হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঢাকার পূর্বাচলে বিশ্বমানের প্যাকিং হাউজ ও অ্যাক্রেডিটেড ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কৃষিপণ্যের সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা, মান পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এই ল্যাবে। পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির জন্য করা যাবে প্যাকিং (মোড়কজাত)। থাকবে রপ্তানি সংক্রান্ত প্রায় সব সুবিধা। এই ল্যাব চালু হলে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য আর রপ্তানি জটিলতায় আটকে যাবে না। রপ্তানিতে হঠাৎ আসবে না নিষেধাজ্ঞা। বাড়বে রপ্তানি বাণিজ্য।
দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম এই ল্যাব স্থাপনে এরই মধ্যে ঢাকার পূর্বাচলে দুই একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়কে। জমি বরাদ্দ পেলেও সেই অর্থে শুরু হয়নি কাজ। ল্যাবের প্রস্তাবনা তৈরির জন্য মাত্র সমীক্ষার কাজ চলছে। পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। তবে এ ল্যাবের সুফল পেতে লাগতে পারে দীর্ঘ সময়।
জানা যায়, এখন পরামর্শক দল কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে প্রস্তাবনা নিচ্ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবের সুবিধা দেখে চালাচ্ছেন প্রস্তাব তৈরির কাজ। এরপর সেটি প্রকল্প আকারে পাস হলে প্রাথমিক কাজ শুরু হবে।
ল্যাব স্থাপনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করছে কৃষি অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং। দপ্তরটির পরিচালক বলেন, এটি এখনো সময়সাপেক্ষ। মাত্র সমীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। কীভাবে এটি করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।
‘এমন আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপনের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। একার পক্ষে সেটি করাও সম্ভব নয়। সেজন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে যারা এ ল্যাব ফ্যাসিলিটি ব্যবহার করবেন তাদের কী ধরনের সুবিধা প্রয়োজন জানা হচ্ছে সেটিও।’
তিনি বলেন, এরপর এখান থেকে (উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং) প্রকল্প প্রস্তাব করা হবে। সেটা পাস হলে শুরু হবে অবকাঠামোর কাজ। মেশিনারিজ, প্রশিক্ষণ, নিয়োগ- সবমিলে অনেক সময়। এরপর অধিদপ্তর থেকে প্রকল্প নেওয়া হবে। তখন স্পষ্ট করে বলা যাবে এতে কী ধরনের সুবিধা থাকবে, খরচ কত হবে।
এ কর্মকর্তা মনে করেন, এমন ল্যাব দেশে অনেক আগে থেকে দরকার ছিল। এটি যখন হবে তখন কৃষিপণ্যের রপ্তানি বহুগুণে বাড়বে। বিশেষ করে হুটহাট যে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে, সে পরিস্থিতি কেটে যাবে।
জানা যায়, গত মাসে এফএও নিযুক্ত পরামর্শক বি. গ্লোদ ফ্রান্স থেকে ভার্চুয়ালি ল্যাবের বিভিন্ন বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন। এর আগেও কৃষি মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার আন্তর্জাতিকমানের প্যাকিং হাউজ ও অ্যাক্রেডিটেড ল্যাব স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, জনবল, প্রশিক্ষণ, সম্ভাব্য ব্যয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রস্তাবনা তুলে ধরেন এ পরামর্শক।
শেষ দফায় সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক সংগঠন ও পণ্য প্রক্রিয়াকরণকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা ও সংগঠনগুলো সেখানে কী ধরনের সুবিধা চান সেটা জানা যায় সভায়। পরবর্তীসময়ে লিখিত প্রস্তাবনা আকারেও সেটি জমা দিতে বলা হয় সংগঠনগুলোকে।
যেসব সুবিধা থাকবে পূর্বাচলের ল্যাবে
উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এ ল্যাব স্থাপনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন। তারা কয়েকটি দেশে এমন ল্যাব পরিদর্শন করেছেন। তারা বলছেন, মূলত কৃষিপণ্যের সঙ্গনিরোধ, মান পরীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ও প্যাকিং সুবিধা প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হবে ল্যাবটি। যদিও সেখানে সর্বাধুনিক সব সুবিধা এক ছাদের নিচে চাচ্ছেন দেশের কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী এবং রপ্তানিকারকরা।
জানা যায়, এ ল্যাবে আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রে সঙ্গনিরোধের কাজ হবে। অর্থাৎ কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, উপকারী জীবাণু এবং প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে পরিবাহিত হয়ে যাতে বিদেশি পোকামাকড় ও রোগবালাই দেশে প্রবেশ করতে না পারে। একইভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রেও সেটা যেন না হয় সে ব্যবস্থা থাকবে। এসব বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা, ঝুঁকিমুক্ত আমদানি-রপ্তানি নিশ্চিতকরণ ও আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুসরণ করে পণ্য আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে এ ধরনের কার্যক্রম গতিশীল করা হবে।
এ বিষয়ে রঞ্জিৎ কুমার পাল বলেন, শাক-সবজি-ফলসহ সব ধরনের কৃষিপণ্যের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ছাড়পত্র, রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার সুবিধা থাকবে ল্যাবে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে টাটকা শাক-সবজি ও ফল রপ্তানির আগে সেখানে নিয়ে ক্রেতার চাহিদা মতো প্যাকিং করা যাবে। এরপর জাহাজীকরণের আগে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার সুবিধা থাকবে। প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের জন্য স্থাপন করা হতে পারে আলাদা হিমাগার। তবে বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্ট নয়।তিনি বলেন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীরা তাদের উৎপাদিত যে কোনো পণ্য রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে পারবেন এই ল্যাবে। অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবের ছাড়পত্র পাবেন। এই ব্যবস্থা হবে দেশে প্রথম।
১৪ ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা চান কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীরা
এরই মধ্যে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ওই ল্যাবে ১৪টি পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দিয়েছে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ল্যাবের সুফল দিয়ে কৃষিপণ্যের রপ্তানি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়াতে চাইলে প্রক্রিয়াজাত পণ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এ বাজার সবচেয়ে বড় ও সম্ভাবনাময়।
‘সেজন্য পূর্বাচল ল্যাবে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের ফাইটোস্যানেটারি ও বিএসটিআই সম্পর্কিত ১৪ ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সেগুলো সুপারিশ করা হয়েছে কৃষি অধিদপ্তরকে।’
যে ১৪টি সুবিধা থাকার কথা বলা হচ্ছে
খাদ্যপণ্যে রাসায়নিকের উপস্থিতি পরীক্ষা, মাইক্রোবায়োলজিক্যাল প্যারামিটার নির্ধারণ, ভারী ধাতু নির্ণয়, কীটনাশক পরীক্ষা, পুষ্টির মূল্য নির্ধারণ, অ্যালার্জেন চিহ্নিতকরণ, প্রিজারভেটিভের মাত্রা নির্ধারণ, অ্যালোইন পরীক্ষা, অ্যাফ্লাটক্সিন পরীক্ষা, সোডিয়াম পরীক্ষা, ইথিলিন অক্সাইড পরীক্ষা, মাইগ্রেশন পরীক্ষা, গ্লিসিডাইলেস্টার ও পানির সব পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে ইকতাদুল হক মনে করেন, এ ল্যাবে প্রক্রিয়াজাতকারীদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা থাকছে না। বিষয়টি সরকারের আন্তরিকভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। ল্যাব সম্পর্কে যেটুকু আমাদের জানানো হয়েছে তার অধিকাংশ সুবিধা টাটকা শাক-সবজি ও ফল রপ্তানিকারকদের জন্য।
প্রতিদিন দুইশো টন প্রক্রিয়াকরণ সুবিধা চায় বিএফভিএপিইএ
তাজা শাক-সবজি ও ফল রপ্তানিকারকরা ল্যাবে প্রতিদিন দেড়শো থেকে দুইশো টন পণ্য প্রক্রিয়াকরণের সুবিধা চান। এছাড়া ওয়ানস্টপ সার্ভিস, মান পরীক্ষা ও স্থায়ী হিমাগার চান তারা। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করছে তাজা শাক-সবজি, ফলসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ)।
বিএফভিএপিইএ’র উপদেষ্টা কৃষিবিদ মনজুরুল ইসলাম বিভিন্ন রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা বলে এ প্রস্তাবনা তৈরি করছেন। তিনি বলেন, প্রথমত এখানে প্রতিদিন দেড়শো থেকে দুইশো টন শাক-সবজি, ফলমূল লোড-আনলোড থেকে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার সুবিধা রাখতে হবে। যেন ক্ষেত থেকে পণ্য এনে সেখানে রপ্তানির জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করা যায়। একই সঙ্গে সেখানে যেন একটি ব্যাংক থাকে, যার মাধ্যমে বিদেশে আর্থিক দেনদেনও করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, টাকটা শাক-সবজির জন্য তিন ধরনের পরীক্ষার প্রস্তাবনা দিচ্ছি। সেগুলো হলো- মাইক্রোবায়োলজিক্যাল প্যারামিটার নির্ধারণ, ভারী ধাতু নির্ণয় ও কীটনাশক পরীক্ষা। এছাড়া দ্রুতগতিতে কীটনাশক ও রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সম্ভব হলে সেটা কীভাবে নির্মূল করা যায় সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
এই কৃষিবিদ আরও বলেন, এই ল্যাবে জাহাজীকরণের আগে সাময়িক পণ্য রাখার ব্যবস্থা থাকছে। তবে আমরা শাক-সবজি ও ফলের প্রকারভেদে নির্ধারিত তাপমাত্রার ভিন্ন ভিন্ন সংরক্ষণাগার চাই। প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদে পণ্য সংরক্ষণ সম্ভব হবে। যাতে অন্তত শিপমেন্ট বাতিল হলে সে পণ্য সংরক্ষণ সম্ভব হয়।