জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধে ব্যস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এখন আরেক মাথাব্যথার কারণ নারী জঙ্গিরা। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা থেকে গত দেড় মাসে ২০ জন নারীকে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে আটক করা হয়। এদের কয়েকজন আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আটক নারীদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে নারী জঙ্গিদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার দাবি করছেন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, তারা নতুন জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলাটিম, হিযবুত তাহরীরসহ বিভিন্ন সংগঠনের দেড় হাজার নারীকর্মীর তালিকা করেছেন। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নারী শাখা ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কর্মীরাও এই উগ্রবাদী তৎপরতায় জড়াচ্ছেন বলে জানতে পেরেছে র্যাব।
র্যাবের অনুসন্ধান বলছে, নারী জঙ্গিদের বেশি ব্যবহার করা হয় সংগঠনের বার্তা আদান-প্রদানের কাজে। জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মুখে পুরুষ সদস্যরা আড়ালে চলে গিয়ে নারীদের দিয়েই সাংগঠনিক কাজগুলো সক্রিয় রাখছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, পরিবারের সদস্য বিশেষ করে স্বামী জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার পর স্ত্রীকেও এই পথে দীক্ষিত করার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ভাই, বাবা, বোনজামাই বা বন্ধুদের মাধ্যমেও নারীদের উগ্রপন্থায় ঝোঁকার ঘটনা ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নারী ও পুরুষ জঙ্গিদের মানসিকতা এক। এদের উদ্দেশ্য একই- ইসলামী শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা।’
হিযবুত তাহরীরের সদস্যই ‘বেশি’
গোয়েন্দা সূত্রগুলোর মতে, সদস্যসংখ্যার দিক দিয়ে নারী জঙ্গি তৈরিতে সবচেয়ে এগিয়ে হিযবুত তাহরীর। নিষিদ্ধ এই সংগঠনের ছাত্রী মুক্তি সংস্থা নামে একটি শাখা আছে। এর বাইরে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, আল্লাহর দলসহ প্রতিটি জঙ্গি সংগঠনের আলাদা নারী শাখা রয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, নারী জঙ্গিদের কর্মকা- কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য।
নারীদের নামে শাখা
গত এক মাসে আটক ‘জঙ্গি’ নারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব জানতে পেরেছে, জেলা পর্যায়ে পাড়া-মহল্লায় ধর্ম প্রচারের নামে ও ছোট ছোট সাপ্তাহিক ধর্মসভার আড়ালে কাজ করছে তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা স্থানীয় লোকজন সন্দেহ করবে না- এমন ধারণা থেকেই এই কর্মীদের মাঠে নামানো হয়।
র্যাব বলছে, জেএমবির সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান ও আব্দুল আউয়ালের স্ত্রীরাও জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। ওই তিন নেতার ফাঁসি হওয়ার পর কিছুদিন সংগঠনটির নারী শাখা চুপচাপ ছিল। এখন আবার তৎপরতা শুরু করেছে তারা। এই তৎপরতায় যুক্ত করা হয়েছে নূরজাহান, মারজিয়া, মিনা আক্তার, লতা, শারমিন, জোসনা, বিলকিস নামের কয়েকজন নারীকে। তাদের মধ্যে নূরজাহান হলেন শায়খ আবদুর রহমানের স্ত্রী। এই নারীদের দিয়ে নতুন করে গঠন করা হয়েছে মহিলা ইউনিট। জেএমবির পলাতক শীর্ষ নেতাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, টঙ্গী, গাজীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে নারী জি দের তৎপরতা বেশি। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে সংগঠনের সদস্য বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
গত ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জের মাছুমপুর মহল্লার উত্তরপাড়ায় হুকুম আলীর ভাড়া বাড়ি থেকে আটক করা হয় নাদিরা তাবাসুম রানী, রুনা বেগম, হাবিবা আক্তার মিশু ও রুমানা আক্তার রুমাকে। তাদের কাছ থেকে ছয়টি হাতবোমা, গ্রেনেডের চারটি খোল, নয়টি জিহাদি বই, ডেটোনেটর, সুইচ ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
ছাত্রীরাও জঙ্গিবাদে
পুলিশ-র্যাব সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস থেকে জঙ্গি সন্দেহে লিপি আক্তার, নাজমা সুলতানা, নাসরিন সুলতানা ও নুরুন্নাহার নামে হিযবুত তাহরীরের চার নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এদের মধ্যে নুরুন্নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। তার স্বামী মনিরুল ইসলাম একই বিভাগ থেকে শিক্ষা শেষ করেছেন। তাদের নেতৃত্বে রাজধানীতে নারী জঙ্গিদের আলাদা একটি ইউনিট রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বস্তির ছিন্নমূল নারীরাও আছে। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা পুরুষ জঙ্গিদের সহযোগিতা করছেন।
গত ২৭ জুলাই জঙ্গি সন্দেহে ইডেন কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবিহা আফরিন সীমা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মোসাম্মৎ উম্মে সালমা রুমা, সমাজকর্ম বিভাগের মাকসুদা খাতুন, ইংরেজি বিভাগের নাসরিন সুলতানা এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী ফৌজি আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ দাবি করছে।
জেএমবির ‘আত্মঘাতী’ নারী শাখা
ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনার মূল সন্দেহভাজন জেএমবির রাজনৈতিক শাখার প্রধান কমান্ডার শেখ রহমাতুল্লাহ ওরফে সাজিদের স্ত্রী ফাতেমা আক্তারসহ চার মহিলা জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তারা স্বীকার করেছিলেন, জেএমবির আবদুল্লাহ কাজী, ইশরাত আলী শেখ ও শওকত সরদার তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু জিহাদি বই, বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
ফাতেমা বর্ধমান বিস্ফোরণের সময় স্বামীর সঙ্গে ঘটনাস্থলের পাশেই অবস্থান করছিলেন। শিমুলিয়ায় এক মাদ্রাসায় তিনি নারীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। সেখানে অন্তত ২৫ জন নারী জেএমবির সামরিক শাখার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছয়জন বাংলাদেশি, অন্যরা ভারতীয়। সবাই এখন পলাতক।
ফাতেমার বাড়ি দিনাজপুর বলে জানা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের এনআইএ কর্মকর্তারাও জেএমবির নারী ইউনিট বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন।
১৬ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) চার নারী সদস্যের মধ্যে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। বাকি তিনজন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী।
র্যাব ওই মামলার তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন র্যাব-৪-এর অধিনায়ক খন্দকার লুৎফুল কবির। ঢাকাটাইমসকে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ইতিপূর্বে তাদের হাতে আটক জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাদের আটক করা হয়। র্যাবের কাছে মাহমুদুল স্বীকার করেন, রাজধানীতে আকলিমা আক্তার মনি নামে এক নারীর নেতৃত্বে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করেছে তাদের সমর্থক নারী সদস্যরা।
এর আগে গত ৭ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় জেএমবি সন্দেহে তিন নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন রোজিনা বেগম, সাজিদা আক্তার ও জান্নাতী ওরফে জেমি। এদের কাছ থেকে দুটি চাপাতি, একটি ছোরা, জবাই করার জিহাদি ভিডিও ও বোমা তৈরির কলাকৌশল লেখা একটি খাতা উদ্ধার করেছে পুলিশ।