ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত বিল অনুমোদনের পর মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাল্লাথল সীমান্তে বসবাসরত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ও জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি সীমান্তের শতাধিক পরিবারের লোকজন চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, সেখানে দু’দেশের সীমানা নতুন করে চিহ্নিত করা হবে। ফলে দু’উপজেলার সীমান্ত এলাকার ভেতরে ৩টি স্থানের প্রায় ৫০০ একর জায়গা বাংলাদেশ নাকি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে, তা নিয়ে সীমান্তের বাসিন্দারা রয়েছেন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়।
আমরা চুক্তি-টুক্তি বুঝি না, আমরা বুঝি মানুষের কষ্ট, পেটের কষ্ট। ভিটামাটি চলে গেলে মানুষজন কই যাইব, কী খাইব! ক্ষোভ ও দু:খের সাথে কথাগুলো বলেছিলেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথল চা বাগানের মন্ত্রী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য লোকাস বাহাদুর (৫৫)। এই ক্ষোভগুলো শুধু লোকাস বাহাদুরের একার নয়, পাল্লাথল সীমান্তের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষের। পাল্লাথল সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা প্রায় ৩৬০ একর ভূমির “ভবিষ্যত” স্থানীয় মানুষের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। জায়গাটি ভারতে চলে গেলে ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসতে হবে সেখানকার বাসিন্দাদের।
স্থানীয় বাসিন্দা কলিন কর্মকার, সীতেশ খংলা, শয়ন কর্মকার, মিথুন কর্মকার, সজিত বাক্তি, কার্তিক, সাগর ও অজয় জানান, সীমান্ত নিয়া দুই দেশের চুক্তি হইছে জানছি। পাল্লাথলের ব্যাপারে কি চুক্তি হইল জানিনা। আমরা কিন্তু জায়গা ছাড়মু না। জীবন দিয়া হইলেও আমাদের জায়গা বাঁচাইমু।
গত ৭ মে সীমান্ত চুক্তি হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস করা হলেও কোনো কোনো এলাকার ু মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। জমি হারানোর ভয়ে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশকেই অপদখলীয় জমি ছেড়ে দিতে হবে। ভারতের যে জমি বাংলাদেশের দখলে রয়েছে তা ছেড়ে দিতে হবে। আবার বাংলাদেশের যে জমি ভারতের দখলে রয়েছে তা ছেড়ে দিতে হবে। এমনই কিছু দখলীয় জমি রয়েছে জেলার বড়লেখা ও জুড়ীতে। দখলীয় এ জমি যারা ভোগদখল করছেন তারা এখন চরম উৎকণ্ঠায়। কারণ চুক্তি বাস্তবায়ন হলে জমি চলে যাবে ভারতে দখলে।
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের পাল্লাতল সীমান্তের ১৩৭০ নং প্রধান খুঁটির ১নং উপখুঁটি থেকে ১৩৭৪নং প্রধান খুঁটির ১নং উপখুঁটি পর্যন্ত প্রায় ৩৬০ একর জায়গা বাংলাদেশের ভেতরে রয়েছে। এর বিপরীতে ভারতের আসামের করিমগঞ্জ জেলার অবস্থান। এই ৩৬০ একরের মধ্যে শতবর্ষী পাল্লাথল চা বাগান ও পানপুঞ্জিতে আদিবাসী খাসিয়া ও গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস রয়েছে। ভারতীয় সীমান্তের ১৩৭০-১৩৭৪ নং মেইন পিলার পর্যন্ত ৩৬০ একর জমির মধ্যে মাত্র ৬৯ একর জমি বাংলাদেশকে ছেড়ে দিলে বাকি ভূমি ভারতের দখলে চলে যাবে। আর শেষ পর্যন্ত ভারত এ ভূমির দখল পেলে দীর্ঘদিন ধরে এ ভূমিতে থাকা সাড়ে তিনশ’ খাসিয়া সম্প্রদায়ের ভিটেমাটি ও পানের বরজ ছেড়ে পথে বসতে হবে। খাসিয়া আদিবাসীসহ এখানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষের বসবাস।
সরেজমিন পাল্লাথল সীমান্ত এলাকায় গেলে তাদের চোখে-মুখে হতাশা ও আশংকার ছাপ লক্ষ্য গেছে। আদিবাসীরা জানান, এখানে ৩ শতাধিক আদিবাসী খাসিয়া পরিবার ও স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠী বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে পানসহ জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এখানে রয়েছে তাদের পূর্ব পুরুষের শত শত কবর, আছে কালাশাহ পীরের মাজার ও গীর্জা। চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে আমাদের সব হাতছাড়া হয়ে যাবে।
পাল্লাথল চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক জাকির হোসেনের ভাষ্যমতে, যে জায়গা ভারতে পড়েছে বলে শোনা যাচ্ছে সেখানে আমাদের বাগানের ৩টি সেকশন ২, ৩, ৪ রয়েছে। খাসিয়া-গারোদের বসতভিটা ও পান জুম আছে। জায়গাটি হারালে ৭-৮ শত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অপরদিকে লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি সীমান্তের ১৩৯৭ নং প্রধান খুঁটি থেকে ১৪০০ নং প্রধান খুঁটির ১নং আর.আই (ভারত অংশের খুঁটি) এবং ২নং আর.বি (বাংলাদেশ অংশের খুঁটি) খুঁটির মধ্যবর্তী এলাকায় কোনো সীমান্ত খুঁটি নেই। ওই স্থানের প্রায় ১২০ একর জায়গার মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। তবে জায়গাটি বাংলাদেশের দখলে রয়েছে।
সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার অবস্থান। ২০১১ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ জরিপ দল বিরোধপূর্ণ জায়গাটি জরিপ করে। জরিপকাজ শেষে ওই যৌথ জরিপ দল নির্দেশক মানচিত্রে (ইনডেক্স ম্যাপ) স্বাক্ষর করে। এরপর স্বাক্ষরিত সীমান্ত প্রটোকল চুক্তিতে বলা হয়েছে, লাঠিটিলা-ডোমাবাড়িসহ (আসাম), পশ্চিমবঙ্গের দুই খাটা-৫৬ ও ত্রিপুরার মুহুরী নদী-বিলোনিয়া সীমান্তে সীমানা চিহ্নিত করা হবে।
ভূমি রেকর্ড জরিপ অধিদপ্তর সূত্র এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রটোকলে ‘আসাম সেক্টর’ শিরোনামে কলাবাড়ি (বরইবাড়ি) এলাকা সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিদ্যমান ১০৬৬/২৪-টি সীমান্ত পিলার থেকে সীমানা রেখা টেনে ১০৬৭/১৬-টি নং সীমান্ত পিলারে নিয়ে যাওয়া হবে। এ সেক্টরের পাল্লাথল এলাকার সীমানা রেখা ১৩৭০/৩-এস নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে চা বাগানের বহির্সীমানা বরাবর ১৩৭১/৬-এস নং পিলার পর্যন্ত এবং ১৩৭২ নং সীমান্ত পিলার থেকে চাষাবাদের এলাকার বহির্সীমানা বরাবর ১৩৭২/২-এস নং সীমান্ত পিলার পর্যন্ত টানা হবে।
প্রটোকলের তৃতীয় অংশে লাঠিটিলা ও ডোমাবাড়ি শিরোনামে রেডক্লিফের আঁকা সীমানা রেখা ১৩৯৭ নং পিলার থেকে সোজা দক্ষিণে ডোমাবাড়ি, লাঠিটিলা ও বড় পুটনিগাঁও মৌজার লোহার সেতু পর্যন্ত এবং এরপর তা দক্ষিণ দিকে পুটনিছড়া বরাবর সিলেট-ত্রিপুরা সীমান্ত পর্যন্ত (১৮০০ নং পিলার) টানার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ত্রিপুরা সেক্টর শিরোনামে ত্রিপুরা-মৌলভীবাজার সেক্টরের চন্দননগর-চম্পারাই চা বাগান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ এলাকার সীমানারেখা বিদ্যমান ১৯০৪ নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে সোনারিছড়া নদী বরাবর ১৯০৫ নং পিলারে গিয়ে মিশবে।
জুড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি এলাকা। এখানে দীর্ঘদিন ধরে ৭০টি পরিবার বসবাস করছে। লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি গ্রামের শেষ প্রান্তে পতœীছড়া নামের ছোট একটি খাল দুই দেশের সীমানা আলাদা করে দিয়েছে। খালের ওপর রয়েছে বেশ পুরনো একটি লোহার সেতু। সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে গ্রামটির প্রবেশমুখে কাঁচা রাস্তার একপাশের মুদি দোকানে তিন-চারজন স্থানীয় লোককে গল্প করতে দেখা যায়। স্থলসীমান্ত বিল পাসের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ষাটোর্ধ্ব সিরাজুল ইসলাম জানান, ভূমিটি হারালে এ এলাকার বাসিন্দারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবে। কোথায় থাকবে, কোথায় আশ্রয় নিবে সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
গোয়ালবাড়ী ইউপি সদস্য বাবুল মিয়া জানান, সঠিকভাবে সীমানা চিহ্নিত করা হলে এই ১২০ একর জায়গা বাংলাদেশ পাবে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৫২ ব্যাটালিয়নের লাঠিটিলা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সুবেদার আবদুল মালেক জানান, সীমান্ত খুঁটিবিহীন এলাকায় ভারত এখনও কাঁটাতারের বেড়া দেয়নি। সীমানা চিহ্নিত করার পর তারা বেড়া নির্মাণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, স্থলসীমান্ত অনুযায়ী, সাড়ে ৬ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিত করা হবে। ছিটমহলগুলোর মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি (৭ হাজার ১১০ একর জমি) এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি (১৭ হাজার ১৬০ একর) জমি বিনিময় হবে।
অপদখলীয় জমির মধ্যে মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধীন সীমান্তে ২০০০ একর জমি এবং আসামের ২৬৮ একর জমির অধিকারী হবে বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্থলসীমান্ত সমস্যার সমন্বিত সমাধানে পৌঁছার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে সীমানা জটিলতার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ওই দুই চুক্তিতে প্রায় ৬.১ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমির বিষয়ে কোনো সমাধান ছিল না।
২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর কোনো বাসিন্দাকেই নিজ বসতবাড়ি ও জীবিকা ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবে না। গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে দুই দেশের ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময়ের ব্যাপারে প্রটোকল সই হয়। তবে কবে বিনিময় হবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পাল্লাথল ও লাঠিটিলায় থাকা ভূমির ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা জানা যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা প্রশাসনের জনৈক কর্মকর্তা জানান, বটুলি, কুরমা ও পাল্লাথলে যৌথ জরিপকালে বাংলাদেশের অংশে ৭৪ একর এবং ভারতের অংশে ২৮৬ একর ভূমির একটি যৌথ চুক্তির স্বাক্ষর হয়। কিন্তু লাঠিটিলা অংশে প্রায় ১৭০ একর ভূমির কোনো জরিপ কাজ হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ভূমি বিনিময় শুরু হলে এখানে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার আশংকা রয়েছে।
এ ব্যাপারে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দ আমিনুর রহমান জানান, প্রশাসনিকভাবে কোনো চিঠি আমরা পাইনি। তবে পাল্লাথলের বিষয়ে সংশ্লিষ্টমহলকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে।
বিজিবি-৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে: কর্নেল সরদার মোহাম্মদ রেজাউল হক সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় এ প্রতিনিধিকে জানান, এ বিষয়ে সরকারিভাবে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি।