ঢাকা ০৬:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মনমোহন যা পারেননি মোদি তাই করে দেখিয়েছেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৫৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুন ২০১৫
  • ৩৫৮ বার

ভারতে ধুমসে বলাবলি হচ্ছে ড. মনমোহন সিং যা পারেননি, নরেন্দ্র মোদি তাই পেরেছেন। ৪ বছরের ব্যবধানে দুজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এলেন। দুবারই আওয়ামী লীগের সরকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সারথী হিসেবে কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রশ্নাতীত। স্বাধীনতা লাভের পরেই ট্রানজিট আশা করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল জ্যাক জেকব ঢাকা থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের আগেই একটি ট্রানজিট চুক্তি সই করিয়ে নিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডিপি ধরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই ট্রানজিট চার দশক পরে করায়ত্ত করলেন নরেন্দ্র মোদি। ট্রানজিট প্রশ্নে ভারতের সর্বশেষ কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহনকে খালি হাতে ফিরিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ ৩ বছর আগে বলেছে, গিভ অ্যান্ড টেক বলে একটা কথা ডিপ্লোমেসিতে আছে। এবারে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর দুই হাত পূর্ণ হয়েছে। দূরদর্শী ও প্রতিশ্রুতিশীল মোদির টুইটার-উচ্ছ্বাস বিফলে যায়নি। বাংলাদেশ সফরের আগে তিনি বাংলাদেশ সফর নিয়ে খুবই খুশির রেশ ছড়িয়েছিলেন। গতকাল ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ  আনাম এর আগে তারই পত্রিকার প্রধান শিরোনাম স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। নো তিস্তা নো ট্রানজিট। অবশ্য ঢাকার পর্যবেক্ষকদের অনেকেই আশাবাদী। তারা বলছেন, ওয়েট অ্যান্ড সি।  তিস্তা চুক্তি কাগজেই কলমে হয়ে গেলেই কি বাংলাদেশের পানি সমস্যা মিটে যাবে? ভারতের বড়মাপের সদিচ্ছাটা লাগবেই। আর ‘আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়িটির তীরে’ কথাটি এবং পানি নিয়ে রাজনীতি নয়, উচ্চারণ  করার পরে ধরে নিতে হবে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশী অনেক নেতার মতো পল্টনের ভাষণ দেননি। তিনি এটা বিশ্বাস না করলে এতটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন না। কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত নীতি শুরু থেকেই উদারনৈতিক ছিল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা ব্যবধান দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী দ্বৈরথের কারণে বাংলাদেশসহ সার্কের সদস্যরা দুই দেশের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারকেও সেই ভারসাম্য মানতে হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেন, তার আগেই দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে চলে গেছে। পারমাণবিক পাকিস্তানকে আপাতত তেমন কোন খেলোয়াড় হিসেবেই দেখা হয় না। তাছাড়া,  আফগানিস্তান, আল কায়েদা ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের কারণে প্রায় বিধ্বস্ত পাকিস্তান আর সীমান্তের বাইরে নজর দিতেও পারছে না। একজন নারী মার্কিন বিশেষজ্ঞ ২০০৫ সালে ঢাকায় একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের গোয়েন্দাদের ব্যাটেল গ্রাউন্ডে পরিণত না হতে দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞরা একমত যে, সেই ধরনের সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। উপরন্তু এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবির কোন প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়ছে না। শুধু তাই নয় মনমোহন সিং যা পারেননি, মোদি তাই করে দেখিয়েছেন।
গত ৩রা জুন আনন্দবাজার লিখেছে, মনমোহন যা পারেননি, মোদি তাই পেরেছেন, মোদি দিদিকে বোঝাতে পেরেছেন বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কথাটি কিছুটা স্থল সীমান্তের জন্য সত্য হতে পারে। কিন্তু মমতাকে ভিআইপি মর্যাদা দেয়ার পরেও মমতা ঢাকায় তিস্তা প্রশ্নে টুঁ-শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ এর আগে মমতার কারণেই তিস্তা হতে পারেনি। এবারেও মোদি পরোক্ষভাবে রাজ্য সরকারের কাঁধে বন্দুকটা আলতো করে রেখেছেন। বলেছেনও রাজ্য সরকারের সমর্থন লাগবে। এর আগে সুষমা সাফ বলেছেন, রাজ্যের সম্মতি  ছাড়া তিস্তা হবে না। মমতা যে ২০১৬ সালের বিধান সভা নির্বাচনের আগে এটা দেবেন না, সেটা খুবই স্পষ্ট। তিনি ঢাকায় আসতেই চাননি। সুতরাং মোদি বর্ণিত ‘‘যত তাড়াতাড়ি’’ মানে ২০১৬ সালের আগে নয়। আবার মমতা নির্বাচনে না এসে বামফ্রন্ট এলে ভিন্ন গল্প তৈরি হতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গে যে করেই হোক বিজেপি আসতে চাইছে, মোদি দলের জন্য কলকাতার জয়ের গুরুত্ব বোঝেন। তা মমতাকে মিনি প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তিনি একটি  মহামূল্যবান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাল কষেছেন কিংবা সেভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। মোদি-মমতা সম্পর্ক প্রশ্নে রাহুল গান্ধীর তীর্যক মন্তব্য সেটাই খোলাসা করেছে।
মোদি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে জনবক্তৃতা করেননি। আবার কিছু হিসাব যে করেননি তাও নয়। এক. জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ না করে সার্কের প্রসঙ্গে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। দুই. বাস্তবে যাই ঘটুক খবর বেরিয়েছে যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদির রুদ্ধদ্বার বা একান্ত বৈঠকে কিভাবে যেন মমতা হাইফেন হয়ে গিয়েছিলেন। তাই হাসিনা-মোদি একান্ত বৈঠক হয়নি। মোদি-খালেদা একান্ত বৈঠক হয়েছে। তিন. মোদি-খালেদা বৈঠকে ভারত ‘গণতন্ত্রের পক্ষে’ কথাটি যে উচ্চারিত হয়েছে, সেটা ভারতীয় মুখপাত্র প্রকাশ করেছেন। বিএনপি নেতারা বলেননি। এর আগে ঢাকায় খালেদার সঙ্গে মোদির বৈঠক হবে না প্রকাশের পরপরই দিল্লিতে ঘোষণা আসে এই বৈঠক হবে।
তিনটি আশংকা অনেকেরই। এক উত্তর- পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার যতটুকু বিস্তৃত হয়েছিল, সেটা হাতছাড়া হতে পারে। কারণ দেশপ্রেমিক ভারতীয়রা বাংলাদেশী পণ্য বর্জন করে বাংলাদেশের বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে আসা ভারতীয় পণ্যের জন্যই অপেক্ষা করবে। দামও কম পড়তে পারে। দুই. অভিন্ন পানিসম্পদ ব্যবহার করে যৌথ পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প ভারত আর করবে না। কারণ তারা বিদ্যুতেও ট্রানজিট সুবিধা নেবে। ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের জমিতে খুঁটি পুঁতে লাইন টেনে তারা বিদ্যুৎ নেবে আরেক ভূখণ্ডে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। মহাসড়ক বলতে কোনমতে কিছু টিকে আছে, তাও সর্বত্র সমান অবস্থায় নেই। যানজট এখন রাজধানীতে নয়, সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে। মহাসড়কেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট থাকে। সেই অবস্থায় ভারী ভারতীয় পরিবহন যুক্ত হলে তা অবস্থার উন্নতি ঘটাবে না। অনেক বিশেষজ্ঞ এতদিন বলেছেন, অবকাঠামোর উন্নয়ন না করে ট্রানজিট চালুর ফল কারো জন্য সুখকর হবে না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন ভারত বেশি লাভবান হলো বলে মনে হচ্ছে। তবে যদি উপ-আঞ্চলিক বা আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে বাংলাদেশও লাভবান হবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে,  মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত এক ডজনের বেশি রুটে ট্রানজিট নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এখন এসব রুটের অবকাঠামো কিভাবে গড়ে ওঠে সেটা দেখার বিষয় হবে। ভারতের যথেষ্ট অনুকূলে নৌ-প্রটোকল চুক্তি হয়েছে। অথচ বহু রুটে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ট্রানজিট সংক্রান্ত সরকার গঠিত কোর কমিটির আহ্বায়ক ড. মজিবুর রহমানও মনে করেন ট্রানজিটে লাভ বেশি ভারতেরই। উইন উইন সিচুয়েশন ছাড়া ট্রানজিট টিকে না।
সীমান্ত হত্যার মানবিক দিক মোদির ভাষণে ছিল না। সরাসরি গুলি বন্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কোন বক্তব্য আসেনি। বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনে ‘‘যে কোন পদক্ষেপ’’ নিতে আশ্বাস  মিলেছে। কিন্তু দু’শ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন ব্যবহারে আগের মতো ভারতবান্ধব শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ৭৫ ভাগের ব্যবহার হবে ভারতের শর্তে। সেখানে নতুন কর্মসংস্থানের হিসাব নিকাশও বেরিয়েছে। ৫৪টি অভিন্ন নদীর বেশির ভাগ এসেছে হিমালয় থেকে। আর ভারতের বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোদির বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। যৌথ ঘোষণায় এব্যাপারে রুটিন ঘোষণা এসেছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতির কারণ হবে না। ভারত বিরত থাকার  ঘোষণা দেয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে বলা হয়েছে বিদ্যমান কাঠামো মতে নাও হতে পারে। কিন্তু টিপাইমুখ যে হবে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর নন ট্যারিফ বেরিয়ার বা অশুল্ক বাণিজ্য বাধা সংক্রান্ত উদ্বেগ নিরসনে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়নি। এসব উদ্বেগ নিরসনে অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সাধারণভাবে রাজনৈতিক আশ্বাস পাওয়া  গেছে। বাংলাদেশকে বিশ্বাসে ভর করতে হবে। তাকে বিশ্বাস হারালে চলবে না। নীতিনির্ধারকদের হৃদয়ে আরও বিশ্বাস মজবুত করতে হবে।
ট্রানজিটে আরও একটি নতুন দিগন্তের আভাস মিলেছে। ফেনী নদীর ওপর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ হলে মাত্র কয়েক কিলোমিটার রাস্তা দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য যাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো নিয়ে ভারতকে বেশি চিন্তিত হতে হবে না। এ প্রসঙ্গে অনেকে অবশ্য তিনবিঘা করিডোরের ওপর নির্মিত ফ্লাইওভার দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের দাবি অগ্রাহ্য অবস্থায় থাকছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ছিল- ‘এই করিডোর বাংলাদেশকে লিজ ইন পারপিচুয়েটি’ অর্থাৎ অনন্তকালীন ইজারা দেবে। কিন্তু সামরিক যানসহ যে কোন পরিবহনের অবাধ চলাচলের বাংলাদেশী দাবি পূরণ হয়নি।
তবে প্রাপ্তির তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। অনেকেই মনে করেন এটা একটি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার যে, লাভকে কে কিভাবে দেখেন? ট্রানজিট যদি সড়কের চেহারা বদলায় এবং বিরাট শুল্ক বয়ে আনে তাহলে একে উইন উইন বিষয় হিসেবেই দেখতে হবে। মোদির সফরে কিছু কিছু চুক্তি সই হয়েছে যেগুলো উভয়  দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। চোরাচালান ও জালনোট পাচার বন্ধ,  জলবায়ু পরিবর্তনে সমঝোতা স্মারক, কোস্টগার্ড সমঝোতা স্মারক, মানবপাচার প্রতিরোধ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লির জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নীল অর্থনীতি সমপ্রসারণে সমঝোতা স্মারক, সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি, সমুদ্রবিদ্যা গবেষণার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের মধ্যে সমঝোতা স্মারক।
মোদি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিএনপি-জামায়াতসহ প্রায় প্রতিটি প্রধান দল মোদির প্রতি বিরল সম্মান দেখিয়েছেন। মিডিয়ায় সম্ভবত একটিও নেতিবাচক শিরোনাম ছিল না। বাংলাদেশ প্রেস এক অসাধারণ কাভারেজ দিয়েছে, সবাই চেয়েছে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটবে। ভারত অবশ্য তেমনটাই দাবি করেছে। এখন বাংলাদেশের জন্য কতটা সত্য হবে সেজন্য অপেক্ষার প্রহর গণনা শুরু হয়ে গেছে। তিস্তা না হওয়ার হতাশা মোদি বিবেচনায় নিয়েছেন। যে কারণে তিনি বারংবার বলেছেন, আমার ওপরে আস্থা রাখুন। বলেছেনও এই সফরের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব হবে। অনেকের মতে, একথার মাধ্যমে লাভের পাল্লা যে ভারতের দিকেই আপাতত ঝুঁকেছে, সেটা তিনি প্রকারান্তরে স্বীকারই করে গেছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

মনমোহন যা পারেননি মোদি তাই করে দেখিয়েছেন

আপডেট টাইম : ০৪:৫৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুন ২০১৫

ভারতে ধুমসে বলাবলি হচ্ছে ড. মনমোহন সিং যা পারেননি, নরেন্দ্র মোদি তাই পেরেছেন। ৪ বছরের ব্যবধানে দুজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এলেন। দুবারই আওয়ামী লীগের সরকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সারথী হিসেবে কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রশ্নাতীত। স্বাধীনতা লাভের পরেই ট্রানজিট আশা করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল জ্যাক জেকব ঢাকা থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের আগেই একটি ট্রানজিট চুক্তি সই করিয়ে নিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডিপি ধরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই ট্রানজিট চার দশক পরে করায়ত্ত করলেন নরেন্দ্র মোদি। ট্রানজিট প্রশ্নে ভারতের সর্বশেষ কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহনকে খালি হাতে ফিরিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ ৩ বছর আগে বলেছে, গিভ অ্যান্ড টেক বলে একটা কথা ডিপ্লোমেসিতে আছে। এবারে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর দুই হাত পূর্ণ হয়েছে। দূরদর্শী ও প্রতিশ্রুতিশীল মোদির টুইটার-উচ্ছ্বাস বিফলে যায়নি। বাংলাদেশ সফরের আগে তিনি বাংলাদেশ সফর নিয়ে খুবই খুশির রেশ ছড়িয়েছিলেন। গতকাল ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ  আনাম এর আগে তারই পত্রিকার প্রধান শিরোনাম স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। নো তিস্তা নো ট্রানজিট। অবশ্য ঢাকার পর্যবেক্ষকদের অনেকেই আশাবাদী। তারা বলছেন, ওয়েট অ্যান্ড সি।  তিস্তা চুক্তি কাগজেই কলমে হয়ে গেলেই কি বাংলাদেশের পানি সমস্যা মিটে যাবে? ভারতের বড়মাপের সদিচ্ছাটা লাগবেই। আর ‘আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়িটির তীরে’ কথাটি এবং পানি নিয়ে রাজনীতি নয়, উচ্চারণ  করার পরে ধরে নিতে হবে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশী অনেক নেতার মতো পল্টনের ভাষণ দেননি। তিনি এটা বিশ্বাস না করলে এতটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন না। কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত নীতি শুরু থেকেই উদারনৈতিক ছিল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা ব্যবধান দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী দ্বৈরথের কারণে বাংলাদেশসহ সার্কের সদস্যরা দুই দেশের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারকেও সেই ভারসাম্য মানতে হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেন, তার আগেই দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে চলে গেছে। পারমাণবিক পাকিস্তানকে আপাতত তেমন কোন খেলোয়াড় হিসেবেই দেখা হয় না। তাছাড়া,  আফগানিস্তান, আল কায়েদা ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের কারণে প্রায় বিধ্বস্ত পাকিস্তান আর সীমান্তের বাইরে নজর দিতেও পারছে না। একজন নারী মার্কিন বিশেষজ্ঞ ২০০৫ সালে ঢাকায় একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের গোয়েন্দাদের ব্যাটেল গ্রাউন্ডে পরিণত না হতে দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞরা একমত যে, সেই ধরনের সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। উপরন্তু এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবির কোন প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়ছে না। শুধু তাই নয় মনমোহন সিং যা পারেননি, মোদি তাই করে দেখিয়েছেন।
গত ৩রা জুন আনন্দবাজার লিখেছে, মনমোহন যা পারেননি, মোদি তাই পেরেছেন, মোদি দিদিকে বোঝাতে পেরেছেন বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কথাটি কিছুটা স্থল সীমান্তের জন্য সত্য হতে পারে। কিন্তু মমতাকে ভিআইপি মর্যাদা দেয়ার পরেও মমতা ঢাকায় তিস্তা প্রশ্নে টুঁ-শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ এর আগে মমতার কারণেই তিস্তা হতে পারেনি। এবারেও মোদি পরোক্ষভাবে রাজ্য সরকারের কাঁধে বন্দুকটা আলতো করে রেখেছেন। বলেছেনও রাজ্য সরকারের সমর্থন লাগবে। এর আগে সুষমা সাফ বলেছেন, রাজ্যের সম্মতি  ছাড়া তিস্তা হবে না। মমতা যে ২০১৬ সালের বিধান সভা নির্বাচনের আগে এটা দেবেন না, সেটা খুবই স্পষ্ট। তিনি ঢাকায় আসতেই চাননি। সুতরাং মোদি বর্ণিত ‘‘যত তাড়াতাড়ি’’ মানে ২০১৬ সালের আগে নয়। আবার মমতা নির্বাচনে না এসে বামফ্রন্ট এলে ভিন্ন গল্প তৈরি হতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গে যে করেই হোক বিজেপি আসতে চাইছে, মোদি দলের জন্য কলকাতার জয়ের গুরুত্ব বোঝেন। তা মমতাকে মিনি প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তিনি একটি  মহামূল্যবান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাল কষেছেন কিংবা সেভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। মোদি-মমতা সম্পর্ক প্রশ্নে রাহুল গান্ধীর তীর্যক মন্তব্য সেটাই খোলাসা করেছে।
মোদি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে জনবক্তৃতা করেননি। আবার কিছু হিসাব যে করেননি তাও নয়। এক. জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ না করে সার্কের প্রসঙ্গে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। দুই. বাস্তবে যাই ঘটুক খবর বেরিয়েছে যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদির রুদ্ধদ্বার বা একান্ত বৈঠকে কিভাবে যেন মমতা হাইফেন হয়ে গিয়েছিলেন। তাই হাসিনা-মোদি একান্ত বৈঠক হয়নি। মোদি-খালেদা একান্ত বৈঠক হয়েছে। তিন. মোদি-খালেদা বৈঠকে ভারত ‘গণতন্ত্রের পক্ষে’ কথাটি যে উচ্চারিত হয়েছে, সেটা ভারতীয় মুখপাত্র প্রকাশ করেছেন। বিএনপি নেতারা বলেননি। এর আগে ঢাকায় খালেদার সঙ্গে মোদির বৈঠক হবে না প্রকাশের পরপরই দিল্লিতে ঘোষণা আসে এই বৈঠক হবে।
তিনটি আশংকা অনেকেরই। এক উত্তর- পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার যতটুকু বিস্তৃত হয়েছিল, সেটা হাতছাড়া হতে পারে। কারণ দেশপ্রেমিক ভারতীয়রা বাংলাদেশী পণ্য বর্জন করে বাংলাদেশের বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে আসা ভারতীয় পণ্যের জন্যই অপেক্ষা করবে। দামও কম পড়তে পারে। দুই. অভিন্ন পানিসম্পদ ব্যবহার করে যৌথ পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প ভারত আর করবে না। কারণ তারা বিদ্যুতেও ট্রানজিট সুবিধা নেবে। ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের জমিতে খুঁটি পুঁতে লাইন টেনে তারা বিদ্যুৎ নেবে আরেক ভূখণ্ডে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। মহাসড়ক বলতে কোনমতে কিছু টিকে আছে, তাও সর্বত্র সমান অবস্থায় নেই। যানজট এখন রাজধানীতে নয়, সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে। মহাসড়কেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট থাকে। সেই অবস্থায় ভারী ভারতীয় পরিবহন যুক্ত হলে তা অবস্থার উন্নতি ঘটাবে না। অনেক বিশেষজ্ঞ এতদিন বলেছেন, অবকাঠামোর উন্নয়ন না করে ট্রানজিট চালুর ফল কারো জন্য সুখকর হবে না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন ভারত বেশি লাভবান হলো বলে মনে হচ্ছে। তবে যদি উপ-আঞ্চলিক বা আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে বাংলাদেশও লাভবান হবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে,  মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত এক ডজনের বেশি রুটে ট্রানজিট নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এখন এসব রুটের অবকাঠামো কিভাবে গড়ে ওঠে সেটা দেখার বিষয় হবে। ভারতের যথেষ্ট অনুকূলে নৌ-প্রটোকল চুক্তি হয়েছে। অথচ বহু রুটে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ট্রানজিট সংক্রান্ত সরকার গঠিত কোর কমিটির আহ্বায়ক ড. মজিবুর রহমানও মনে করেন ট্রানজিটে লাভ বেশি ভারতেরই। উইন উইন সিচুয়েশন ছাড়া ট্রানজিট টিকে না।
সীমান্ত হত্যার মানবিক দিক মোদির ভাষণে ছিল না। সরাসরি গুলি বন্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কোন বক্তব্য আসেনি। বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনে ‘‘যে কোন পদক্ষেপ’’ নিতে আশ্বাস  মিলেছে। কিন্তু দু’শ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন ব্যবহারে আগের মতো ভারতবান্ধব শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ৭৫ ভাগের ব্যবহার হবে ভারতের শর্তে। সেখানে নতুন কর্মসংস্থানের হিসাব নিকাশও বেরিয়েছে। ৫৪টি অভিন্ন নদীর বেশির ভাগ এসেছে হিমালয় থেকে। আর ভারতের বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোদির বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। যৌথ ঘোষণায় এব্যাপারে রুটিন ঘোষণা এসেছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতির কারণ হবে না। ভারত বিরত থাকার  ঘোষণা দেয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে বলা হয়েছে বিদ্যমান কাঠামো মতে নাও হতে পারে। কিন্তু টিপাইমুখ যে হবে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর নন ট্যারিফ বেরিয়ার বা অশুল্ক বাণিজ্য বাধা সংক্রান্ত উদ্বেগ নিরসনে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়নি। এসব উদ্বেগ নিরসনে অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সাধারণভাবে রাজনৈতিক আশ্বাস পাওয়া  গেছে। বাংলাদেশকে বিশ্বাসে ভর করতে হবে। তাকে বিশ্বাস হারালে চলবে না। নীতিনির্ধারকদের হৃদয়ে আরও বিশ্বাস মজবুত করতে হবে।
ট্রানজিটে আরও একটি নতুন দিগন্তের আভাস মিলেছে। ফেনী নদীর ওপর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ হলে মাত্র কয়েক কিলোমিটার রাস্তা দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য যাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো নিয়ে ভারতকে বেশি চিন্তিত হতে হবে না। এ প্রসঙ্গে অনেকে অবশ্য তিনবিঘা করিডোরের ওপর নির্মিত ফ্লাইওভার দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের দাবি অগ্রাহ্য অবস্থায় থাকছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ছিল- ‘এই করিডোর বাংলাদেশকে লিজ ইন পারপিচুয়েটি’ অর্থাৎ অনন্তকালীন ইজারা দেবে। কিন্তু সামরিক যানসহ যে কোন পরিবহনের অবাধ চলাচলের বাংলাদেশী দাবি পূরণ হয়নি।
তবে প্রাপ্তির তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। অনেকেই মনে করেন এটা একটি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার যে, লাভকে কে কিভাবে দেখেন? ট্রানজিট যদি সড়কের চেহারা বদলায় এবং বিরাট শুল্ক বয়ে আনে তাহলে একে উইন উইন বিষয় হিসেবেই দেখতে হবে। মোদির সফরে কিছু কিছু চুক্তি সই হয়েছে যেগুলো উভয়  দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। চোরাচালান ও জালনোট পাচার বন্ধ,  জলবায়ু পরিবর্তনে সমঝোতা স্মারক, কোস্টগার্ড সমঝোতা স্মারক, মানবপাচার প্রতিরোধ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লির জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নীল অর্থনীতি সমপ্রসারণে সমঝোতা স্মারক, সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি, সমুদ্রবিদ্যা গবেষণার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের মধ্যে সমঝোতা স্মারক।
মোদি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিএনপি-জামায়াতসহ প্রায় প্রতিটি প্রধান দল মোদির প্রতি বিরল সম্মান দেখিয়েছেন। মিডিয়ায় সম্ভবত একটিও নেতিবাচক শিরোনাম ছিল না। বাংলাদেশ প্রেস এক অসাধারণ কাভারেজ দিয়েছে, সবাই চেয়েছে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটবে। ভারত অবশ্য তেমনটাই দাবি করেছে। এখন বাংলাদেশের জন্য কতটা সত্য হবে সেজন্য অপেক্ষার প্রহর গণনা শুরু হয়ে গেছে। তিস্তা না হওয়ার হতাশা মোদি বিবেচনায় নিয়েছেন। যে কারণে তিনি বারংবার বলেছেন, আমার ওপরে আস্থা রাখুন। বলেছেনও এই সফরের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব হবে। অনেকের মতে, একথার মাধ্যমে লাভের পাল্লা যে ভারতের দিকেই আপাতত ঝুঁকেছে, সেটা তিনি প্রকারান্তরে স্বীকারই করে গেছেন।