ড.গোলসান আরা বেগমঃ নারীবাদী ইতিহাস কোনদিন বেগম রোকেয়াকে ভুলে যেতে পারবে না। প্রায় ১৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর অবদান উপলদ্ধিতে রেখে নারী জাগরনের কিংবদন্তী বেগম রোকেয়াকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।এই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দর গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পরিবার ছিলো খুবই রক্ষণশীল। পাঁচ বছর বয়স থেকে তাকে পর্দা করতে হতো। বায়ান্ন বছর বেঁচে ছিলেন। তখনকার সময় বাড়ির বাহিরে গিয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করার সুযোগ ছিলো না। তিনি কলকাতায় মায়ের সঙ্গে যখন বসবাস করতেন, তখন একজন ইংরেজ মহিলা শিক্ষক বাড়ীতে এসে বেগম রোকেয়াকে পড়াতো।কিন্তু সমাজ ও আত্মীয় স্বজনের ভ্রুকুটি জন্য কছু দিনের মাথায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
সকল প্রতিবন্ধকতা মোখাবেলা করে বেগম রোকেয়া ছিলেন একাধারে একজন প্রাবন্ধিক,ঔপন্যাসিক,মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত,শিক্ষাবিদ,নারীবাদী, সমতার সমাজ বির্ণিমানের কারিগর। বহুধা প্রতিভার অধিকারী এই নারী যখন জন্ম গ্রহন করেন তখন আমাদের উপমহাদেশের নারীজাতি ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারে
নিমজ্জিত ছিলো। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে সূর্য্য দেখাও নারীর জন্য নিষিদ্ধ ছিলো।তখন তিনি এই উপমহাদেশে আর্বিভূত হন অবরোধবাসিনীদের মুক্তির দূত হিসেবে।
নারীরা মাতা,ভগিনী,কন্যা এই তিন পরিচয়ে সমাজে এখনও প্রতিষ্ঠিত। প্রায় ক্ষেত্রেই নারীর নিজস্ব কোন সত্বা বা পরিচিতি নেই।অমুকের মা,তমুকের বউ, উনার কন্যা ইত্যাদি নামে প্রতিষ্ঠিত। বেগম রোকেয়া এ কারণেই বলেছেন –” যাহা হউক মাতা,ভগিনী,কন্যা? আর ঘুমাইও না উঠ,কর্তব্য পথে অগ্রসর হও “। নারী সমাজকে জেগে ওঠার আহবান জানিয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।সেই ধারাবাহিকতা মাথায় রেখে ঘাম ঝরানো, রক্তবাহী বহু লড়াই বিপ্লবের পর নারীরা সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে জায়গা করে নিয়েছে।
ছোট বেলায় তাঁর নাম ছিলো রোকেয়া খাতুন। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে ১৮৯৮ সালে ১৬ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তাঁর নাম হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন,তবে বেগম রোকেয়া হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত।নয় বছর বিবাহিত জীবন অতিক্রম করার পর বেগম রোকেয়া বিধবা হন।দুইটি মেয়ে সন্তান জন্ম গ্রহন করিলেও মারা যায়।
তিনি বড় ভাই,বোন ও স্বামীর সমযোগিতায়া স্বশিক্ষিত হন।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও বাংলা,ইংরেজি,উর্দূ তিনটি ভাষাই ছিলো তার দখলে।বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন নারী জাগরণের জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষায় অগ্রসরতা। তিনি এ কারণেই আট জন ছাত্রী নিয়ে স্বামির বাড়ির এলাকা,বিহারের ভাগলপুরে সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়েল স্কুল চালু করেন। অত:পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেন।জমিজমা নিয়ে তার সতিনের ছেলেদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় স্কুল বন্ধ করে চলে আসেন কলকাতায়। অতপর স্বামীর নিদের্শনা অনুযায়ী কলকাতায় সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়ার নারীবাদী চিন্তা চেতনার প্রসার না ঘটলে আজো নারীরা সেই অন্ধকার কুয়োর ব্যাঙ হয়ে বেঁচে থাকতো।তিনি নারীকে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছেন যে – সে যেন ভবিষৎ জীবনে আদর্শ গৃহিনী,আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারী রুপে প্রতিষ্ঠা পায়।
আধুনিক মনস্ক বেগম রোকেয়া মনে করতেন যে কোন দেশের বা সমাজের উন্নয়নের জন্য নারী পুরুষের সমান সহযোগিতা প্রয়োজন। নারী এবং পুরুষকে একটি গাড়ীর দুই চাকা মনে করতেন।এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির প্রাচীর ভেঙ্গে সমাজপতিদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে জীবন ব্যাপি সংগ্রাম করেছেন। সেই নারী বিপ্লবের সুফলতা আমরা বাঙালি নারীরা বর্তমানে ভোগ করছি। বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানে নারী পুরুষে সমতা শব্দটি জায়গা করে নিয়েছে। যদিও বাস্তবে তা আলোর মুখ দেখে নাই সকল ক্ষেত্রে।তিনি ছেয়েছিলেন নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু না,নারীরা আজো মেয়ে মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত।
বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাননি, হাতে তুলে কলম লিখেছেন গল্প, উপন্যাস,কবিতা, বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী। প্রবন্ধসহ শ্লেষাত্মক রচনায় ছিলো তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ঠতা।১৯০২ সালে নবপ্রভা পত্রিকায় প্রথম লেখা গদ্য পিপাসা ছাপা হয়। তা ছাড়াও নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী প্রত্রিকায় লিখতেন। ইংরেজীতে সুলতানার স্বপ্ন(১৯০৫)নামক কল্প কাহিনী অনুবাদ করেন।যা লেডি ল্যান্ড বা নারীস্থান নামে খ্যাত।সুলতানার স্বপ্নকে নারীবাদী সাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে ধরা হয়।পদ্মরাগ উপন্যাস রচনা করেন ১৯২৫ সালে। মতিচুর ( প্রথম খন্ড ১৯০৪,২য় খন্ড১৯২২) প্রবন্ধ গ্রন্থে নারী পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠার আহবান রাখেন। অবরোধবাসিনী (১৯৩১) প্রবন্ধ গ্রন্থটি রচনার পর বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালে মুত্যুবরণ করেন।অবরোধবাসিনী প্রবন্ধ গ্রন্ধে পর্দা প্রথার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, ঘরের বাহিরে গিয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরী, মুক্তচিন্তার মানসিকতার প্রদীপ বাঙালি নারী সমাজের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আন্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি। ২০০৪ সালে একত্রিশ দিন ব্যাপী বিবিসি শ্রোতাদের জরীপ অনুযায়ী বেগম রোকেয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নারীদের তালিকায় ষষ্ঠ স্থান দখল করেন।
ধর্ম সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার দৃস্টিভঙ্গি ছিলো – সকল ধর্মই পুরুষ দ্বারা রচিত।নারী সমাজকে অবদমিত করার জন্য ধর্মগ্রন্থের জন্ম। রংপুরে বেগম রোকেয়ার বাবার বাড়ীতে নারীকে স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র। বাংলাদেশে তার প্রতিভার স্বাক্ষর হিসেবে বেগম বোকেয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হচ্ছে প্রতি বছর। কলকাতার সোদপুর থেকে তার কবরস্থান বাংলাদেশে স্থানান্তরের প্রস্তাব উত্থাপিত হচ্ছে নারীবাদী কর্মী দ্বারা। আমরা নারীবাদি মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করি প্রতিটি নারী বেগম রোকায়ার মত চেতনাময়ী হয়ে উঠুক।
লেখকঃ উপদেষ্ঠা সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক লীগ,কেন্দ্রীয় কমিটি।