ভারতীয় গণমাধ্যম আরটি ইন্ডিয়া গত সোমবার ‘বাংলাদেশে মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর’ শিরোনামে একটি ভিডিও প্রচার করে, যা কয়েক হাজার মানুষ দেখেছেন। তবে গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমটির এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ভিডিওটি আর পাওয়া যায়নি। ফ্যাক্ট চেক সংস্থা রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে, ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়, এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের একটি কালীমন্দিরের। অথচ বর্ধমানের মন্দিরের ধর্মীয় আচার পালনের ভিডিওটি বাংলাদেশের মন্দির ভাঙচুর বলে প্রচার করা হয়। এদিকে গুজব ও অপপ্রচারে আগ্রাসী হয়ে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালিয়েছে উগ্রবাদী কিছু ভারতীয়। প্রায় দিনই ভারতে বাংলাদেশবিরোধী সমাবেশ ও বিক্ষোভ হচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে তারা পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ভারতীয় গণমাধ্যম নয়, উগ্রবাদী অনেক অ্যাকটিভিস্ট ও পলাতক আসামিরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতনের মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। তারা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধকে ধর্মীয় রঙ দেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে কোনো মারামারি ও সংঘর্ষ হলে সেটাকেও সংখ্যালঘুর ওপর হামলা হিসেবে প্রচার করছে একটি গোষ্ঠী।
তবে বাংলাদেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘুরা ভারতীয় গণামাধ্যম ও উগ্রবাদী অ্যাকটিভিস্টদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আগরতলায় বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলার পর প্রতিবাদে গত সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয় জগন্নাথ হলের (সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের হল) শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, সবার আগে দেশ। দেশ নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। সংখ্যালঘুদের নিয়ে মিথ্যা অপ্রচারের কারণে অনেক সত্য ঘটনাও আড়ালে চলে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এসব অপপ্রচারকারীরা সংখ্যালঘুদের বড় ধরনের ক্ষতি করছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ আমাদের সময়কে বলেন, ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর মাঝেমধ্যেই মন্দিরে হামলার খবর গণমাধ্যমে আসছে। হামলাগুলোকে অস্বীকার না করে অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ। সরকারের কাছে দাবি, হামলা-ভাঙচুরের বিচারের পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রমে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন।
মিথ্যা তথ্য ও প্রোপাগান্ডার বিষয়ে মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, আমরা সবাই মিলেমিশে বাস করতে চাই। অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করুক এটা আমরা চাই না। মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করলে তার শাস্তি হওয়া উচিত। সেটা পার্শ্ববর্তী দেশ কিংবা দেশের ভেতর থেকে যেই করুক।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ২৮টি বাড়ি, দুটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, ছয়টি মন্দিরের হামলায় ৩৮ জন আহত হন। তবে সরকারের পটপরিবর্তনের মাস আগস্টে বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একমাসেই হামলা হয় ১৯৬টি বাড়ি, ৯৭টি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, ৭টি মন্দির। এ সময়ে আহত হন ২২ জন। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাড়িতে হামলার সংখ্যা কমে নেমেছে দুটিতে। দুটি মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে কোনো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা ভারত চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ও রাজনৈতিক কারণে অনেকেই হামলা-নির্যাতনের শিকার হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় কারণে হামলা ও নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য এসব ক্ষেত্রে ধর্মকে সামনে নিয়ে আসা হয়।
ভয়েস অব আমেরিকার এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বতীকালীন সরকার দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ৬৬.১ শতাংশ মনে করেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ভালো করছে।
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অল্প যে সব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দুই দিনব্যাপী জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বিষয়ক ফোরামের ১৭তম অধিবেশনে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংঘটিত সহিংসতার পেছনে ধর্মীয় নয়; বরং রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয় কাজ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর পদ্ধতিগত কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।