সেই কালরাত আজ, ৪২ জেলায় সাড়ে ১৮ হাজার গণহত্যা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এত দিন ধারণা করা হতো, এই সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি হতে পারে। তবে গণহত্যা জাদুঘরের চালানো জেলা জরিপে দেখা গেছে, শুধু ৪২ জেলাতেই ১৮ হাজার ৪৮১টি গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

জরিপে ৪২ জেলায় মোট ২১ হাজার ৮৫৬টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্রের সন্ধান মিলেছে।

গবেষকরা বলছেন, ৬৪ জেলার জরিপ শেষে এই সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা আগের ধারণার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি।

২০১৭ সাল থেকে খুলনায় অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর  ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ জেলাভিত্তিক গণহত্যার জরিপকাজ পরিচালনা করছে। চলতি বছরের মধ্যেই দেশের সব জেলার গণহত্যা জরিপের ফল প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে এই জাদুঘর।

গণহত্যা জাদুঘরের উপপরিচালক রোকোনুজ্জামান বাবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ৪২ জেলার প্রতিবেদন এরই মধ্যে প্রকাশ করেছি।

আরো ২২ জেলার মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে, এখন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। ধারণা করছি, ৬৪ জেলায় গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্রের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।’

মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কের অবসান ঘটাতে ও গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা খুঁজে বের করতে সারা দেশে জেলাওয়ারি জরিপ চলছে। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৭০০ প্রশিক্ষিত গবেষক গণহত্যা জাদুঘরের গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িত।

প্রশিক্ষিত গবেষকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে শনাক্ত করছেন একাত্তরের নির্মমতার ইতিহাস। জরিপের কাজে অংশ নেওয়া মাঠ গবেষকদের কাজ ক্রস চেক বা খতিয়ে দেখা হয়।

২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এই জরিপটা একটা সম্পূর্ণ জরিপ। এর আগে দেশজুড়ে কখনো এ রকম জরিপ হয়নি।

আমরা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা বলি, এই জরিপের ফলে সেই পথটা সুগম হলো। আরো ২২ জেলা বাকি আছে। ওই জেলাগুলোর ফল বের হলে এই সংখ্যা তো আরো বাড়বে। এটা অথেনটিক (প্রকৃত) চিত্র। এই জরিপ প্রমাণ করবে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কত কম জানি। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটা নতুন সংযোজন বলে আমি মনে করি।’

আগের সব অনুমান ভেঙে দিয়েছে জরিপ

৪২ জেলার জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা এসব অঞ্চলে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে ১৮ হাজার ৪৮১টি; বধ্যভূমি শনাক্ত হয়েছে ৮৮৮টি; গণকবর এক হাজার ৩১৩টি ও নির্যাতনকেন্দ্র শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ১৭৪টি।

এই গবেষণার সঙ্গে জড়িতদের একজন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী শহীদ কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, “এই জরিপের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতনকেন্দ্রের প্রকৃত সংখ্যা খুঁজে বের করা। সুকুমার বিশ্বাসের ‘একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর’, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধকোষ’,  মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. এম এ হাসানের ‘গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও বিচারের অন্বেষণ’ বইগুলোতে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতনকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৯০৫টি। আমাদের এই জরিপে ৪২ জেলাতেই এই সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।’

গণহত্যা বেশি দিনাজপুরে, গণকবর বেশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

৪২ জেলার জরিপে সবচেয়ে বেশি গণহত্যার ঘটনা পাওয়া গেছে দিনাজপুরে এক হাজার ৭২৬টি; সবচেয়ে বেশি গণকবর পাওয়া গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৮০টি; সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে ৯৫টি। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যবহৃত নির্যাতনকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে নওগাঁয় ১৫৪টি। গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতনকেন্দ্র মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা পাওয়া গেছে দিনাজপুরে এক হাজার ৮৫৭টি।

গণহত্যা-নির্যাতনের ডিজিটাল ম্যাপও হচ্ছে

দেশের সব গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরকে চিহ্নিত করে, সেসব স্থানের জিপিএস লোকেশন নিয়ে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করছে জাদুঘরের গবেষণাকেন্দ্র। তৈরি হচ্ছে সারা বাংলাদেশের বধ্যভূমির মানচিত্র। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এরই মধ্যে ৩৪টি জেলার ডিজিটাল ম্যাপ ওয়েবসাইটে রয়েছে।

বের হচ্ছে প্রতিটি গণহত্যার বই

জেলা জরিপের ওপর ভিত্তি করে গণহত্যা জাদুঘর ‘গণহত্যা নির্ঘণ্ট সিরিজ’ নামে বই বের করছে। এখন পর্যন্ত ১২৬টি গণহত্যার ওপর আলাদা করে বই বের করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

স্মৃতিফলক নির্মাণ 

গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণে গণহত্যা জাদুঘর বাংলাদেশের সব বধ্যভূমি, গণকবর, গণহত্যার স্থানগুলোতে স্মৃতিফলক লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫০টি কম পরিচিত গণহত্যার জায়গায় জাদুঘরের পক্ষ থেকে ফলক লাগানো হয়েছে।

জাদুঘরে রয়েছে গণহত্যার নানা নিদর্শন

ছবি, চিত্রকলা, দুষ্প্রাপ্য নথি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহৃত জিনিসের নিদর্শন, গণহত্যায় শহীদদের ব্যবহৃত নিদর্শন, গণহত্যার শিকার শহীদদের দেহাবশেষসহ নানা নিদর্শন রয়েছে এই জাদুঘরে।

মুক্তিযুদ্ধে পুরো দেশটাই ছিল বধ্যভূমি

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে স্থানীয় গবেষকরা ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জবানবন্দি নিয়ে এই গবেষণা করছেন। এটা একটা পদ্ধতিগত জরিপ। সব জেলায় এই জরিপ শেষ হলে দেখা যাবে আমাদের গণহত্যা ও শহীদের সংখ্যা আগের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো দেশটাই বধ্যভূমি ছিল।’

বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এরপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেদিনের শহীদদের স্মরণে আজ নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার কয়েকজন শহীদের মরদেহ।  ছবি : সংগৃহীত

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর