হজরত মুয়াবিয়া (রা.) তার মৃত্যুর পর হাসান ইবন আলীকে (রা.) শাসন ক্ষমতা প্রদানের ওয়াদা করেছিলেন। তার কোনো কোনো অতিউৎসাহী প্রশাসক পুত্র ইয়াজিদকে স্থলবর্তী নিয়োগের পরামর্শ দিতেন।
মুয়াবিয়া (রা.) সে বিষয়ে দ্বীধাগ্রস্থ ছিলেন কিন্তু হাসানের (রা.) শাহাদতের পর তার অন্তরে সন্তানের বিষয়টি প্রবল হলো। তিনি আব্দুল্লাহ ইবন উমরের (রা.) সঙ্গে এক পরামর্শে বললেন, ‘মৃত্যুর সময় আমার হয় তো প্রজাদের রাখাল বিহীন বৃষ্টিভেজা বকরী পালের মতো রেখে যেতে হবে।’
৪৯ হিজরীতে তিনি ইয়াজিদের অনুকূলে বাইয়াত গ্রহণের জন্য লোকদের আহবান করেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।
তখন অনেকে ইয়াজিদকে খিলাফতের প্রার্থী না হওয়ার পরামর্শ দিল এবং বুঝালো এর পিছনে চেষ্টার চেয়ে তা পরিত্যাগ করা তার জন্য কল্যাণকর হবে। ফলে ইয়াজিদ তার ইচ্ছা থেকে সরে দাঁড়ালো এবং পিতার সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হলো। তখন মুয়াবিয়া (রা.) ও ইয়াজিদ বিষয়টি প্রত্যাহার করে নিতে একমত হলো।
৫৬ হিজরীতে মুয়াবিয়া (রা.) পুনরায় ইয়াজিদের খিলাফতের প্রস্তাব করলেন এবং বিষয়টি সুসংগঠিত করলেন। এমন কি ইয়াজিদের অনুকূলে তিনি বাইয়াত নিলেন এবং সব অঞ্চলে এ মর্মে লিখিত ফরমান পাঠালেন আর লোকেরা তার হাতে বাইয়াত হলো।
কিন্তু আব্দুর রহমান ইবন আবু বকর, আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের, আব্দুল্লাহ ইবন ওমর, হোসাইন ইবন আলী ও আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস বাইয়াত হতে বিরত থাকলেন।
একদিকে মুয়াবিয়া (রা.) ওমরার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনায় তিনি সাহাবা তনয়গণের সামনে ভাষণ দিলেন আর মানুষ ইয়াজিদের পক্ষে বাইআত হলো।
কিন্তু তারা সমর্থন না জানিয়ে বসে ছিলেন তবে তার ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে কোন প্রতিবাদ করেননি। সকল অঞ্চলে বাইয়াত সম্পন্ন হয়ে গেলে ইয়াজিদের সাক্ষাতে দলে দলে প্রতিনিধি দলের আগমন হতে থাকলো।(ইবন কাসীর,আল-বিদায় ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৮,পৃ-৮০)
মুয়াবিয়ার (রা.) ইন্তিকালের পর ৬০ হিজরীর রজব মাসে ইয়াজিদ শাসনভার গ্রহণ করে। ২৬ বা ২৭ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ফলে তিনি যেমন নববী তরবিয়াত হতে বঞ্চিত ছিলেন তেমনি তাবেঈনদের ওই জামাতের মতোও ছিলেন না যারা ইসলাম আগমণের, কোরআন অবতরণের, খিলাফত ব্যবস্থার প্রবর্তনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন।
ওমর (রা.) বলেন, ‘কাবার রবের শপথ! আমি জানি, আরবগণ কখন ধ্বংস হবে। যখন তাদের শাসক হবে এমন কোন ব্যক্তি যে জাহেলিয়াতের যুগ দেখেনি এবং ইসলামেও প্রবীণ নয়।’ (আলী মিয়া নদভী, আলী মুরতাযা (রা.), পৃ-২৪৬)
ইয়াজিদের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ খিলাফতে রাশেদার নিকটবর্তী সময় অগ্রহণীয় ছিলো। কেননা বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবিঈনদের এক বিশাল জামাত তখনো বিদ্যমান ছিলেন যারা খিলাফতের দায়িত্ব ও মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব প্রদানে ইয়াজিদের চেয়ে অনেক বেশী যোগ্য ছিলেন।
ইয়াজিদের চরিত্রে বদান্যতা, সহনশীলতা, বিশুদ্ধভাষিতা, কাব্য রুচি,সাহসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ইত্যাদি কতিপয় গুণ ছিলো। তদুপরি সে ছিল সুদর্শন এবং আচার-আচরণে মার্জিত।
তবে কিছু প্রবৃত্তি পরায়ণ ছিলো, কখনো কখনো নামাজ ছেড়ে দিতো, অধিকাংশ সময় নামাজে অবহেলা করতো।
তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিলো মদপান ও অশ্লীল কাজে লিপ্ততা। তবে তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার কোন অভিযোগ ছিল না। ফাসেক ও পাপাচারী ছিল অবশ্যই।
বর্ণিত আছে,গান বাজনা, মদপান, সুন্দরী দাস-দাসীর সঙ্গ, কুকুর পোষা,বানর ভাল্লুক ও ভেড়ার লড়াই এসবে ইয়াজিদের আসক্তি ছিলো বহুল আলোচিত। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৮,পৃ. ২৩২)
হজরত হোসাইন ইবন আলী ইয়াজিদের বাইয়াত প্রত্যাখান করলেন এবং মদীনায় অবস্থান গ্রহণ করতে থাকলেন। হোসাইন (রা.) ছিলেন স্বভাবে বিনয়ী, নিরহংকারী, দুনিয়া বিমুখ এবং অনেক বেশী পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী করতেন।
তিনি ২০ বার পায়ে হেটে হজব্রত পালন করেন আর তার ভাই হাসান (রা.) ২৫ বার পায়ে হেঁটে হজে গমণ করেন। ৫১ হিজরীতে ইয়াজিদের নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল অভিযানে প্রেরিত বাহিনীতে শরীক ছিলেন। (আবুল হাসান আলী নদভী, আলী (রা.) জীবন ও খেলাফত, ই.ফা.বা. অনূদিত, পৃ-২২৪)
হজরত হারিস আলী (রা.) হতে মারফূ সনদে বর্ণনা করেন, হাসান ও হোসাইন হলেন জান্নাতি যুবকদের সরদার।
তাবারানি সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) একবার হোসাইনকে (রা.) কাঁদতে দেখে ফাতেমাকে (রা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো না যে তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়।’
ইয়াজিদ ও তার প্রশাসকদের পক্ষ হতে যখন বাইয়াতের জন্য ক্রমাগত চাপ আসতে থাকলো তখন তিনি মদীনায় টিকতে না পেরে মক্কায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। মক্কায় ইতিপূর্বে আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের, ইবন উমর, ইবন আব্বাস আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
ইতিমধ্যে ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হোসাইনের (রা.) নামে বিপুল সংখ্যক পত্র আসতে থাকে। এক প্রতিনিধি দলের হাতে তার নামে ১৫০ টি পত্র প্রেরণ করে এবং এই বার্তা প্রদান করে আপনার অপেক্ষায় একলাখ যোদ্ধা রয়েছে।
হোসাইন (রা.) প্রকৃত অবস্থা জানতে আপন পিতৃব্য পুত্র মুসলিম ইবন আকীলকে কূফায় প্রেরণ করেন।
মুসলিম ইবন আকীল কূফা পৌছলে কূফাবাসী তার হাতে হোসাইন (রা.) এর আনুগত্যের বাইয়াত করে এবং নিজেদের জান মাল কোরবানী করার শপথ করে। এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ হাজারের মতো। তখন মুসলিম ইবন আকীল হযরত হুসাইনকে (রা.) কূফায় আগমনের কথা লিখে জানালেন।
কূফার গভর্নর সাহাবি নুমান ইবন বশীর নবী পরিবার ও হোসাইনের (রা.) প্রতি দূর্বল ছিলেন। ইয়াজিদ তাকে অপসারণ করে বসরার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের শাসনাধীনে কূফাকে যুক্ত করে দেয়।
মুসলিম ইবন আকীল ঘোড়ায় চড়ে বের হোন এবং শ্লোগান দেন সঙ্গে সঙ্গে কূফার চার হাজার যোদ্ধা তার পাশে জড়ো হয়। ওবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ সহচরদের নিয়ে প্রাসাদের ভিতরে আশ্রয় নেয়।
ওবায়দুল্লাহ গোত্র প্রধানদের বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে তাদের নির্দেশ দিলেন শহরময় ঘুরে ঘুরে যার যার গোত্রের যোদ্ধাদের মুসলিম ইবন আকিল হতে বিছিন্ন করতে। একে একে সবাই তার থেকে কেটে পড়লো অবশেষে মাগরিবের সময় তার পাশে মাত্র ত্রিশজন লোক ছিল যাদের নিয়ে তিনি মাগরিবের নামজ আদায় করলেন।
রাত্রের দিকে তারাও কেটে পড়ে ফলে মুসলিম ইবন আকিল সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন। পথ দেখাবার মতো,আশ্রয় দেয়ার মতো কেউ ছিল না। তিনি অন্ধকার পথে একাকী লক্ষ্যহীন পথ চলতে লাগলেন। কি করবেন,কোথায় যাবেন কিছুই তার জানা নেই। (ইবন কাসীর,আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৮,পৃ-১৫৪)
মুসলিম ইবন আকীল একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। ইবন যিয়াদ বাহিনী সে ঘর ঘেরাও করে ফেলে এবং বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে তার উপর আক্রমণ শুরু করে।
তিনি বীরত্বের সঙ্গে তাদের বাড়ীর বাহিরে হটিয়ে দেন। অবশেষে তারা তাকে পাথর মেরে ঘায়েল করতে লাগলো এবং বাশের মাথায় আগুন প্রজ্বলিত করে নিক্ষেপ করতে লাগলো।
বাসার মালিক তাকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি তার হাতে নিজেকে তুলে দিলেন। কিন্তু তারা তার তলোয়ার কেড়ে নিল এবং একটি খচ্চরের পীঠে তুলে দিল।
এ সময় তিনি কেঁদে ফেললেন এবং নিশ্চিত হলেন যে,তিনি শহীদ হতে চলেছেন। তাকে ইবন যিয়াদের সামনে উপস্থিত করা হলে উভয়ের মাঝে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
তখন নরাধম ইবন যিয়াদের নির্দেশে তাকে প্রসাদের ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় মুসলিম ইবন আকীল জোড়ে জোড়ে তাকবীর, তাহলীল,তাসবীহ ও ইস্তিগফার পড়ছিলেন এবং আল্লাহর ফেরেশতাদের নামে সালাম পেশ করছিলেন।
বোকায়র ইবন ইমরান নামক এক ব্যক্তি তরবারির আঘাতে তাঁর মস্তক বিছিন্ন করে ফেলে এবং প্রসাদের উপর থেকে তাঁর ছিন্ন মস্তক নীচে ফেলে দেয়, মস্তকহীন দেহটা আগেই নীচে পড়ে গিয়েছিলো। (ইবন কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৮,পৃ-১৫৯)
মুসলিম ইবন আকিলের সঙ্গে কূফাবাসীর এই হটকারিতা, নির্মম আচরণ খুব করুণ! কূফাবাসীর মধ্যে কোন নীতি নৈতিকতা যে ছিলনা এবং তারা ক্ষমতা,প্রতিপত্তি ও লালসার কাছে উদ্দেশ্য ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দিত তাঁর সাথে কৃত আচরণে স্পষ্ট হয়।
তারা একই আচরণ পূর্বে যেমন আলী রা., হাসান রা. এর সঙ্গে করেছে তেমনি মুসলিম ইবন আকিল এবং হুসাইন রা. সাথেও করে।
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস কূফাবাসীর সেই সকল প্রজন্ম এখন মুহররম মাস আসলে হায় হোসাইন! হায় হোসাইন! করে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে।
শাহাদাতের পূর্বে মুসলিম ইবন আকিল মুহাম্মদ ইবন আসআদকে বললেন,যদি পারো আমার পক্ষ হতে হোসাইনের নিকট এই মর্মে বার্তা পৌছে দিও, ‘আপনি পরিবার-পরিজনসহ ফিরে যান, কূফাবাসীর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যেন আপনাকে বিভ্রান্ত না করে। এরা হলো আপনার পিতার সেই সহচর দল, মৃত্যু কিংবা শাহাদতের মাধ্যমে তিনি যাদের বিচ্ছেদ কামনা করেছিলেন।
কূফাবাসী আপনার সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং আমার সঙ্গেও প্রতারণা করেছে। আর প্রতারকদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নাই।’
কূফা হতে চার রাতের দূরত্বে যিবালাহ নামক স্থানে দূত হোসাইনের সাক্ষাৎ পেলেন এবং মুসলিম ইবন আকিলের বার্তাসহ বিস্তারিত জানালেন।
হোসাইন (রা.) মুসলিম ইবন আকিলের ঘটনায় খুব মর্মাহত হলেন এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর ফয়সালা অনিবার্য, আমাদের শাসকদের অনাচার এবং নিজেদের দূরবস্থার জন্য আল্লাহর কাছেই আমরা ফরিয়াদ করি।’