ড. গোলসান আরা বেগমঃ ১ জানুয়ারী ২০২৩ থেকে প্রায় ১৫ দিন অসুস্থ্য থাকায় লেখালেখির জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম।
১৬ জানুয়ারী ২০২৩ এ আগারগাঁও নিউরো সাইন্স ইনস্টিটিউটে এসেছি, এম আই আর রির্পোট পেয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেবো।আমার ছোট ছেলে পাপন আমাকে ট্রলিতে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।
রির্পোট পেতে দেরি হওয়ায় হাত রাখি মোবাইলের টাইপ বাটনে। নব্বই,পচাঁনব্বই
১৯০০ এ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আমি ঘুরেছি বাবা,মাকে নিয়ে।তাদের কে আল্লাহ জায়গা করে দিয়েছে বনানী গোড়স্থানে।আজ আমার সন্তান আমাকে নিয়ে ঘুরছে ডাক্তারের দরজায় দরজায়, এটাই চরম বাস্তবতা।এমন সময় মোবাইলে কল করে রহিম ছাত্তার আইডিয়াল কলেজের প্রভাষক মোঃ এমদাদুল হক।
কিশোরগঞ্জ জেলার কালটিয়া গাঁয়ে বাঁশ জঙ্গলের পাশে, ধান ক্ষেতে দাঁড়ানো এই কলেজটিকে প্রতিষ্টাতা অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে ২২ বছরে অনার্স পর্যায়ে উন্নীত করেছি। ২০২০ সালে অবসর গ্রহনের পর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব বর্তায় আমার ঘাড়ে।এমদাদকে ডেকে এনে জরুরী কাগজপত্রে সাক্ষর করে, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড আগার গাও এ পাঠিয়ে দেই।
১৯৯৮ সালে প্রতিষ্টিত কলেজটি ২০০২ এ ইন্টারমিডিয়েট ও ২০২৩ সালে ডিগ্রি কোর্স এমপিও ভুক্ত হয়। দশ একর জায়াগার উপর মনোরম পরিবেশের কলেজটিতে ছয়টি নান্দনিক ভবন রয়েছে। উচ্চ শিক্ষার প্রদীপ হাতে নিয়ে গাঁয়ের ছেলে মেয়েরা এই কলেজ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে, জাতীয় উন্নয়নে রাখছে অবদান। বদলে দিচ্ছে কৃষক,দরিদ্র,অসহায় বাবা মার ভাগ্যের গতিধারা। নিজেও মাটির ক্যানভাসে প্রতিদিনের রুটিন উল্টিয়ে সুসজ্জিত করছে আধুনিক জীবন প্রণালী।সরিয়ে দিচ্ছে অশিক্ষা,কুশিক্ষা,কুসংস্কারে নিমজ্জিত ধ্যান ধারণা। সঞ্চিত হচ্ছে বুদ্ধি,মেধা, মন ও মননে । বাংলাদেশের মেরুদন্ডে প্রতিষ্টিত করছে গ্লোবাল ভিলেজের সদস্য হিসাবে মানবীয়,উদার মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা, সাম্যবাদ মানসিকতা।
কলেজটা আমার জঠর নিসৃত একটি সন্তান তুল্য সুগন্ধি ফুল। এমদাদ সাহেবকে বিদায় দিয়ে চোখ সরিয়ে নেই কলেজের স্মৃতি কথা থেকে। একদিন স্মৃতি হয়ে থাকবে কত কথা, আমি বা আমরা হারিয় যাবো।সৃস্টির কাছে ফুলের ভুবনে আমরা অসহায়।
হাসপাতালের বর্হিবিভাগে ওয়েটিং রুমে বসে থাকি ডাক্তারের সিরিয়ালের অপেক্ষয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটি ছোট ছেলে শিশু পায়ের জুতা মুছে দিতে চাচ্ছে, আর দুইটা টাকা দিতে বলছে।
আমি পা সরিয়ে নিয়ে তার নাম, ঠিকানা জানতে চাই। সে বলে — নাম তার মধু।ঠিকানা জানে না। রাতে ঘুমায় হাসপাতালের পেছনে মায়ের সঙ্গে ড্রেনের উপরে কাঠের তক্তা বিছিয়ে।
মধুর মা, সে বাসাবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। হাসপাতালের বারান্দা ঝাড়ু দেয় রাতের ডিউটিতে। বস্তিতে খালার বাসায় মা ছেলে খাওয়া দাওয়া করে । মাস শেষে টাকা দেয়।
আমি ছেলেটির জীবন যাপন দেখে অবাক হই।ওরাও মানুষ।এতো সার্প চেহারার শিশু ছেলেটি ধূলাবালির আস্তরণে মিশে আছে।
অথচ স্বচ্চল পরিবারে জন্ম নিলে — ছেলেটিকে নায়ক নায়ক মনে হতো।
আমি জিঙ্গেস করি—
তোমার বাবা কোথায়?
সে কাহিনী আপনার শোনার সময় হবে? বিশ্বাস করবেন?
— বিশ্বাস হবে, তুমি বলো।
তাহলে শোনেন—মা’র কাছে শোনেছি।মা’য়ের প্রথম স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে।ছেলে সন্তানের আশায় একের পর এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়।সে রিক্সা চালাইতো। এক সময় অর্থ কষ্টে সংসার আর চালাইতে পারছিলো না।মা’কে সন্তান জন্ম দিতে পারে নাই বলে,তালাক নামা হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাস্তায় বের করে দেয়।মা বহু দ্বারে দ্বারে ঘুরে জায়গা করে নেয় ঢাকার আগার গাও বস্তিতে।সেখানেও নানা যন্ত্রণা সইতে না পেরে এখানে আশ্রয়।
তারাপর এক বেডার সাথে মা ঝুলে যায়।আমারে পেটে দিয়ে সেই বেডা পালিয়ে যায়।
আবার বিনয়ের সঙ্গে বলে –আমাকে দুইটা টাকা দেন না। দুপুরে ভাত খাবো।
আমি বলি– তোমার পড়া লেখা করতে ইচ্ছে করে না।
আমি ভর্তি হয়ে ছিলাম স্কুলে।৫ম শ্রেণিতে রেজিষ্টেশান করতে পারলাম না।বাবার আইডি কার্ডের অভাবে। মা’ তো সে বেডার বাড়ি ঘর কিচ্ছু চিনে না।কবুলও বলে নাই। আর পড়তে পারলাম না।
চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখি — বহু রুগি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে,কেউ কেউ ট্রলির উপরে, কেউবা ফ্লোরে,ডাক্তারের রুমের দরজায়। অসুস্থ্য রুগির আহাজারি দেখে ভয়ে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।দূর থেকে আগত একজন রুগি ট্রলির উপরেই মারা গেল, ডাক্তার আসতে না আসতেই। তার স্বজনরা কান্না কাটি করছে।কি ভয়াভহ দৃশ্য।ব্যানেটি ব্যাগে হাত দেই ছেলেটাকে টাকা দেবো বলে।
এমন সময় আমার ছেলে আমাকে টানতে টানতে ঢোকে যায় ডাক্তারের রুমে। দশ মিনিট পর বেরিয়ে দেখি ছেলেটি নেই।
তন্ন তন্ন করে খোঁজেও আর পেলাম না।
ওয়ার্ড বয় হুইসেল বাজিয়ে অতিরিক্ত মানুষ সরিয়ে দিচ্ছ।সেই সঙ্গে ছেলেটিও বাধ্য হয়েছে পালিয়ে যেতে। মধুর টাকা আমার হাতেই রয়ে গেলো।
মনে পড়ে সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম বড় ছেলে বাঁধনকে জন্ম দিতে। সে দিনও ভয় আতংকে কুচকে গিয়েছিলাম।ধানমন্ডির একটি ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলাম ছোট ছেলে পাপন কে পেটে নিয়ে।সিজার করার জন্য অন্য ক্লিনিকে যাওয়া পথে কণকণে শীতে গভীর রাতে শিশুটি গাড়ীতেই ডেলিভারী হয়েছিল। অপারেশানের টেবিলে ওঠলে ভয়ে দুনিয়াটা অন্ধকার মনে হয়।
ডাক্তারের পরামর্শ পত্র হাতে নিয়ে বেডিয়ে আসছিলাম।গেইটের বাহিরে চোখ পড়লো লাশ বহনকারী সারি সারি এসি অ্যাম্বুলেন্সের উপর। কোন রুগী মারা গেলে এই অ্যমবুলেন্সই নগত টাকার বিনিময়ে লাশ পৌঁছে দেয় কবরের দোড়গোড়ায়।গত বছর এই সময়ের কাছাকাছি সময়ে ভাগিনীকে এস লাশ বহনকারী গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম।বহু চেস্টা পর বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
মৃত্যু অনিবার্য সত্য।জন্মিলে মরিতে হবে।মৃত্যুর বিকল্প নেই।চাকুরী থেকে অবসরের পর অপেক্ষা করছি মহা অন্ধকারের ডাকে কবে বা কখন খাটিয়ায় ওঠতে হবে। ডাক্তার, কবিরাজ ডেকে যাত্রা পথ লম্বা করা যাবে, কিন্তু ঠেকানো যাবে না। মৃত্যু নামক ফুলের ভূবনে ভয়াবহ ভাবে অসহায় আমরা।