ঢাকা ০৩:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৩০ প্রজাতির ফল চাষে তাক লাগিয়েছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩৯:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ মে ২০২২
  • ১৫৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সোনারাম কারবারি পাড়ায় চারিদিকে হ্রদ বেষ্টিত একটি পাহাড়ে নিজের বসতবাড়ির চারপাশে প্রায় ১০ একর পাহাড়ি ঢালু জমিতে ৩০ প্রজাতির ফল চাষে তাক লাগিয়েছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

আম, কাঁঠাল, কুল, লিচু, আমলকী, পেঁপে, তেতুল, মাল্টা, জাম্বুরা, নারিকেল, সুপারি, কলা, লটকোন, রাম্বুটান, বেল, আনারস, চালতাসহ তার এ বাগানে রয়েছে প্রায় ২৫/৩০ প্রজাতির ফল গাছ। ফল গাছের পাশাপাশি শতাধিক দারুচিনি ও গোলমরিচের চারাও লাগিয়েছেন তার বাগানে। তাছাড়া ফল বাগানের মধ্যবর্তী স্থানে বিভিন্ন মৌসুমি ফসল যেমন- শাকসবজি, বিলাতি ধনিয়া, ক্যাসাভা ইত্যাদি থেকেও আসে বাড়তি আয়।

 

সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা জানান ২০১৬ সালে পরিকল্পিত ফল বাগান স্থাপনের পূর্বে একপ্রকার বেকারই ছিলেন তিনি। অপরিকল্পিত জুম চাষ আর কাপ্তাই লেকে মাছ ধরে কোনরকমে সংসার চালাতেন তিনি। কিন্তু কৃষি বিভাগের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ এবং উপকরণ সহায়তা পেয়ে আজ তিনি একজন সচ্ছল কৃষক, সফল কৃষি উদ্যোক্তা এবং এলাকায় অনুসরণীয় আদর্শ। বাগানের ফসলের উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে গত বছরে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা নীট লাভ পেয়েছেন। আগামীতে লাভের পরিমান প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে এমনটাই আশা করছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সরেজমিন তার মিশ্র ফল বাগান পরিদর্শন করে দেখা যায় উঁচু পাহাড়ে বসতঘর তৈরি করে তার চারপাশে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের মিশ্র ফল বাগান। পুরো বাড়ির আঙ্গিনার চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ রয়েছে। বর্তমানে তার মিশ্র ফল বাগানের কুল গাছে প্রচুর ফল ধরেছে এবং তিনি নিয়মিত বাগান থেকে বিক্রিও করছেন। সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন আমার বাগানে বল সুন্দরী, কাশ্মীরি, আপেল জাতের শতাধিক গাছের পাশাপাশি ৩০ টির মতো দেশি মিষ্টি ও টক জাতের কুল গাছ রয়েছে।

 

বর্তমানে পাহাড়ের কৃষকরা ব্যাপক হারে বল সুন্দরী, কাশ্মীরি, আপেল এবং বাউকুল চাষ করার কারণে দেশি কুল বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু আচারসহ অন্যান্য মুখরোচক খাবার তৈরিতে দেশি কুলের বিকল্প না থাকায় তুলনামূলকভাবে বেশি দাম দিয়ে ক্রেতারা দেশি কুল কিনে থাকেন। এই সুযোগটাকেই আমি কাজে লাগিয়েছি।

দেশি কুলে লাভ বেশি ও রোগবালাই কম হওয়ায় আগামীতে আমার বাগানে দেশি কূলের গাছের সংখ্যা আরো বাড়াবো।˝ এ বাগানের আয়ের আর একটি প্রধান অনুসঙ্গ হচ্ছে রেডলেডি জাতের পেঁপে। বাগানের প্রায় ৫০০টি ফলন্ত রেডলেডি জাতের পেঁপে গাছ থেকে ইতিমধ্যে লক্ষাধিক টাকার পেঁপে বিক্রি করেছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। রেডলেডি পেঁপে সহজে নষ্ট না হওয়ায় দূর-দূরান্তে পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যাপারিদের কাছে এই পেঁপের চাহিদা বেশি।

এজন্য আগামী বর্ষা মৌসুমে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় আরো ১০০০টি রেডলেডি জাতের পেঁপের চারা লাগানোর পরিকল্পন রয়েছে তার। তার বাগানের লটকোন সম্পর্কে বলেন, পাহাড়ের লাল মাটিতে লটকোন খুব ভালো হচ্ছে। আমার বাগানে ৩০০টির মত গাছ থেকে এবার প্রায় ১ লাখ টাকার লটকোন বিক্রি করেছি। এ ফল চাষে তেমন কোন পরিচর্যা বা খরচ না থাকলেও বেশ ভালো আয় করা যায়।

 

আমার ফল গাছে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে গোবর সার, কম্পোস্ট সার বেশি ব্যবহার করি। আর শুষ্ক মৌসুমে গাছের গোড়ায় খড়, শুকনা আগাছা আবর্জনা দিয়ে জাবড়া দিয়ে দেই। ফলবাগানের ভিতর উচ্চমূল্যের ফসল বিলাতি ধনিয়া চাষে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। ছায়া পছন্দকারী বিলাতি ধনিয়া চাষে কৃষকরা সাধারণত আলাদাভাবে মাচা তৈরি করে তার নিচে এককভাবে বিলাতি ধনিয়া চাষ করে, যার ফলে খরচ অনেক বেড়ে যায়।

সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার বাগানের উল্লেখযোগ্য অংশে ফলগাছের নিচের ছায়াময় জমিতে বেশ ভালোভাবেই জন্মাচ্ছে বিলাতি ধনিয়া। মসলা হিসাবে পাতাসহ গাছ বিক্রির পর অবশিষ্ট গাছ থেকে নিজেই বীজ তৈরি করেন তিনি। স্থানীয় বাজারে ১ কেজি বিলাতি ধনিয়ার বীজ মানভেদে ৭০০০ থেকে ৮০০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ বছর আনুমানিক ২ লক্ষ টাকার বিলাতি ধনিয়া বিক্রি করেছেন বলে জানান সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সুশান্তÍ তঞ্চঙ্গ্যা আরও জানায়, আমার বাগানে নিয়মিত ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করে। আমার এ বাগান গড়ে তোলার পর স্থানীয় অনেক বেকার যুবক কাজের সন্ধান পেয়েছেন। আমার নিজের যেমন আয় বেড়েছে অন্যদিকে পাহাড়ের মানুষও ভেজালমুক্ত, রাসায়নিকমুক্ত ফল ও শাকসবজি পাচ্ছেন। আমি মনে করি এতে মানুষের সেবা করাও যাচ্ছে।

 

চাকরির পেছনে না ছুটে বেকার জীবন কাটানোর চেয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হলে সমাজে বেকার মানুষের সংখ্যা কমে আসবে, প্রত্যন্ত পাহাড়ের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ায় এলাকায় বেশ প্রশংসিতও হচ্ছেন কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। অনেকেই এখন তার মত বাগান গড়ে তোলার কথা ভাবছেন। দেখছেন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন।

এজন্য তারা কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগ থেকে সহায়তা পাওয়ার কথা বলছেন। একই এলাকার শ্যামল চাকমা জানান, সুশান্তের বাগানে বিভিন্ন মৌসুম এলে বাগান পরিচর্যার কাজে নারী-পুরুষ অনেকেই কাজের সুযোগ পান। গ্রামের দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানেও তার ভূমিকা রয়েছে। সব মিলিয়ে সুশান্ত আমাদের গ্রামের একজন সফল মানুষ।

রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে স্নাতকে অধ্যয়নরত সোনারাম কারবারি পাড়ার বাসিন্দা জয়মঙ্গল চাকমা বলেন, পড়াশোনার মাঝের অবসর সময়ে তেমন কোন কাজ থাকে না আমার মতো অনেক তরুণদের। অবসর সময়ের জন্য সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার মতো আমিও মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলার কথা ভাবছি। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবু মো: মনিরুজ্জামান বলেন, কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা এলাকার একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি একজন আধুনিক কৃষি জ্ঞানসম্পন্ন কৃষক। কৃষি বিভাগ শুরু থেকেই তাকে বাণিজ্যিক মিশ্র বাগান করার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে।

 

এছাড়া বিভিন্ন কৃষি প্রণোদনা ও সম্প্রসারণ কর্মকা-ে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। প্রত্যন্ত পাহাড়গুলোতে কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তোলার জন্য তিনি একজন প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার উপপরিচালক কৃষিবিদ তপন কুমার পাল বলেন, রাঙ্গামাটিতে কাপ্তাই লেক বেষ্টিত অনেক ছোট বড় পাহাড় বা টিলা রয়েছে। এসব পাহাড়ে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন বিভিন্ন ফল, কফি, দারুচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ, কাজুবাদাম ইত্যাদির পরিকল্পিত বাগান স্থাপনের অনেক সুযোগ রয়েছে।

ইতিমধ্যে সদর উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার পাহাড়ে বারি মাল্টা-১ জাতের ১৫০টি গাছের প্রদর্শনী বাগান স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকেও বিভিন্ন মসলা ফসল চাষে বিভিন্ন উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বাগানে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বিদ্যমান বিভিন্ন ফল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের সম্ভাবনাময় ফসল কফির বাগান স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন বাগানের উৎপাদিত পন্য বাজারজাতকরণে কৃষকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারীদের সাথে কৃষকদের সংযোগ স্থাপনে কৃষি বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা জানান আমি এ বাগানে ইতিমধ্যে ৫০টি রাম্বুটান গাছ লাগিয়েছি।

 

আশা করছি আগামী ২-৩ বছর পর ফলন পেতে শুরু করব। কাপ্তাই লেকের পানি বেষ্টিত আমার এ পাহাড়ের চারপাশে আরো নারিকেল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নারিকেলে আয় বেশি আর পাহাড় ক্ষয়রোধেও বেশ ভালো ভূমিক রাখে। ১০ একরের আমার এ বাগানের ফাঁকা স্থানে ড্রাগন,কমলা, পার্সিমন ইত্যাদি নতুন নতুন ফল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া আমার আরো একটি ৮ একরের পতিত পাহাড়ি টিলা রয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের উঁচুতে সেচ দেওয়ার জন্য ড্রিপ ইরিগেশন উপকরণ, সোলার সেচ পাম্প, ফসল প্রদর্শনী স্থাপন ইত্যাদি সহায়তা পেলে সেখানেও বাণিজ্যিক মিশ্র ফল বাগান স্থাপন করবেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার মতো এলাকার অনেকেই বিভিন্ন সমস্যার উপর আলোকপাত করে বলেন, এসব প্রত্যন্ত এলাকায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় নিজেদের পন্য বিক্রির জন্য একমাত্র নৌ পথের উপরই ভরসা করতে হয় আমাদের। যার ফলে ন্যায্য বাজারমূল্য থেকে বঞ্চিত হই আমরা। তাছাড়া বাগানের পাহাড়ের উঁচু স্থানগুলোতে কার্যকর সেচব্যবস্থা স্থাপনে সাধারণ কৃষকদের আর্থিক অক্ষমতাও রয়েছে।

অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং প্রচেষ্টা থাকলে সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে সামনে যে এগিয়ে যাওয়া যায় সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার দৃষ্টান্ত সে বার্তাই দিচ্ছে এলাকার আগ্রহী সকল কৃষকদের মাঝে। এলাকার কৃষকদের সমস্যা সমাধানে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং উপযুক্ত সহায়তা প্রদান করা গেলে অদুর ভবিষ্যতে অনাবাদি পতিত পাহাড়ের প্রচলিত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের আমূল পরিবর্তন ঘটবে, ঘটবে কৃষি বিপ্লব। এক একটি পাহাড় এক একটি বাণিজ্যিক খামারে পরিণত হবে।

৩০ প্রজাতির ফল চাষে তাক লাগিয়েছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা লেখাটির লেখক আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, রাঙ্গামাটি। মোবাইল : ০১৭১২৮১৬৩৫২।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

৩০ প্রজাতির ফল চাষে তাক লাগিয়েছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

আপডেট টাইম : ০৫:৩৯:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ মে ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সোনারাম কারবারি পাড়ায় চারিদিকে হ্রদ বেষ্টিত একটি পাহাড়ে নিজের বসতবাড়ির চারপাশে প্রায় ১০ একর পাহাড়ি ঢালু জমিতে ৩০ প্রজাতির ফল চাষে তাক লাগিয়েছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

আম, কাঁঠাল, কুল, লিচু, আমলকী, পেঁপে, তেতুল, মাল্টা, জাম্বুরা, নারিকেল, সুপারি, কলা, লটকোন, রাম্বুটান, বেল, আনারস, চালতাসহ তার এ বাগানে রয়েছে প্রায় ২৫/৩০ প্রজাতির ফল গাছ। ফল গাছের পাশাপাশি শতাধিক দারুচিনি ও গোলমরিচের চারাও লাগিয়েছেন তার বাগানে। তাছাড়া ফল বাগানের মধ্যবর্তী স্থানে বিভিন্ন মৌসুমি ফসল যেমন- শাকসবজি, বিলাতি ধনিয়া, ক্যাসাভা ইত্যাদি থেকেও আসে বাড়তি আয়।

 

সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা জানান ২০১৬ সালে পরিকল্পিত ফল বাগান স্থাপনের পূর্বে একপ্রকার বেকারই ছিলেন তিনি। অপরিকল্পিত জুম চাষ আর কাপ্তাই লেকে মাছ ধরে কোনরকমে সংসার চালাতেন তিনি। কিন্তু কৃষি বিভাগের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ এবং উপকরণ সহায়তা পেয়ে আজ তিনি একজন সচ্ছল কৃষক, সফল কৃষি উদ্যোক্তা এবং এলাকায় অনুসরণীয় আদর্শ। বাগানের ফসলের উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে গত বছরে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা নীট লাভ পেয়েছেন। আগামীতে লাভের পরিমান প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে এমনটাই আশা করছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সরেজমিন তার মিশ্র ফল বাগান পরিদর্শন করে দেখা যায় উঁচু পাহাড়ে বসতঘর তৈরি করে তার চারপাশে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের মিশ্র ফল বাগান। পুরো বাড়ির আঙ্গিনার চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ রয়েছে। বর্তমানে তার মিশ্র ফল বাগানের কুল গাছে প্রচুর ফল ধরেছে এবং তিনি নিয়মিত বাগান থেকে বিক্রিও করছেন। সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন আমার বাগানে বল সুন্দরী, কাশ্মীরি, আপেল জাতের শতাধিক গাছের পাশাপাশি ৩০ টির মতো দেশি মিষ্টি ও টক জাতের কুল গাছ রয়েছে।

 

বর্তমানে পাহাড়ের কৃষকরা ব্যাপক হারে বল সুন্দরী, কাশ্মীরি, আপেল এবং বাউকুল চাষ করার কারণে দেশি কুল বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু আচারসহ অন্যান্য মুখরোচক খাবার তৈরিতে দেশি কুলের বিকল্প না থাকায় তুলনামূলকভাবে বেশি দাম দিয়ে ক্রেতারা দেশি কুল কিনে থাকেন। এই সুযোগটাকেই আমি কাজে লাগিয়েছি।

দেশি কুলে লাভ বেশি ও রোগবালাই কম হওয়ায় আগামীতে আমার বাগানে দেশি কূলের গাছের সংখ্যা আরো বাড়াবো।˝ এ বাগানের আয়ের আর একটি প্রধান অনুসঙ্গ হচ্ছে রেডলেডি জাতের পেঁপে। বাগানের প্রায় ৫০০টি ফলন্ত রেডলেডি জাতের পেঁপে গাছ থেকে ইতিমধ্যে লক্ষাধিক টাকার পেঁপে বিক্রি করেছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। রেডলেডি পেঁপে সহজে নষ্ট না হওয়ায় দূর-দূরান্তে পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যাপারিদের কাছে এই পেঁপের চাহিদা বেশি।

এজন্য আগামী বর্ষা মৌসুমে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় আরো ১০০০টি রেডলেডি জাতের পেঁপের চারা লাগানোর পরিকল্পন রয়েছে তার। তার বাগানের লটকোন সম্পর্কে বলেন, পাহাড়ের লাল মাটিতে লটকোন খুব ভালো হচ্ছে। আমার বাগানে ৩০০টির মত গাছ থেকে এবার প্রায় ১ লাখ টাকার লটকোন বিক্রি করেছি। এ ফল চাষে তেমন কোন পরিচর্যা বা খরচ না থাকলেও বেশ ভালো আয় করা যায়।

 

আমার ফল গাছে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে গোবর সার, কম্পোস্ট সার বেশি ব্যবহার করি। আর শুষ্ক মৌসুমে গাছের গোড়ায় খড়, শুকনা আগাছা আবর্জনা দিয়ে জাবড়া দিয়ে দেই। ফলবাগানের ভিতর উচ্চমূল্যের ফসল বিলাতি ধনিয়া চাষে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। ছায়া পছন্দকারী বিলাতি ধনিয়া চাষে কৃষকরা সাধারণত আলাদাভাবে মাচা তৈরি করে তার নিচে এককভাবে বিলাতি ধনিয়া চাষ করে, যার ফলে খরচ অনেক বেড়ে যায়।

সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার বাগানের উল্লেখযোগ্য অংশে ফলগাছের নিচের ছায়াময় জমিতে বেশ ভালোভাবেই জন্মাচ্ছে বিলাতি ধনিয়া। মসলা হিসাবে পাতাসহ গাছ বিক্রির পর অবশিষ্ট গাছ থেকে নিজেই বীজ তৈরি করেন তিনি। স্থানীয় বাজারে ১ কেজি বিলাতি ধনিয়ার বীজ মানভেদে ৭০০০ থেকে ৮০০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ বছর আনুমানিক ২ লক্ষ টাকার বিলাতি ধনিয়া বিক্রি করেছেন বলে জানান সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সুশান্তÍ তঞ্চঙ্গ্যা আরও জানায়, আমার বাগানে নিয়মিত ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করে। আমার এ বাগান গড়ে তোলার পর স্থানীয় অনেক বেকার যুবক কাজের সন্ধান পেয়েছেন। আমার নিজের যেমন আয় বেড়েছে অন্যদিকে পাহাড়ের মানুষও ভেজালমুক্ত, রাসায়নিকমুক্ত ফল ও শাকসবজি পাচ্ছেন। আমি মনে করি এতে মানুষের সেবা করাও যাচ্ছে।

 

চাকরির পেছনে না ছুটে বেকার জীবন কাটানোর চেয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হলে সমাজে বেকার মানুষের সংখ্যা কমে আসবে, প্রত্যন্ত পাহাড়ের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ায় এলাকায় বেশ প্রশংসিতও হচ্ছেন কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। অনেকেই এখন তার মত বাগান গড়ে তোলার কথা ভাবছেন। দেখছেন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন।

এজন্য তারা কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগ থেকে সহায়তা পাওয়ার কথা বলছেন। একই এলাকার শ্যামল চাকমা জানান, সুশান্তের বাগানে বিভিন্ন মৌসুম এলে বাগান পরিচর্যার কাজে নারী-পুরুষ অনেকেই কাজের সুযোগ পান। গ্রামের দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানেও তার ভূমিকা রয়েছে। সব মিলিয়ে সুশান্ত আমাদের গ্রামের একজন সফল মানুষ।

রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে স্নাতকে অধ্যয়নরত সোনারাম কারবারি পাড়ার বাসিন্দা জয়মঙ্গল চাকমা বলেন, পড়াশোনার মাঝের অবসর সময়ে তেমন কোন কাজ থাকে না আমার মতো অনেক তরুণদের। অবসর সময়ের জন্য সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার মতো আমিও মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলার কথা ভাবছি। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবু মো: মনিরুজ্জামান বলেন, কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা এলাকার একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি একজন আধুনিক কৃষি জ্ঞানসম্পন্ন কৃষক। কৃষি বিভাগ শুরু থেকেই তাকে বাণিজ্যিক মিশ্র বাগান করার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে।

 

এছাড়া বিভিন্ন কৃষি প্রণোদনা ও সম্প্রসারণ কর্মকা-ে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। প্রত্যন্ত পাহাড়গুলোতে কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তোলার জন্য তিনি একজন প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার উপপরিচালক কৃষিবিদ তপন কুমার পাল বলেন, রাঙ্গামাটিতে কাপ্তাই লেক বেষ্টিত অনেক ছোট বড় পাহাড় বা টিলা রয়েছে। এসব পাহাড়ে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন বিভিন্ন ফল, কফি, দারুচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ, কাজুবাদাম ইত্যাদির পরিকল্পিত বাগান স্থাপনের অনেক সুযোগ রয়েছে।

ইতিমধ্যে সদর উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার পাহাড়ে বারি মাল্টা-১ জাতের ১৫০টি গাছের প্রদর্শনী বাগান স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকেও বিভিন্ন মসলা ফসল চাষে বিভিন্ন উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বাগানে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বিদ্যমান বিভিন্ন ফল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের সম্ভাবনাময় ফসল কফির বাগান স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন বাগানের উৎপাদিত পন্য বাজারজাতকরণে কৃষকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারীদের সাথে কৃষকদের সংযোগ স্থাপনে কৃষি বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা জানান আমি এ বাগানে ইতিমধ্যে ৫০টি রাম্বুটান গাছ লাগিয়েছি।

 

আশা করছি আগামী ২-৩ বছর পর ফলন পেতে শুরু করব। কাপ্তাই লেকের পানি বেষ্টিত আমার এ পাহাড়ের চারপাশে আরো নারিকেল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নারিকেলে আয় বেশি আর পাহাড় ক্ষয়রোধেও বেশ ভালো ভূমিক রাখে। ১০ একরের আমার এ বাগানের ফাঁকা স্থানে ড্রাগন,কমলা, পার্সিমন ইত্যাদি নতুন নতুন ফল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া আমার আরো একটি ৮ একরের পতিত পাহাড়ি টিলা রয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের উঁচুতে সেচ দেওয়ার জন্য ড্রিপ ইরিগেশন উপকরণ, সোলার সেচ পাম্প, ফসল প্রদর্শনী স্থাপন ইত্যাদি সহায়তা পেলে সেখানেও বাণিজ্যিক মিশ্র ফল বাগান স্থাপন করবেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার মতো এলাকার অনেকেই বিভিন্ন সমস্যার উপর আলোকপাত করে বলেন, এসব প্রত্যন্ত এলাকায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় নিজেদের পন্য বিক্রির জন্য একমাত্র নৌ পথের উপরই ভরসা করতে হয় আমাদের। যার ফলে ন্যায্য বাজারমূল্য থেকে বঞ্চিত হই আমরা। তাছাড়া বাগানের পাহাড়ের উঁচু স্থানগুলোতে কার্যকর সেচব্যবস্থা স্থাপনে সাধারণ কৃষকদের আর্থিক অক্ষমতাও রয়েছে।

অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং প্রচেষ্টা থাকলে সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে সামনে যে এগিয়ে যাওয়া যায় সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যার দৃষ্টান্ত সে বার্তাই দিচ্ছে এলাকার আগ্রহী সকল কৃষকদের মাঝে। এলাকার কৃষকদের সমস্যা সমাধানে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং উপযুক্ত সহায়তা প্রদান করা গেলে অদুর ভবিষ্যতে অনাবাদি পতিত পাহাড়ের প্রচলিত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের আমূল পরিবর্তন ঘটবে, ঘটবে কৃষি বিপ্লব। এক একটি পাহাড় এক একটি বাণিজ্যিক খামারে পরিণত হবে।

৩০ প্রজাতির ফল চাষে তাক লাগিয়েছেন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা লেখাটির লেখক আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, রাঙ্গামাটি। মোবাইল : ০১৭১২৮১৬৩৫২।