ইরান তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শত্রুদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক এবং প্রতিশোধমূলক শক্তি হিসেবে দেখে।দেশটি পরমাণু অস্ত্রের সন্ধান করছে বলে অভিযোগ করা হলেও ইরান বরাবরই সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আবারও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির গুরুত্ব ও শক্তি তুলে ধরেছে।
ইরান গত মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলে প্রায় দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যা মূলত তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা ও লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরাইলের অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ ছিল।
এটি ছিল গত পাঁচ মাসের মধ্যে ইরানের দ্বিতীয় বড় ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ। এর আগে গত এপ্রিলে প্রথমবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ চালায় দেশটি।
ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, এ হামলায় তারা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।
মঙ্গলবার রাতের ওই হামলার পর এখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের দামামা প্রায় বেজে উঠেছে। ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেমন পালটা আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন, তেমনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইরানকে ভবিষ্যতের জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে যে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা আসলে কতটুকু?
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা:
ইরানের কাছে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার। মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা অফিসের তথ্যমতে, ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী। যা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি উদ্বেগের বিষয়।
ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা আইএসএনএ (ISNA) গত এপ্রিলে একটি গ্রাফিক প্রকাশ করে। যেখানে দেখানো হয় যে, ইরানের কাছে ৯টি এমন ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলো ইসরাইলে আঘাত হানতে সক্ষম। এগুলোর মধ্যে ‘সেজিল’, ‘খাইবার’, এবং ‘হাজ কাসেম’ উল্লেখযোগ্য।
ইরানও দাবি করে যে, তার কাছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘সেজিল’, ‘খাইবার’, এবং ‘হাজ কাসেম’। এর মধ্যে সেজিলের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭,০০০ কিমি এবং এটি ২,৫০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম। এছাড়া খাইবার ২,০০০ কিমি পর্যন্ত দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম এবং হাজ কাসেমের পরিসীমা ১,৪০০ কিমি।
ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পরিসর:
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। কঠিন জ্বালানি-চালিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অ্যাঙ্গেলড মোবাইল লঞ্চার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। আর তরল জ্বালানি-চালিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উল্লম্ব লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করা হয়। সাম্প্রতিক হামলায় ইরান এই দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করেছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মতে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বেশ কিছু শ্রেণিতে বিভক্ত:
শাহাব-১: ৩০০ কিমি
জোলফাগার: ৭০০ কিমি
শাহাব-৩: ৮০০-১,০০০ কিমি
ইমাদ-১: ২,০০০ কিমি
সেজিল: ১,৫০০-২,৫০০ কিমি
ইরানের সাম্প্রতিক অগ্রগতি:
ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে দুর্দান্ত অগ্রগতি সাধন করেছে। ২০২০ সালে ইরান প্রথমবারের মতো ভূগর্ভ থেকে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর কাঠামোকে হালকা করার পাশাপাশি তাদের গতিবেগও বাড়ানো হয়েছে।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র:
২০২৩ সালে ইরান প্রথমবার দেশীয় হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করে। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শব্দের গতির চেয়ে পাঁচগুণ বেশি গতিতে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে এবং সেগুলোকে প্রতিরোধ করা অত্যন্ত কঠিন।
আঞ্চলিক হামলা ও প্রভাব:
ইরান বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক হামলায় তার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইরাকের কুর্দিস্তানে ইসরাইলি গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে হামলা চালায় ইরান। এছাড়া পাকিস্তানের বালুচ বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতেও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
আর ২০২০ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ওপরও হামলা চালায় ইরান। যার মধ্যে ছিল আল-আসাদ এয়ারবেসে আক্রমণ।
ইয়েমেনের হুথিদের সমর্থন:
যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের জন্য অভিযুক্ত করে আসছে। যদিও ইরান এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ইয়েমেনের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটিও ইসরাইলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে আসছে। হুথিরা রেড সি-তে বিভিন্ন জাহাজে এবং ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে, যা মূলত গাজা যুদ্ধের অংশ হিসেবে সংঘটিত হয়।
হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার প্রতি সমর্থন:
ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়াকেও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। হিজবুল্লাহ তাদের রকেটগুলোকে নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করতে ইরানের প্রযুক্তিগত সহায়তা গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে সিরিয়ার সামরিক বাহিনীও ইরানের সহায়তায় তাদের নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানের ভবিষ্যৎ ক্ষেপণাস্ত্র পরিকল্পনা:
ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে ক্রমাগত উন্নত করে যাচ্ছে এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান তার প্রতিরক্ষা কর্মসূচিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে তারা পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি মূলত উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার ডিজাইন এবং চীনের সহায়তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। যা বর্তমানে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলজুড়ে এক বড় সামরিক হুমকি হিসেবে পরিণত হয়েছে।