রফিকুল ইসলামঃ ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না’ – দেশে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ রয়েছে। যার অর্থ- তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে অপরাধ গোপনের চেষ্টা।
তেমনি একজন হলেন কৃষিশিক্ষক হাসান মো. ফরহাদ। তিনি মাদরাসার সুপার মো. আমিনুল হক ওরফে কাজী মৌলভীর সাথে অবৈধ আঁতাত করে বছরের পর বছর ধরে অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা তোলে নিচ্ছেন। এ অনিয়ম, জালিয়াতির ও দুর্নীতিকে বৈধতা দিতে এবং কৃষিশিক্ষক ও সুপারের গা বাঁচানোর ফন্দিতে গত ১০ এপ্রিল দায়মুক্তি রেজুলেশন করে নিয়েছেন সুপার হুজুর। সেই রেজুলেশন আবার তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে অপরাধকে ঢেকে সাধু সাজার চেষ্টা করছের বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
হাসান মো. ফরহাদ কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার সহকারী কৃষিশিক্ষক। তাছাড়া তিনি উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. রইছ উদ্দিনের ছেল। বিশেষ করে মিঠামইনের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক সরকারি কলেজের সহকারী লাইব্রেরিয়ান ও স্থানীয় রাজনৈতিক হেভিওয়েট নেতার বড়গিরি বলে সবকিছুতেই ছাড় পেয়ে আসছেন বলে এলাকাবাসী জানায়।
এ ব্যাপারে কথা হয় শ্যামপুর গ্রামের রেনু মিয়া (৫৫), রাশিদ মিয়া (৪০), সুন্দর আলী (৫৫), শমসের বেপারি (৪০), বাচ্চু মিয়া (৫০), শামীম মিয়া (৩৫), রইছ উদ্দিন (৬০), সোহরাব মিয়া (৪৫), আল আমিন (৩৫), আবুল কাশেম (৫৫) শাহীন খান (২১), আশিকুর রহমান (২৫), রুবেল (২৮), আলমগীর (৩০), শোভেল (২৫), মাসেক (২৫), খোকা (২২), ইকবাল (৩০), আরমান (২৮), রিমন (১৯), দীন ইসলাম (১৯), মিলন (২০), শাহাদাত হোসেন (২৮), মিজানুর রহমান (৩৫), নজিবুর রহমান (২৪), কেরামত (৩০), জয়নাল (৩২), পারভেজ (২৮), কামরুল (১৮), আব্বাস আলী (৭০), একিন আলী (৭০), জুয়েল (৪০), মাসুদ (৩৫), আনু (২৪), নাঈম (২৩), এনামুল (২৩), রাসেল (২৩), মুজিবুর (২৪)সহ শতাধিক লোকের সাথে।
তারা বলেন, গত ৭ এপ্রিল পাঠকপ্রিয় জাতীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেটে ‘বছরের পর বছর অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন তোলেন মাদরাসা শিক্ষক’ শিরোনামে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনটি উপজেলা শুধু নয়, সারাদেশব্যাপী সাড়া জাগিয়েছে। যার ফলে নেপথ্যের হোতা স্থানীয় ওই নেতা, শিক্ষক ফরহাদ ও সুপার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে শিক্ষক ফরহাদের পক্ষে দায়মুক্তির রেজুলেশনটি করিয়ে নেয়।
প্রকাশিত সংবাদটি শতভাগ সত্য জোরালো দাবি করে তারা বলেন, শিক্ষক হাজিরা খাতায় হাসান মো. ফরহাদের অনুপস্থিতির অসংখ্য দালিলিক প্রমাণাদি রয়েছে।
ফেসবুকে পোস্ট করা রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়, সংবাদটি অপপ্রচার, মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিীন, মনগড়া ও কল্পনা প্রসূত। হাসান মো. ফরহাদ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন মেনে নিয়মিতভাবে শিক্ষকতা করে আসছেন বলে দাবি করা হয়।
এমনকি কোভিড-১৯ এর সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকালীন সময়ে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পরা সত্ত্বেও নিয়মিতভাবে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান যখন বন্ধকালীন সময়ে আসতে বলেছেন, তখনও প্রতিষ্ঠানে আসতেন এবং কখনো অসুস্থতার কারণে ছুটি ভোগ করেননি।
গত ১০ এপ্রিল মাদরাসায় অনুষ্ঠিত সুপারিন্টেন্ডেন্ট মো. আমিনুল হক ওরফে কাজী মৌলভীর সভাপতিত্বে স্টাফ মিটিংয়ের ওই রেজুলেশনে শিক্ষক ফরহাদের অনুপস্থিতি ও অনিয়মের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগকারী ব্যক্তি ও তার ফেসবুক আইডিতে প্রকাশিত সংবাদের লিংক প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সামাজিক প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলাসহ যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে অবিচার ও অনাচারে অতিষ্ঠ ভুক্তভোগী মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষক বলেন, তারা ওই রেজুলেশনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নন। সুপার হুজুর দুই বছর ধরে আটকিয়ে রাখা আমাদের উচ্চতর বেতন স্কেল পাইয়ে দেবার কথা বলে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদটিকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ বলে অভিমত ব্যক্ত করে তারা বলেন, সুপার হুজুর তাদেরকে সকল ক্ষেত্রে জিম্মি করে রেখেছেন। যেকোনো অন্যায় বিষয়ও লিখিত সম্মতি আদায় করে নে। এটা করে থাকেন ‘বিপদে ফেলে হয়রানি করা এবং চাকরি খেয়ে ফেলা’র ভয় দেখিয়ে।
তারা আরও বলেন, সুপার হুজুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও পেশাগত অধিকার হরণ করে চলেছেন। অতিরিক্ত খাটিয়েও বঞ্চিত করে রেখেছেন বহুবিধ আর্থিক ন্যায্য পাওনা থেকে। অমানবিক আচরণ এবং অশ্লীল গালিগালাজেও মর্মাহত আমরা।
তবে তারা সবসময় ক্ষতির আশঙ্কায় থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, সুপার হুজুরের খুঁটির জোর অনেক গভীরে। তাই নালিশ করার জায়গা থাকলেও উপায় নেই – পাছে জুলুম তাড়া করে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছেলে মাননীয় এমপিকেও কেয়ার করেন না হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, মাদরাসার কোনো একটি বিষয়ে মাননীয় এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিককে ‘অভিনন্দন’ জানানোর জন্য আজও বলিরপাঁঠা হয়ে রয়েছি। কোনো ছুতোনাতায় সাফ বলে দেন, ‘তোদের বাপের কাছে যা’! এহেন অবস্থার পরিত্রাণ চায় তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক ছাত্রী বলেন, আমাদের এক ম্যাডামকে মেডিকেল ছুটি দেয়নি পর্যন্ত। অথচ ফরহাদ স্যার বিগত বছরগুলোতে মাদরাসায় না এসেও পারছেন। চাপে ফেলে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার জন্য সুপার হুজুর আমাদেরকেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
হোসেনপুর গ্রামের তাহসান আহমেদ (২০), দুর্জয় (২২), শফি (২০), জাহিদুল (২২), রাকিবুল (২০), মুজাহিদ (২০), ইমরান (২১)সহ অনেকেই বলেছেন, হাসান মো. ফরহাদ মিঠামইন বাজারে ব্যবসা করেন বলেই জানি। মাদরাসায় চাকরি করার বিষয়টি জানতে পারি পাঠকপ্রিয় জাতীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেটে ‘বছরের পর বছর অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন তোলেন মাদরাসা শিক্ষক’ সংবাদটি পড়ে।