বেকারত্বের হতাশা! চারিদিক শুধুই অন্ধকার। তারপরেও ইচ্ছাশক্তি যেন থেমে নেই। ভাগ্যবদল করতেই হবে। তাই দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখলেন নায়েব আলী (২৮)।
জমি বিক্রি করে এবং সমিতি থেকে লোন নিয়ে লক্ষাধিক টাকাও তুলে দেন আদম ব্যাপারীর হাতে। কিন্তু বিদেশ আর যাওয়া হয় না। থেমে গেল স্বপ্ন। কিন্তু স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবল বাসনা তাকে পেয়ে বসে।
তাইতো লেখাপড়া কম জানা নায়েব আলী নিভৃতে একাকী ধৈর্যধারণ করে নিজের বুদ্ধিকে পুঁজি করে দেশেই কিছু একটা করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন বন্ধু মিজানুর রহমান মন্টু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার হরিহারা গ্রামের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে পুকুর ও খালবিল। এলাকার পরিবেশগত এই দিকটির প্রতি নজর রেখে ভাগ্য বদলের অন্বেষনে নায়েব আলী শুরু করেন হাঁস পালনের পরিকল্পনা। নিজের দৃঢ় মনোবল আর শ্রমকে পুঁিজ করে পাশের গ্রাম থেকে কিনে আনেন ৩০টি হাঁসের বাচ্চা।
মাত্র ১ হাজার টাকা পুঁিজ নিয়ে ২০০৯ সালে হরিহারা গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নায়েব আলী গড়ে তোলেন হাঁসের খামার। হাঁস পালনে অনভিজ্ঞ বেকার নায়েব আলী উপজেলা প্রানী সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শে এবং পাশের গ্রামের একজন হাঁস খামারির উৎসাহে বর্তমানে ১ হাজার হাঁসের একটি আদর্শ খামার গড়ে তুলেছেন।
গ্রামের অন্যান্যদের তিরস্কার এবং বাঁকা দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে নিজের দৃঢ় মনোবলকে কাজে লাগিয়ে ৬ মাসের মধ্যেই নায়েব আলী একজন আদর্শ হাঁস খামারি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন গোটা অঞ্চলে।
হাঁসের বাচ্চাকে লালন পালন করে প্রতিটি মূহুর্তকে কাজে লাগিয়ে অভাবকে জয় করেছেন নায়েব আলী। এক সময় বিষন্ন থাকা নায়েবের মুখে এখন এসেছে হাসি। হাঁস দিয়ে যে ভাগ্য বদল করা যায় তা নায়েব আলী অত্র অঞ্চলের একটি উদাহরন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন।
নায়েব আলী জানালেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য যে টাকা তিনি নষ্ট করেছেন ঐ টাকা দিয়ে হাঁস পালন শুরু করলে তিনি অনেক আগেই ভাগ্যবদল করে স্বাবলম্বী হতে পারতেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, হাঁস পালনই আমাকে সুদিন এনে দিয়েছে। নায়েবের দেখাদেখি অত্র অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত ভাবে অনেক গুলো হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। আর এই হাঁসের খামার গড়ে উঠার কারনে হাঁসের খাদ্য শামুক ও হাঁসের ডিম বিক্রির ব্যবসায় উপার্জনের পথ করেছে আরও কয়েকজন ভাগ্যহত মানুষ।
নায়েব জানান, উন্মুক্ত পরিবেশ থাকায় ও প্রাকৃতিক খাবার পাওয়ায় তার হাঁসগুলো অন্য এলাকার হাঁসের চেয়ে বেশি ডিম দেয়। অত্র অঞ্চলের খালবিল এবং পুুকুরে পর্যাপ্ত হাঁসের খাবার পাওয়া যায় বলেই এই হাঁস পালন করে তার অনেক লাভ হয়েছে।
নায়েবের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ১ হাজার হাঁসের খামারে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টি ডিম পাওয়া যায়। ডিম দেয়া মৌসুমে সব খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান নায়েব আলী।
৩০ টাকা দরে হাঁসের বাচ্চা ক্রয় করে এর পিছনে ওষুধ ও অন্যান্য খরচ ৭০ টাকা ধরে মোট ১০০ টাকা খরচ হয়। অথচ বর্তমানে একটি পরিপূর্ণ হাঁস নায়েব আলী ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। হাঁস খামারের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় নায়েব আলী আরও ২ জন কর্মচারীকে সে নিয়ে এই কাজটি করছেন। এই দুইজন লোকের কর্মসংস্থান ছাড়াও হাঁস বিক্রি ও হাঁসের ডিম বিক্রির সংগে আরও প্রায় ১০ জন ব্যক্তি জড়িত রয়েছেন। এলাকার মানুষের কাছে হাঁস পালনে নায়েব আলী শুধু অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত নন, হতাশাগ্রস্থ একজন বেকার যুবকের উজ্জল দৃষ্টান্তও বটে।
নায়েব আলী জানান, ৩ বছর আগে বিদেশ যাওয়ার জন্য যে অর্থ ঋণ করেছিলেন, হাঁস পালন করে উপার্জিত অর্থে ইতিমধ্যেই তিনি তার লোন শোধ করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের থাকার মতো জায়গা কিনেও রেখেছেন তিনি।
নায়েবের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার এই হাঁস পালন কিভাবে একটি বড় খামারে পরিণত করা যায়, সারাদিন রাত সেই চিন্তাই তিনি করেন।
অবিবাহিত যুবক নায়েব আলী হাঁসগুলোকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করে আসছেন। এ কাজে আর দশ জনকে প্রশিক্ষন ও উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে তার কোন কার্পণ্য নেই। আগামীতে হরিহারা গ্রামের প্রতিটি বেকার যুবকদের হাঁস পালন প্রশিক্ষণ দিয়ে এলাকাটিতে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নায়েব আলী।