূরুলদীন হয়ে যুগে যুগে ডাকবেন তিনি… ‘জাগো বাহে কুণ্ঠে সবাই।’
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন থেকেই ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮২ বছর। এক ছেলে ও এক মেয়ের গর্বিত জনক সৈয়দ শামসুল হক ব্যক্তিজীবনে যশোরের মেয়ে প্রথিতযশা লেখিকা ডাঃ আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্বামী।

মৃত্যু নিয়ে এখনই ভাবতে রাজি ছিলেন না সৈয়দ হক। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল, , মহাত্মা লালন বেঁচেছিলেন ১১৮ বছর। আমিও তার মতোই দীর্ঘজীবী হতে চাই। এখনও অনেক লেখা আমার করোটির মধ্যে পরিপুষ্ট হচ্ছে। সেগুলো লিখে শেষ করতে তাঁর আরো অনেক বছর দরকার হবে।

সৈয়দ হকের করোটিতে জমে থাকা লেখাগুলি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল মহাকালের গর্ভে।

বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।

দেশের উত্তর জনপদের ছোট্ট শহর কুড়িগ্রামে ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ শামসুল হাক। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, মা সৈয়দা হালিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।

সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।

সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘’দেয়ালের দেশ’’ প্রকাশিত হয়। একসময় পেশায় সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন থেকে বৈচিত্র্যময় সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। সব্যসাচী লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে।। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন।

এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।

সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।

তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।

বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘বারো দিনের শিশু’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’ প্রভৃতি।

‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’, ‘ঈর্ষা’ সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত বিখ্যাত কাব্যনাট্য। ঢাকার মঞ্চে এ নাটকগুলো বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সৈয়দ হকের সারাজীবন

আপডেট টাইম : ১২:০৫:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

একাশিতম জন্ম উৎসবে বাংলা একাডেমির ‘আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ’ সভাকক্ষে অগুনতি সাহিত্য অনুরাগীর সামনে প্রাণবন্ত অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে তিনি বলেছিলন, আমি এখনই চলে যেতে চাই না। ২০২০ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে চাই। উদযাপন করতে চাই ২০২১ সালে পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

সৈয়দ শামসুল হকের সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না। তাকে চলে যেতে হলো জীবনের অনিবার্য গন্তব্যে। ঠিক নিজের লেখা গানের মতোই তিনি, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানু দম ফুরাইলে ঠুস’।

নাহ, এই সব্যসাচি লেখক মোটেও ‘দম ফুরাইলে ঠুস’ হতে পারেন না। সৈয়দ শামসুল হক বেঁচে থাকবেন, তার লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস আর গানে গানে বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকবেন তার নাটকের সংলাপে, নূরুলদীন হয়ে যুগে যুগে ডাকবেন তিনি… ‘জাগো বাহে কুণ্ঠে সবাই।’
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন থেকেই ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮২ বছর। এক ছেলে ও এক মেয়ের গর্বিত জনক সৈয়দ শামসুল হক ব্যক্তিজীবনে যশোরের মেয়ে প্রথিতযশা লেখিকা ডাঃ আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্বামী।

মৃত্যু নিয়ে এখনই ভাবতে রাজি ছিলেন না সৈয়দ হক। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল, , মহাত্মা লালন বেঁচেছিলেন ১১৮ বছর। আমিও তার মতোই দীর্ঘজীবী হতে চাই। এখনও অনেক লেখা আমার করোটির মধ্যে পরিপুষ্ট হচ্ছে। সেগুলো লিখে শেষ করতে তাঁর আরো অনেক বছর দরকার হবে।

সৈয়দ হকের করোটিতে জমে থাকা লেখাগুলি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল মহাকালের গর্ভে।

বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।

দেশের উত্তর জনপদের ছোট্ট শহর কুড়িগ্রামে ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ শামসুল হাক। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, মা সৈয়দা হালিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।

সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।

সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘’দেয়ালের দেশ’’ প্রকাশিত হয়। একসময় পেশায় সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন থেকে বৈচিত্র্যময় সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। সব্যসাচী লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে।। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন।

এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।

সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।

তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।

বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘বারো দিনের শিশু’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’ প্রভৃতি।

‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’, ‘ঈর্ষা’ সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত বিখ্যাত কাব্যনাট্য। ঢাকার মঞ্চে এ নাটকগুলো বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।