হাওর বার্তা ডেস্কঃ মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন প্রদান এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে জটিলতা নিরসন না হওয়ায় রোববার মধ্যরাত থেকে (১২টা) থেকে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর ফলে আজ রাত থেকে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছে, রেলমন্ত্রী রানিং স্টাফদের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন, আমরা এটাই জানি। রোববার রাত থেকেই ধর্মঘট হবে তা জানি না।
রেলওয়ের রানিং স্টাফরা জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী হেডকোয়ার্টারে তাদের ৮ ঘণ্টার ডিউটি শেষে ১২ ঘণ্টা বিশ্রাম করার কথা। কিন্তু রেলওয়ের কর্মী সংকট থাকায় তারা ৭/৮ ঘণ্টা বিশ্রাম করার পর আবার কাজে নেমে যেতেন। রেলের কর্মীরা রেলের স্বার্থে কাজ করতে চান। কিন্তু রেলওয়ে তাদের স্বার্থের বিষয়ে আন্তরিক নয়। এর প্রতিবাদে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নামতে যাচ্ছেন তারা।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় (হেডকোয়ার্টার) হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে (আউটার স্টেশন) হলে ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময়েও কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়। যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনো ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা।
মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন রানিং স্টাফরা। কয়েক দফায় অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকা এবং ধর্মঘট পালন করেছেন তারা। তবে বিভিন্ন সময়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলসচিব, রেলমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি জানিয়েছে, কর্মচারীদের অবসরোত্তর ৭৫ শতাংশ মাইলেজ মূল বেতনের সঙ্গে যোগ করে পেনশন নির্ধারণের বিধান প্রায় ১৬০ বছর ধরে চলমান ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে রেলওয়ের কোডিফাইড রুল অমান্য করে রানিং স্টাফদের পার্ট অব পে হিসেবে গণ্য মাইলেজ, যা যুগ যুগ ধরে বেতন খাতের অংশ ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে টিএ খাতে নেওয়ার ফলে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মাইলেজ যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানায়।
এরপর রানিং স্টাফরা রেলমন্ত্রী, রেল সচিবসহ রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করে প্রাপ্যতার বিষয়ে আইনগত ভিত্তি ও যুক্তি তুলে ধরেন। রেল কর্তৃপক্ষ রানিং স্টাফদের দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবন করে অর্থ মন্ত্রণালয়কে বারবার চিঠি দেন এবং প্রাপ্যতার বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করেন।
কর্মচারী সমিতি আরও জানিয়েছে, ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১০ এপ্রিল রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয় ১৩ এপ্রিল চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে রেলমন্ত্রী কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সামনে এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন। যার ধারাবাহিকতায় গত ১১ জুন রেলওয়ের মহাপরিচালক স্পষ্ট করে রানিং স্টাফদের মাইলেজ যোগে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু গত ১৮ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আবারও আপত্তি জানিয়েছে। ফলে রানিং স্টাফদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে গত ২০ আগস্ট রেলমন্ত্রী, সচিব এবং রেলওয়ে মহাপরিচালক আমাদের ডেকেছিলেন। আমাদের সব অঞ্চলের নেতাকর্মীরা সেদিন উপস্থিত হয়ে তাদের সঙ্গে বসে কথা বলেছি। কিন্তু রেলমন্ত্রী সেদিন আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে পারেননি। তিনি আমাদের হুমকি দিয়েছেন। আমরা তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছি, আর এরই মধ্যে ওনাদের প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়, এটা ১৬০ বছর ধরে চলে আসছে। ১৬০ বছর ধরে চলে আসা একটা নিয়ম হুট করে বন্ধ করে দেবে, এটা তো রেলের কোনো স্টাফ মেনে নিতে পারে না। আমরা ওনাদের বারবার সময় দিয়েছি, বারবার আন্দোলন করেছি, বারবার প্রত্যাহার করেছি। কিন্তু এবার আর কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। তিনি (রেলমন্ত্রী) যদি সেদিন ভালো ব্যবহার করে অন্তত সব নেতাদের বোঝাতে পারতেন, তাহলে একটা ব্যবস্থা হয়ত হতো। কিন্তু তিনি তা করেননি।
রানিং স্টাফদের এই কর্মবিরতিকে ‘অধিকার আদায়ের লড়াই’ হিসেবে উল্লেখ করে মজিবুর রহমান বলেন, আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলছি। আমাদের এবারের আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমরা তাদের সঙ্গে আর আলোচনায় যেতে রাজি নই। কারণ সর্বশেষ আলোচনাটা ফলপ্রসূ হয়নি। ২৮ তারিখ রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে আমরা টানা কর্মবিরতি শুরু করব।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. কামরুল আহসান বলেন, রেলওয়ের রানিং স্টাফদের সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয়ের মিটিং হয়েছে। তিনি স্টাফদের অনুরোধ করেছেন ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। আমরাও এটাই জানি। আমরা এখনো তাদের সঙ্গে কথা বলছি।