বোরো ধানের পুরোনো জনপ্রিয় জাতগুলো বার্ধক্যজনিত কারণে প্রাকৃতিকভাবেই এখন প্রত্যাশিত ফলন দিতে পারছে না। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ প্রায় আড়াই যুগ ধরে বোরো উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে। আবার দেশে ধান উৎপাদনে বোরো মৌসুম সর্বাধিক উৎপাদনশীল। তাই এটা বলা যথার্থ হবে যে, সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় আবাদকৃত জাত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে জাত দুটির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে আসছে। পুরোনো জাতের বিদায় এবং নতুন জাতের শুরুর বিষয়টি মোকাবিলার প্রস্তুতিও ছিল ব্রির। ধান গবেষণায় বিশ্বের অন্যতম সেরা এ প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েক বছর সময় নিয়ে প্রাক-প্রস্তুতি, প্রস্তুতি পর্যায় পেরিয়ে ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান৮৪, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৬, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০১ এবং ব্রি ধান১০২সহ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান১০০ এবং ব্রি ধান১০২ জাতগুলো চলতি বোরো মৌসুমে দেশের অনেক এলাকায় আবাদ হয়েছে। এসব জাত উৎপাদনে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। কল্পনাতীত ফলন পেয়েছে কৃষক। সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, এ জাতগুলোয় গড় ফলন হয়েছে বিঘাপ্রতি ২৮-৩৩ মন, কোনো কোনো এলাকায় আরও বেশি, যা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ব্রি গবেষকরা।
এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বোরো জাতের যুগসন্ধিক্ষণের অর্থাৎ বোরো জাতের প্রতিস্থাপনের সময়ের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করা এবং জাত রিপ্লেসমেন্টের (প্রতিস্থাপন) প্রস্তুতি ও অগ্রগতি সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। চলতি বছর বোরো মৌসুমে যথারীতি দেশের সিংহভাগ আবাদি জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত জাত চাষ করা হয়েছে। তবে বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে এ বছরের বোরো আবাদটি কৃষি বা খাদ্যনিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সবার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। এ বছর সারা দেশেই ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯-এর পাশাপাশি ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৬, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০১ এবং ব্রি ধান১০২ ব্যাপকভাবে চাষ হয়েছে। বোরো মৌসুমে পুরোনো জাতগুলোর অবসান এবং নতুন জাতের যুগ শুরুর এ সময়ের ওপর বিশেষ নজর রাখছে ব্রি।
সময়ের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ, উদ্ভাবিত ধানের জাতের বিভিন্ন সূচকের ফলাফল, মাঠপর্যায়ে চাষাবাদ পদ্ধতি, সমস্যা শনাক্ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা কারণে গবেষকদের মাঠপর্যায়ের নানা তথ্য সরেজমিন উপলব্ধি করা এবং কৃষকদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন হয়। সাধারণত মাঠ দিবস, কৃষক দিবস, ফসল কর্তন অনুষ্ঠান, কর্মশালা, সেমিনারসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ যোগাযোগ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। গবেষণার অংশীজনের প্রতিক্রিয়া জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ। বোরো জাতের সন্ধিক্ষণে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর অংশ হিসাবে চলতি বোরো মৌসুমে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার মুসুদ্দী গ্রাম, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলা কুশলী ইউনিয়নে রামচন্দ্রপুর গ্রাম, গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার ধনপুর গ্রাম, রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধোকড়াকুল গ্রাম, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বালীপাড়া ইউনিয়নের কাজী গ্রাম, বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের চরগাছিয়া গ্রাম, নেত্রকোনার বারহাট্টার চিছড়াকান্দা, সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠ দিবস, কৃষক দিবস ও ফসল কর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বোরো মৌসুমে ধানের জাত প্রতিস্থাপন এবং এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের কিছু কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, প্রতিবছর আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। বাড়তি এ জনসংখ্যার খাবারের নিশ্চিয়তা দিতে হলে অবশ্যই ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানগুলো চাষ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নতুন জাতের ধানের উৎপাদন খরচ কম, চালের মান ভালো, উৎপাদনও বেশি। ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯-এর প্রতিস্থাপন হচ্ছে উল্লেখ করে ব্রি মহাপরিচালক বলেন, জাত দুটি প্রায় ২৯-৩০ বছর ধরে মাঠে আছে। একটি জাত পাঁচ থেকে ছয় বছরের বেশি মাঠে থাকবে না। পাঁচ বছরের বেশি থাকলে আমাদের ফলন বাড়বে না। ফলন না বাড়লে উৎপাদন বাড়বে না। ব্রি ধান২৮-এর পরিবর্তে অনেক জাত আমরা উদ্ভাবন করেছি। সেগুলোর নাম যদি বলি ব্রি ধান৬৭-এর কথা বলতে পারি। আমাদের আরও অনেক জাত আছে যেমন-ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৯৬, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০১, ব্রি ধান১০৪ এবং ব্রি ধান১০৫সহ অনেক জাত। এগুলোর ফলন ব্রি ধান২৮-এর থেকে অনেক বেশি। এগুলোর স্পেশাল কোয়ালিটি আছে। সবগুলোই চিকন। কোনোটিতে জিংক আছে, কোনোটিতে আয়রন আছে। আমরা কিছুদিন আগে ব্রি ধান১০৫ নামে যে জাতটির উদ্ভাবন করেছি, সেটি আমরা ডায়াবেটিক রাইস হিসাবে উদ্ভাবন করেছি। ব্রি ধান১০৪ খুবই চিকন ও সুগন্ধি। আমরা বাসমতি টাইপ বলি। এ জাতগুলো ব্রি ধান২৮-এর পরিবর্তে আমরা চাষ করতে বলছি। আর ব্রি ধান২৯ এখনো মেগা ভ্যারাইটি। ভালো করছে। তারপরও ব্রি ধান২৯-এর পরিবর্তে ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান১০২-এই জাতগুলা রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে আনা হবে। এসব জাতের ব্রি ধান২৯-এর চেয়ে ফলন বেশি দেবে, সময় কম লাগবে, মান অনেক ভালো হবে। ব্রি মহাপরিচালক আরও জানান, আমরা রিপ্লেসমেন্ট স্ট্যাটেজি নিয়ে এগোচ্ছি। বর্তমান জাতগুলো পরবর্তীকালেও রিপ্লেসমেন্ট হবে আমাদের পাইপলাইন থেকে। ব্রি পাইপলাইন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ পাইপলাইন থেকে যে জাতগুলো আসবে, সেগুলো আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিস্থাপন করব। এতে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা শক্তিশালী হবে।
ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯-এর প্রতিস্থাপন জাত হিসাবে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতগুলোর সম্পর্কে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া ১৭ মে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার মুসুদ্দী-কামারপাড়া গ্রামে এক কৃষক সমাবেশে গণমাধ্যমকে বলেছেন, কৃষকের বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানগুলো। এবার এলাকাভেদে নতুন জাত ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান১০০ ও ব্রি ধান১০২ জাতগুলোর বিঘাপ্রতি গড় ফলন হয়েছে ৩০-৩৩ মন। এসব জাতের নতুন ধান চাষ করে কৃষকরা অভূতপূর্ব ফলন পেয়েছে। ৩৩ শতকে ফলন পেয়েছে ৩৩ মন। অর্থাৎ শতকে এক মন ফলন হয়েছে। কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশি ফলনের রেকর্ড রয়েছে। যেখানে ব্রি উদ্ভাবিত পুরোনো জাতগুলো ফলন ছিল বিঘাপ্রতি ২২-২৫ মন মাত্র। তিনি কৃষককে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও উচ্চফলনশীল জাত আবাদ সম্প্রসারণের পরামর্শ দেন।
ধান সুপ্রাচীনকাল থেকে লাখ লাখ মানুষের প্রধান খাদ্য। এশীয় সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল ধানের ওপর ভর করে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য ধানকে আবাদি ফসলে পরিণত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক কারণেই জাতগুলোর প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে কৌশল প্রণয়নে ব্রি অগ্রগামী। ইতোমধ্যে ২০৫০ সাল পর্যন্ত দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে ব্রি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খাদ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে উন্নত জাত উদ্ভাবনে আগামীতে ব্রি শুধু দেশেই নয়, বিশ্বে নেতৃত্বের আসনে স্থান করে নেবে, ইনশাআল্লাহ্।
মো. রাশেল রানা : প্রযুক্তি সম্পাদক ও প্রধান, প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগ, ব্রি