হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইয়াশা মৃধা সুকন্যা (১৮) গত ২৩ জুন দুপুরে কলেজে মডেল টেস্ট দিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। সেদিন রাত ৮টা ৩৯ মিনিটে তার ফেইসবুক মেসেঞ্জার থেকে মা নাজমা ইসলাম লাকীর ফেইসবুকে ম্যাসেজ আসে ‘আমি আসতেছি, রাস্তায় আছি।’ এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই সুকন্যার। একমাত্র মেয়ের ফেরার পথ চেয়ে সারাক্ষণ বসে থাকেন লাকী।
রাজধানীর দক্ষিণ মুগদাপাড়া আনন্দবাজার রোডের বাসিন্দা লাকী মেয়ের খোঁজ পেতে থানা পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও র্যাবের কাছে গত দুই মাস দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু কেউ তার মেয়ের সন্ধান দিতে পারছে না। মায়ের ধারণা, সুকন্যাকে অপহরণ করে পাচার করে দিয়েছে। মেয়েকে যেকোনো মূল্যে জীবিত ফিরে পেতে চান মা নাজমা ইসলাম।
মামলাটির বর্তমান তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মিশু বিশ্বাস বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আমরা এখনো নিখোঁজ কলেজছাত্রীর কোনো সন্ধান পাইনি।’
সুকন্যা নিখোঁজের দিনই রমনা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার মা। পরদিন সুকন্যার কথিত প্রেমিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসতিয়াক আহম্মেদ চিশতি ও ইসতিয়াকের বন্ধু শেখ সালমানকে আটক করে পুলিশ। পরে গত ২৫ জুন রমনা মডেল থানায় নাজমা ইসলামের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাদের। পরে সালমান জামিনে মুক্তি পেলেও কারাগারে আছেন ইসতিয়াক।
মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, গত ২৩ জুন দুপুর সাড়ে ১২টায় সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে সুকন্যার মডেল টেস্ট ছিল। সেদিন তিনি মায়ের সঙ্গে কলেজে যান। পরীক্ষা চলাকালেও মা অভিভাবকদের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। বিকেল ৩টায় পরীক্ষা শেষ হলেও খোঁজ মিলছিল না সুকন্যার। কলেজের শিক্ষকরা নাজমা ইসলাম লাকীকে জানান, পরীক্ষায় অংশই নেয়নি সুকন্যা।
লাকী জানিয়েছেন, নিখোঁজের পর তার কাছে থাকা সুকন্যার মুঠোফোন ঘেঁটে দেখা যায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসতিয়াকের সঙ্গে দেখা করার পূর্বপরিকল্পনা ছিল সুকন্যার। সেই সূত্র ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ২৪ জুন ইসতিয়াক ও তার এক বন্ধুকে আটক করে পুলিশ। থানায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি। ইসতিয়াক পুলিশের কাছে দাবি করেছেন যে, ঘটনার দিন রাজধানীর গেন্ডারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সুকন্যাকে নিয়ে তিনি ঘোরাঘুরি করেছেন। পরে রাতে সুকন্যাকে বাসার উদ্দেশ্যে রিকশায় তুলে দেন।
লাকী জানান, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনিও ইসতিয়াকের কাছে সুকন্যার বিষয়ে জানতে চান। মেয়েকে কারও হাতে তুলে দিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে মাথা নিচু করে নিরুত্তর থেকেছেন ইসতিয়াক।
তথ্যপ্রযুক্তি ও সিসি টিভি ফুটেজের তথ্য ঘেঁটে সুকন্যার নিখোঁজের সঙ্গে ইসতিয়াকের যোগাযোগ থাকার তথ্য পায় পুলিশ। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, রাজধানীর বেইলি রোড থেকে সুকন্যাকে গেন্ডারিয়া এলাকায় নিয়ে যান ইসতিয়াক ও তার কয়েক বন্ধু। পরে তারা একসঙ্গে ঘোরাফেরাও করেন। তবে ওইদিন রাত ৮টার দিকে সুকন্যাকে গেন্ডারিয়া এলাকা থেকে রিকশায় তুলে দেন ইসতিয়াক। কিন্তু এরপর সুকন্যা কোথায় গেছেন তার কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। ইসতিয়াকও দুই দফায় রিমান্ডে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, সুকন্যাকে বাসার উদ্দেশ্যে তিনি রিকশায় তুলে দেন। এরপর কী হয়েছে তিনি কিছু জানেন না।
পুলিশের উদ্ধার করা ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঘেঁটে দেখা গেছে ঘটনার দিন ২৩ জুন সন্ধ্যা ৭টা ৭ মিনিটের দিকে রাজধানীর গেন্ডারিয়া এলাকায় একই রিকশায় যাচ্ছিলেন ইসতিয়াক ও সুকন্যা। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রাত ৮টা ৫ মিনিটে একই এলাকায় দুজনকে দেখা যায় আলাদা দুটি রিকশায়। সুকন্যার রিকশার পিছু নিতে দেখা যায় ইসতিয়াককে। সুকন্যার কাছে এ সময় একটি মোবাইল ফোনসেটও দেখা যায়। তবে সুকন্যার মা লাকী দাবি করেছেন, সুকন্যার মোবাইল ফোনটি তার কাছে রয়েছে। তাহলে ওই ফোনটি কার এমন প্রশ্ন করেন লাকী।
গতকাল দেশ রূপান্তরের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে লাকী বলেন, ‘১৮ বছরের একটা মেয়ে গত দুই মাস ধরে গায়েব রয়েছে অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। থানা পুলিশ, র্যাব, ডিবি সবার কাছে গিয়েছি। কিন্তু কেউ আমার মেয়েকে খুঁজে দিচ্ছে না। ডিবি সর্বশেষ বলেছে, ‘আমার মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ।’ তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়েকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব। ওর বাবা জন্মের পর থেকে লন্ডনে রয়েছে। একবারের জন্যও দেশে আসে নাই। আমি তিল তিল করে ওকে মানুষ করেছি। আমি আমার মেয়েকে জীবিত ফিরে পেতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, তার মেয়ে সবসময় ফেইসবুক আর ইন্সটাগ্রামে ব্যস্ত থাকত। তবে এর আগে কখনই বাইরের কারও সঙ্গে ঘুরতে বের হয়নি। কারও সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন তথ্যও তার জানা ছিল না। জন্মের পর থেকে সুকন্যার বাবা বিদেশে থাকায় ও মানসিকভাবে ভালো ছিল না।
মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা রমনা মডেল থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মফিজুর রহমান গতকাল বলেন, ‘এ ঘটনায় আমি দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। তদন্তে দেখা গেছে ঘটনার মাস তিনেক আগে ফেইসবুকে ইসতিয়াক আহম্মেদ চিশতী নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় সুকন্যার। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়। ঘটনার দিন কলেজ থেকে বের হয়ে ওই ইসতিয়াকের সঙ্গেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরেছে সে।’
থানা পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে না পারায় লাকী অন্য সংস্থা দিয়ে তদন্ত করার আবেদন জানান আদালতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ জুলাই আদালত পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়।
মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির রমনা বিভাগের এসআই মো. সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ‘ইসতিয়াককে দুই দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে শুক্রবার (গতকাল) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে সুকন্যা কোথায় গেছে বা আছে সে তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমরাও অনেকটা অবাক হচ্ছি মেয়েটা কোথায় গেল। কেন তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আমরা সম্ভাব্য সকল বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।’