হঠাৎ করেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। এতে সব পর্যায়ে ডলারের দাম কমতে শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের অনানুষ্ঠানিক দাম প্রায় চার থেকে ছয় টাকা কমেছে। ঈদ সামনে রেখে ডলারের সরবরাহ আরও বাড়ার প্রত্যাশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে আগামীতে ডলারের দাম আরও কমার আশা করা হচ্ছে। ডলারের সরবরাহ বাড়ায় ব্যাংকগুলোও এখন এলসি খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে নির্ধারিত (আনুষ্ঠানিক) দামে কোনো ব্যাংক এলসি খুলছে না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
বাজারে ডলারের হঠাৎ এই ইউটার্নের পেছনে ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে ফেরা, আমদানিব্যয় হ্রাস, প্রবাসী আয়ে গতি এবং রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক প্রবণতাকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে ডলার সাশ্রয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘অনেকেরই ধারণা ছিল ডলারের দাম আরও বাড়বে; কিন্তু আমরা বলেছিলামÑ দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তার প্রতিফলন আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের চাহিদ-জোগানের গ্যাপ কমে আসার কারণে ইনফরমাল মার্কেটেও ডলারের রেট কমে এসেছে। আশা করছি সামনে আরও কমবে। বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি।’
করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশি^ক কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিখরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। একই কারণে রপ্তানি আয়েও
প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে পড়ে। একই সময়ে হুন্ডি-তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স-প্রবাহ নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ে পার্থক্য বেড়ে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে এই সংকট বাড়তে থাকে। এই সংকটকে উসকে দেয় মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে ডলার মজুদ। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে রেকর্ড পতন হয়; কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এর পরই আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা কড়াকড়ি ও হুন্ডি প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব পদক্ষেপের ফলে দেরিতে হলেও ডলারের বাজার পড়তে শুরু করেছে। এখন বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত বেশির ভাগ অথরাইজড ডিলার ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার আছে। তবে কিছু কিছু ব্যাংক সংকটেও আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি দিনের শুরুতে ব্যাংকগুলোতে ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার নিট পজিশন ছিল ৩১২ মিলিয়ন ডলার। সেটা বেড়ে গত ১৪ মার্চ বুধবার ৭০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এ সময়ে বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। একই সময়ে অন্তত ৮ থেকে ১০টি ব্যাংকে ডলারের ঘাটতি ছিল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক আমাদের সময়কে বলেন, ডলার সংকট কাটাতে বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেগুলোরই একটা প্রভাব এখন বাজারে পড়ছে। ব্যাংকগুলোতে সরবরাহ বাড়ায় দামও কমছে।
বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরবরাহ বাড়ায় আমদানিতে ডলারের অনানুষ্ঠানিক দাম কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। এখন আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম নেওয়া হচ্ছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১২২ থেকে ১২৪ টাকা। তবে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম এর থেকেও ১০-১২ টাকা কম নির্ধারণ করা আছে। সর্বশেষ বাফেদা ও এবিবি মিলে আমদানিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করে ১১০ টাকা। যদিও এই দামে কোনো ব্যাংকেই মিলছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এর ফলে দামও কমছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত কয়েক মাস টানা বাড়ছে প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানিব্যয়ও কমে গেছে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবেও উদ্বৃত্তাবস্থা বজায় রয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন এলসি খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
চার কারণে বেড়েছে ডলার সরবরাহ : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, আমাদানিব্যয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা, রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকা এবং মানুষের ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে ফেরাতে আরএফসিডি হিসাবে সুদ বৃদ্ধিÑ এই চার কারণে বাজারে ডলার সরবরাহ বেড়েছে।
এক সময়ে নিম্নমুখী হওয়া প্রবাসী আয়ে এখন বেশ গতি এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে রেকর্ড ২১৬ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে। এর আগের মাসেও প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলারের বেশি ছিল। সবমিলে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। রোজা ও ঈদের কারণে চলতি মাসে প্রবাসী আয়ের গতি আরও বাড়ার আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনেই প্রবাসী আয় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে বিগত অর্থবছরগুলোর ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও আমদানিব্যয় নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আমদানিব্যয় কমেছে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে আমদানিব্যয় কমেছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। অথচ তার আগের অর্থবছরে আমদানিব্যয় বেড়েছিল রেকর্ড প্রায় ৩৬ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে পণ্য রপ্তানিতে আয় এসেছে প্রায় ৫১৯ কোটি ডলার। এটি গত বছরের একই মাসের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে দেশে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এর বাইরে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে মানুষের ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে ফেরাতে রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবে জমা অর্থের ওপর ব্যাংকগুলো বেঞ্চমার্ক রেটের সঙ্গে অন্তত দেড় শতাংশ সুদ দিতে পারবে বলে জানায়। সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) এখন প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। সে অনুযায়ী আরএফসিডি হিসাবে জমা রাখা ডলারে প্রায় ৭ শতাংশ সুদ মিলছে। এই সুদের আশায় ঘরে রাখা মজুদ ডলার সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে।
সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে খোলাবাজারেও : ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজারে নগদ ডলারের সরবরাহ বেশ বেড়েছে। ফলে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এই বাজারে প্রতি ডলারে দাম কমেছে প্রায় ৫ টাকা। গত দুই দিন রাজধানীর দিলকুশা ও মতিঝিলের বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেখা যায়, এই বাজারে প্রতি ডলারে ক্রেতাদের থেকে নেওয়া হচ্ছে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। গত সপ্তাহেও যা ছিল ১২১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা। আর তার আগের সপ্তাহে ছিল ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৪ টাকা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রির দাম নির্ধারণ করা আছে ১১৬ টাকা।
এ বিষয়ে মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এসএম জামান আমাদের সময়কে বলেন, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হলে স্বাভাবিক নিয়মে যে কোনো জিনিসের দাম কমে যায়। বেশ কিছুদিন ধরে খোলাবাজারেও ডলারের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি বলে মনে হচ্ছে। কোনো মানি চেঞ্জারেই নির্ধারিত রেটে ডলার মিলছে নাÑ এমন প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, এটা হওয়ার কথা নয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অ্যাসোসিয়েশনকে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, সেই নির্দেশনা এই ২৩৪টি মানি চেঞ্জার মানতে বাধ্য। কাজেই আমাদের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নির্ধারিত রেটের বাইরে ডলার কেনাবেচার অভিযোগ উঠলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।